বাবর আজমের কথা রেখেছে পাকিস্তান

উৎপলশুভ্রডটকম

৮ নভেম্বর ২০২১

বাবর আজমের কথা রেখেছে পাকিস্তান

এই বিশ্বকাপে যে অন্য এক পাকিস্তানের দেখা মিলছে, তাতে অধিনায়কের বড় ভূমিকা। বাবর আজম তাঁর ক্ল্যাসিকাল ব্যাটিংয়ের মতোই অস্থির পাকিস্তান দলকে বদলে দিয়েছেন শান্ত, আত্মবিশ্বাসী, লক্ষ্যে অবিচল এক দলে। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠে যাওয়া পাকিস্তানকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে যে, নিশ্চিতভাবেই সতীর্থদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই কথাটা। ভারতকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে হারানোর পরই যা তিনি বলেছিলেন।

'উপভোগ করো তবে ওভার এক্সাইটেড হওয়া যাবে না। সবাই মিলেই আমরা উপভোগ করব, তবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য বিশ্বকাপ জেতা, সেখানে ফোকাস রাখতে হবে। তাই আমাদের রিল্যাক্স হবার কোনো সুযোগ নেই। ওভার এক্সাইটেড হওয়া আমাদের অভ্যাস, আমাদের এটা পরিবর্তন করতে হবে।’  বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভারতকে হারানোর পর ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের উদ্দেশে এ কথাগুলোই বলেছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম।

অভ্যাস পরিবর্তনের যে কথা বাবর বলেছেন, তা স্থায়ীভাবে পরিবর্তন হয়েছে কি না তা বলা না গেলেও এ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের পুরোনো অভ্যাসের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে অন্য এক ধারাবাহিক পাকিস্তানকে। যার ফল হিসেবে মিলেছে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে  অপরাজিত থেকে সেমিফাইনালে খেলার টিকিট।

অথচ নিউজিল্যান্ড-ভারতের গ্রুপে থাকায় পাকিস্তানের সেমিফাইনাল স্বপ্ন বেশ কঠিনই ছিল। বিশ্ব আসরে নিউজিল্যান্ড বরাবরই ধারাবাহিক। আর পাকিস্তানের জন্য বিশ্বকাপের ভারত-জুজু তো ছিলই। এমনকি সাবেক ভারতীয় স্পিনার হরভজন সিং তো খেলার আগেই পাকিস্তানকে ম্যাচ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তার এই কথা নিয়ে কম জল ঘোলা  হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় জবাবটা বোধ হয় পাকিস্তান মাঠেই দিয়েছে। ফেবারিট হিসেবে বিশ্বকাপ শুরু করা ভারতকে হারিয়েছে ১০ উইকেটে।

ব্যাট হাতে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিনায়ক বাবর আজম। ছবি: গেটি ইমেজেস

ভারত-বাধা পার হতে না হতেই সামনে নিউজিল্যান্ড। সেখানে বিপদ হলেও হতে পারত, তবে হারিস রউফের বোলিং, আসিফ আলী ও শোয়েব মালিকের লোয়ার- মিডল অর্ডারে অসাধারণ ব্যাটিং পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে দেয়।

ভারত ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সেমিফাইনালে এক পা দিয়ে রাখে পাকিস্তান। তারপরও হয়তো দলটা পাকিস্তান বলেই অনেকের মনে সন্দেহ ছিল, কারণ পচা শামুকে পা কাটা যে পাকিস্তানের পুরোনো অভ্যাস। তবে এবার আর সে সম্ভাবনাই জাগেনি। বরং প্রথম দুই ম্যাচে জয়ের পর নতুন ফেবারিট হিসেবে আবির্ভূত পাকিস্তান ফেবারিটের মতোই খেলেছে। বাবরের নেতৃত্বে একটা দল হিসেবে খেলে উড়িয়ে দিয়েছে সব শঙ্কা। পাঁচ ম্যাচই পেয়েছে নতুন পাঁচ নায়ক। যার শুরুটা করেছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি আর শেষটা অভিজ্ঞ শোয়েব মালিক। মাঝে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্ব দেখেছে আসিফ আলীর অসাধারণ ঝড় তোলা ফিনিশিং। পাশাপাশি প্রতি ম্যাচেই অবদান ছিল দলের প্রায় সবার।

তবে ক্রিকেট এমন একটা খেলা, দলীয় কৃতিত্বেও যেখানে অধিনায়কের  আলাদা ভূমিকা থাকে। এখানেই আসছেন বাবর আজম। যাঁর লড়াই শুধু মাঠেই ছিল না। মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের ভেন্টিলেটরে আর তিনি দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাঠে, তা-ও আবার বিশ্বমঞ্চে!

শুধু খেলছেন না, বলা উচিত বিশ্বমঞ্চে রাজত্ব করছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক বাবর। অস্থির এক পাকিস্তানকে গড়ে তুলেছেন শান্ত, ধারাবাহিক দল হিসেবে। যার বড় প্রমাণ, প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাকিস্তানের টানা পাচঁ ম্যাচে অপরিবর্তিত একাদশ। তাই এমন নেতার মুখেই তো ওভার এক্সাইটেড না হয়ে ফোকাস রাখার কথা বলা মানায়। আর এমন নেতার কথাই তো তাঁর দল অক্ষরে অক্ষরে পালন করে!

অভিজ্ঞ শোয়েব মালিক তরুণদের শেখাচ্ছেন কিভাবে দায়িত্ব নিতে হয়। ছবি: গেটি ইমেজেস

পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরও একজন, যিনি ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ শিরোপা, সেই ইমরান খান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এখন। সরকারি সফরে সৌদি আরবে থেকেও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখেছেন সদলবলে। প্রায় প্রত্যেকটা ম্যাচে পাকিস্তানকে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন। কখনো সেটা টুইটারের মাধ্যমে। কখনো বা ফোন কলে।

গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তান সফর বাতিল করে দেয় নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড দল। সেই ঘটনাও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মনোজগতে বড় প্রভাব ফেলে। বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে দেখিয়ে দেওয়ার জেদও চলে আসে তাতে, যেটাকে আরও উসকে দেয় ইমরান খানের পড়ে দেওয়া মন্ত্র। ইমরান সেদিন ক্রিকেটারদের বলেছিলেন, ‘তোমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দাও আমাদের শক্তি। কোনো দল যাতে আর আমাদের সঙ্গে খেলতে অস্বীকৃতি জানাতে না পারে।'

গত ২৩ অক্টোবর বিশ্বকাপ খেলতে দুবাইয়ে এসে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম নিজেই জানিয়েছেন সেই আলাপচারিতার কথা, 'এখানে আসার আগে তাঁর (ইমরান খান) সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী দলটার মানসিকতা এবং শরীরী ভাষা কেমন ছিল, আমাদের সেসবই বলেছেন তিনি।’

এই দুই নেতার জাদুর পরশে বদলে যাওয়া পাকিস্তান এখন শিরোপার অন্যতম দাবিদার। পাকিস্তানকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে বলে বাবর আজমকে এখন নিশ্চয়ই আরও বেশি করে সতীর্থদের মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে সেই কথাটা, ওভার-এক্সাইটেড হয়ে ফোকাস সরে গেলেই বিপদ...!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×