২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
আকমলদের হাসি মুছে দিলেন মাইক হাসি
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় ম্যাচের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে এই অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান সেমিফাইনাল। শেষ দুই ওভারে ৩৪ রানের প্রয়োজনকেও যে ম্যাচে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পাকিস্তানকে ১৯১ রানের বড় স্কোরে তুলে দেওয়া আকমল ব্রাদার্সের মুখ থেকে হাসি মুছে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন যিনি, তাঁর নামই হাসি। মাইক হাসি।
প্রথম প্রকাশ: ১৫ মে ২০১০। প্রথম আলো।
পাকিস্তান দেখাল কেন তারা পাকিস্তান! অস্ট্রেলিয়াও দেখাল কেন তারা অস্ট্রেলিয়া!
ফলাফল–টি-টোয়েন্টির সেরা বিজ্ঞাপন হতে পারে, এমন রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচ। শেষ পর্যন্ত যাতে পাকিস্তানি আবেগের বিরুদ্ধে ‘হারার আগে হার নয়’ অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতার জয়। এক বল বাকি থাকতে এই বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ জিতে অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে। আগামীকাল বারবাডোজের ফাইনাল তাই এক টুকরো ‘অ্যাশেজ’! অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড।
অথচ ম্যাচের বেশির ভাগ সময় জুড়েই মনে হচ্ছিল, পাকিস্তান নামের রহস্যময় খাদে বোধ হয় তলিয়েই যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। ‘রহস্যময়’–কারণ এ ছাড়া কালকের পাকিস্তানের কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিতর্কে জর্জরিত ভাঙাচোরা এক দল। সুপর এইটে একটা মাত্র ম্যাচ জিতে নেট রানরেটের কল্যাণে সেমিফাইনালে। সেখানেই পাকিস্তান পুরোনো সত্যিটা আবারও প্রমাণ করল–ওরা কখন কী করবে, নিজেরাই জানে না!
আরেকটি রূপকথা পাকিস্তান যখন লিখে ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে, তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব মাইক হাসির। ছোট ভাই ডেভিড আউট হওয়ার পর যখন নেমেছেন, অস্ট্রেলিয়ার চাই ৪৫ বলে ৮৭ রান এবং পাকিস্তান তখন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ।
রান-বলের সমীকরণ ক্রমশ আরও কঠিন হতে থাকল। শেষ ৭ ওভারে ৮৫, ৬ ওভারে ৮০, ৫ ওভারে ৭০…। যে ক্যামেরন হোয়াইট ছক্কা মারাটাকে বিশ্বের সহজতম কাজ বলে মনে করাচ্ছিলেন, হাসিকে ছেড়ে গেলেন তিনিও। হোয়াইটের ৩১ বলে ৪৩ রানে কোনো চার নেই, ছক্কা ৫টি। স্টিভ স্মিথের বিদায়ে সপ্তম উইকেট যখন পড়ল, তখনো অস্ট্রেলিয়ার চাই ১৭ বলে ৪৮।
শেষ দুই ওভারে ৩৪। আমিরের ওভারে হাসি একাই নিলেন ১৬। শেষ ওভারে ১৮ রান দরকার। প্রথম বলে সবচেয়ে জরুরি কাজটা করলেন মিচেল জনসন। সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দলে মাইক হাসিকে। এরপর যা হলো, সেটি অনেক দিন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে সাঈদ আজমলকে। ৬-৬-৪-এ স্কোর সমান হলো। পঞ্চম বলে বিশাল আরেক ছক্কায় এল অস্ট্রেলিয়ার জয়।

মাত্র ২৪ বলে মাইক হাসি অপরাজিত ৬০। ৩টি চার, ছক্কা তার দ্বিগুণ। টেস্ট-ওয়ানডেতে স্মরণীয় অনেক ইনিংস থাকার পরও ঘোষণা দিচ্ছেন, এটাই সম্ভবত তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে অমন পরিস্থিতিতে এমন একটা ইনিংস সেই মর্যাদা পেতেই পারে। মাইক হাসির তৃপ্তির আরেকটি জায়গা আছে। টি-টোয়েন্টিতে যে একসময় অপাংক্তেয় মনে করা হয়েছিল তাঁকে!
হাসির ওই ইনিংসটির আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, চাপে সবাই ভাঙে এবং অস্ট্রেলিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। এর আগ পর্যন্ত যে হলুদ জার্সি থেকে আত্মবিশ্বাসের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে, উমর আকমলের ব্যাটিং তান্ডবে তারাও এলোমেলো। ওভার থ্রো হলো, উইকেটকিপারের হাত গলে বাই চার–অস্ট্রেলিয়ানদের শরীরী ভাষাতেও এই বিশ্বকাপে প্রথম অসহায়ত্বের প্রকাশ।
২০ ওভারে ১৯১ অনেক রান। সেন্ট লুসিয়ার ধীর উইকেটে আরও বেশি। এই বিশ্বকাপে এর আগে এখানে ১৯১ হয়েছে আরও একবার। গ্রুপ পর্বের সেই ম্যাচে ছিল ভূমিকার অদলবদল। পাকিস্তানের বিপক্ষেই অস্ট্রেলিয়ার ওই ১৯১।
ন্যানেসের প্রথম ওভারটি মেডেন। টেইটের দ্বিতীয় ওভারে ৩ রান। টেইটের দুর্দান্ত শেষ ওভারে বাই-ওয়াইড মিলিয়েও মাত্র ৭ রান। ওই ১৯১-এর ১৮১-ই মাঝের ১৭ ওভারে। শুরুটা করেছিলেন বড় ভাই, শেষটা করলেন ছোট জন। পাকিস্তানের ১৯১-এর ১০৬-ই আকমল ব্রাদার্সের প্রযোজনায়।

কামরন আকমলের ৩৪ বলে ৫০ রানে ৬টি চার ও ২টি ছয়। স্টিভ স্মিথের দ্বিতীয় বলেই হাডিন ক্যাচ মিস না করলে অবশ্য ১৬ রানেই ফিরতে হয় তাঁকে। পরের তিন বলে ১টি চার ও ১টি ছয় মেরে ‘নতুন জীবন’টা উদযাপন করলেন কামরান।
উমর আকমল উদ্ভাসিত অষ্টাদশ ওভারে। মিচেল জনসনকে তিনটি ছক্কা, ওভারে এল ২৪ রান। ৩৫ বলে অপরাজিত ৫৬, ২টি চার ও ৪টি ছয়।
আকমল ভাইদের জয়গাথাই হতে যাচ্ছিল এই ম্যাচ। তাঁদের মুখের হাসি যিনি কেড়ে নিলেন, তাঁর নামই হাসি।
মাইক হাসি!











