ইংল্যান্ডের ফাইনাল-দুঃখ ঘুচবে এবার?

২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

উৎপল শুভ্র

১৬ মে ২০২১

ইংল্যান্ডের ফাইনাল-দুঃখ ঘুচবে এবার?

ব্রিজটাউনে ফাইনালের আগের দিন ট্রফি নিয়ে দুই অধিনায়ক পল কলিংউড ও মাইকেল ক্লার্ক। ছবি: গেটি ইমেজস

এর আগে বিশ্বকাপে বারবার স্বপ্নভঙ্গের গল্প লেখা হয়েছে বলে ব্রিজটাউনে ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেও ইংল্যান্ড দলকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল অতীতের সেই দুঃস্বপ্ন। ফাইনালের প্রথাগত প্রিভিউয়ের চেয়ে ইংল্যান্ডের আগের সব ফাইনাল নিয়ে লেখাটাতেই মজা পেয়েছিলাম বেশি।

প্রথম প্রকাশ: ১৫ মে ২০১০। প্রথম আলো।

‘আমরা এখনো কিছু জিতিনি।’ 

‘আমরা এখনো কিছু জিতিনি।’

অধিনায়কের কত কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। এর মধ্যেও পল কলিংউড সবচেয়ে বড় কাজ বলে মনে করছেন, সতীর্থদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া—‘আমরা কিছু জিতিনি।’

গায়ানায় আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের ওই উদ্বেগের সময়টা বাদ দিলে এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এক কথায় দুর্দান্ত। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেমিফাইনালের ইংল্যান্ডকে বোঝাতে দুর্দান্ত শব্দটাকেও অনেকের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। তাঁরা বলে ফেলছেন ‘অবিশ্বাস্য’। যাঁদের একজন নাসের হুসেইন। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্সকে অদৃষ্টপূর্ব বলেও রায় দিয়ে দিয়েছেন সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক।

বারবাডোজে সুপার এইটের তিন ম্যাচে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডকে আরামে হারিয়েছে ইংল্যান্ড। তার পরও সেমিফাইনালটা সেন্ট লুসিয়ায় বলে শ্রীলঙ্কাকেই একটু এগিয়ে রাখতে হয়েছিল। স্লো উইকেট, স্পিন ধরে, মাঠ বড়—ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উপমহাদেশের যেকোনো দলের স্বপ্নের মাঠ এই বোশেজো। সেখানেই কলিংউডের দল শ্রীলঙ্কাকে এমন দুঃস্বপ্ন উপহার দিল যে, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে সবচেয়ে একতরফা ম্যাচের তালিকায় ঢুকে গেল এই সেমিফাইনাল।

যেটির পর পল কলিংউড এমনও বলে ফেলতে পারলেন যে, দলে খুব একটা উন্নতির জায়গা তাঁর চোখে পড়ছে না। বলেই হয়তো মনে হলো, এটা আত্মতৃপ্তির মতো শোনাতে পারে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে দলে। সবাইকে ‘আমরা এখনো কিছু জিতিনি’ মনে করিয়ে দেওয়াটা তাই কর্তব্য বলে মনে হলো তাঁর।

আত্মতৃপ্তির ভয় তো আছেই। পল কলিংউড ছাড়া ইংল্যান্ডের এই দলের আর কারও কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতাই নেই। কলিংউডের অভিজ্ঞতাটাও সুখের হয়নি। ২০০৪ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। ২১৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ উইকেটে ১৪৭—বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের ট্রফি-খরা তাহলে ঘুচতে যাচ্ছে! ঘোচেনি অপরাজিত নবম উইকেটে ইয়ান ব্র্যাডশ ও কোর্টনি ব্রাউন ৭১ রানের জুটি প্রায়ান্ধকার ওভালে ইংল্যান্ডকে ঘোর অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়ায়।

এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে সর্বশেষ ফাইনাল ওটাই। ব্র্যাডশ-ব্রাউনের আগেও ফাইনালের খাতায় ইংল্যান্ড শুধু অন্ধকারই জমা করেছে। যেসবের প্রতীক হয়ে আছে কিছু নাম, কিছু ঘটনা—

• ১৯৭৯ প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপ ফাইনাল—ভিভ রিচার্ডসের ১৩৮।

• ১৯৮৭ রিলায়েন্স বিশ্বকাপ ফাইনাল—মাইক গ্যাটিংয়ের রিভার্স সুইপ।

• ১৯৯২ বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বকাপ ফাইনাল—ওয়াসিম আকরামের পরপর দুই ইয়র্কার। 

মূল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের এই তিনটিই ফাইনাল। প্রথমটি ছিল ৬০ ওভারের বিশ্বকাপ। পরের দুটি ৫০ ওভারের। 

১৯৭৯ সালের ফাইনালে রিচার্ডসের ১৩৮-এর সঙ্গে কলিস কিংয়ের ৬৬ বলে ৮৬। ম্যাচের নির্ধারক হিসেবে তার পরও নাম আসে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনারের। মাইক ব্রিয়ারলি ও জিওফ বয়কটের উদ্বোধনী জুটিতে ১২৯। কিন্তু সেটি এমনই শম্বুকগতির যে, ম্যাচটা ইংল্যান্ড সেখানেই হেরে যায়।

২০০৭ বিশ্বকাপের আগে জ্যামাইকাতে ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ বিশ্বকাপজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের একটা সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। তাতে অ্যান্ডি রবার্টসের কাছে এক ইংরেজ সাংবাদিক জানতে চান, ‘১৯৭৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড জয়ের পথে থেকে হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলেছিল কেন?’ রবার্টস মহা বিস্মিত হয়ে জানতে চান, ‘আপনি কোন ম্যাচের কথা বলছেন?’ আবার ‘১৯৭৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল’ বলার পর রবার্টস বলেন, ‘আপনি বোধ হয় অন্য কোনো ম্যাচ দেখেছেন। না হলে ইংল্যান্ড জয়ের পথে ছিল বলেন কীভাবে...আরে, আমরা তো ওই দুইটাকে উইকেটে রেখে দিতে চেয়েছিলাম।’ জনশ্রুতি আছে, লয়েড ইচ্ছা করেই বয়কটের ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন।

১৯৯২ ফাইনালে ওয়াসিম আকরামের যুগল আঘাতের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড অবশ্য জয়ের পথেই ছিল। পরপর দুই বলে অ্যালান ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইসকে বোল্ড করে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন আকরাম। 

ইডেন গাডেনে ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের সেই `কুখ্যাত` রিভার্স সুইপ। ছবি: গেটি ইমেজস

১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালটা ইংল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে ট্র্যাজিক। মাত্র ৭ রানের ব্যবধান একটা কারণ। তার চেয়ে বড় কারণ, এটি যে নিজেরাই নিজেদের হারানোর গল্প। যেটির নেতৃত্বে অধিনায়ক! ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত রিভার্স সুইপটি খেলে। সেটিও আবার প্রতিপক্ষ অধিনায়কের বলে। অ্যালান বোর্ডার নিজের বোলিং সম্পর্কে রসিকতা করে বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় আফসোস, আমি আমার বোলিংয়ে ব্যাট করার সুযোগ পেলাম না!’ সেই বোর্ডারের প্রথম বলেই রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে টপ এজ হয়ে যায় মাইক গ্যাটিংয়ের। অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপারের গ্লাভসে বলের সঙ্গে জমা পড়ে যায় বিশ্বকাপও।

২০০৫ সালে বাংলাদেশের ইংল্যান্ড সফরের সময় ডারহাম টেস্টে মাইক গ্যাটিং উপস্থিত কারি প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে। বাংলাদেশের সাংবাদিক ওই রিভার্স সুইপের কথা তোলায় বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এত দিন পরও ওই কথা! আমি আর কিছু কি করিনি!’
মাইক গ্যাটিং নিশ্চয়ই প্রার্থনায় বসে গেছেন। ওই রিভার্স সুইপের জ্বালা ভুলতে তাঁর যে একটা বিশ্বকাপ চাই। হোক না সেটি ২০ ওভারের বিশ্বকাপ!

আরও পড়ুন: ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ-দুঃখ ঘোচালেন দুই দক্ষিণ আফ্রিকান

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×