এশিয়ায় বিশ্বকাপে নন-এশিয়ানদের দাপট!

উৎপলশুভ্রডটকম

৯ নভেম্বর ২০২১

এশিয়ায় বিশ্বকাপে নন-এশিয়ানদের দাপট!

খেলা হচ্ছে এশিয়ায়, অথচ চার সেমিফাইনালিস্টের তিনটিই কিনা এশিয়ার বাইরের দেশ! এশিয়ায় বিশ্বকাপে নন এশিয়ান দেশগুলোর এই দাপটের রহস্য কী?

ম্যাচ ভেন্যুর কন্ডিশনের সঙ্গে বোঝাপড়ার সুবিধা-অসুবিধা ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলাতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্রিকেটই সম্ভবত একমাত্র খেলা, যেটিতে কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচয় থাকা না-থাকা এত বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে। সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফলও এর পক্ষেই কথা বলে। চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শেষ চারে পাকিস্তানের নাম থাকাটাও তো কন্ডিশনের সঙ্গে বোঝাপড়ার ফলাফলেরই অংশ।

কন্ডিশনের যুক্তিতে পাকিস্তানকে মেনে নেওয়া গেলেও শেষ চারে বাকি তিন দলকে মেনে নেওয়া দায়। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া এই তিন দলের সেমিতে ঠাঁই করে নেওয়া যেন আরেক পাড়ায় গিয়ে দাপুটে আচরণের মতোই। সংযুক্ত আরব-আমিরাত পাকিস্তানের সেকেন্ড হোম, তাই তাদের সাফল্যের না হয় একটা কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু এশিয়ার কন্ডিশনে বাকিদের সাফল্যের রহস্য কী ? 

উত্তরটা হতে পারে আইপিএল, তবে সেটি ঠিক  কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। কারণটা ভারত, আইপিএলের কথা বললে তো তারাই সবার আগে সামনে চলে আসে। ভারতের বিদায়ে আইপিএলের অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা মনে হওয়াই তো এখন সবচেয়ে বড় সত্যে রূপ নিয়েছে। সত্য-মিথ্যার সংজ্ঞা মূহুর্তেই বদলে নন এশিয়ান তিন দলের সেমিফাইনালে উঠে যাওয়াকে তাহলে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

কে ভেবেছিল এমন বিবর্ণ ভারতের রূপ! ছবি: আইসিসি

ভারতের হোঁচট খাওয়ার আলোচনা আপাতত এক পাশে সরিয়ে রাখাই ভালো। ইংলিশরা ভারতের মাটিতে সর্বশেষ বিশ্বকাপেও ফাইনাল খেলেছিল উইন্ডিজের বিপক্ষে। সেই বিশ্বকাপকে ‘আইপিএল তারকাদের বিশ্বকাপ’ বললে কেউ আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না। ইংলিশদের সেমিতে উঠে আসার গল্পে এবারও যে আইপিএলের বড় ভূমিকা ছিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। জেসন রয়, বাটলার, মঈন আলী কিংবা মরগানের নেতৃত্বে বিশ্বকাপের আগে শেষ হওয়া আইপিএলের অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। 

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে আইপিএল অভিজ্ঞতা কাজে লাগার পাশাপাশি তাদের খেলোয়াড়ের ম্যাচ পড়ার ক্ষমতাকেও মূল্য দিতে হবে। একটা দল হয়ে খেলার বড় উদাহরণও নিউজিল্যান্ড। নইলে বিশ্বকাপে সেরা দশ রান সংগ্রাহকের তালিকায় নিউজিল্যান্ডের কারোরই নাম নেই কেন? বোলিংয়ে শুধু বোল্ট আছেন চার নম্বরে। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও আইপিএলের ভূমিকাটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ওয়ার্নার আর কামিন্সের পারফরম্যান্সে নজর দিলেই তো খোলাসা হয়ে যায় ব্যাপারটা।

ক্রিকেটের আরও একটা বিষয় বা দক্ষতা আর কোনো খেলাতেই এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হলো 'নেতৃত্ব।' যে প্রসঙ্গে মরগানের কথা সবার আগে চলে আসে। আইপিএলে অফ ফর্মের কারণে একবার নাকি বিশ্বকাপ থেকে নিজেকে সরিয়েও নিতে চেয়েছিলেন তিনি। 

কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট তার ওপর বিশ্বাস হারায়নি। যেমন হারায়নি ২০১৫ বিশ্বকাপের পরেও। যেটির পুরস্কর ২০১৯ বিশ্বকাপ৷ এর আগে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিততে জিততে হেরে যাওয়া। এবার যে মরগান সেবারের অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মুখিয়ে আছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ছবি: এএফপি

কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসনও ব্যতিক্রম নন। ঠান্ডা মাথার নেতা হিসেবে যার জুড়ি নেই বর্তমানে। এ বছরই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। এক বছরে নিজের ও দলের নামের পাশে দুইয়ে দুই করতে তো অবশ্যই চাইবেন। উইলিয়ামসন মাঠে কোনো পরিস্থিতিতেই বিচলিত না হয়ে কাজ গুছিয়ে করার ক্ষমতা রাখেন। নইলে কি আর পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়ের পর নিউজিল্যান্ড এভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ভারতের সামনে? 

এই তিন দলেরই বোলিংয়ের মূল অস্ত্র সিমাররা। আমিরাতের উইকেট স্পিন সহায়ক হবে জেনেও নিজেদের শক্তিমত্তার জায়গাটা ভুলে যায়নি তারা। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডাম জাম্পা ১১ উইকেট নিয়েছেন সত্যি, তবে জাম্পার এই ১১ উইকেটের পেছনে সিমারদের সম্মিলিত ২০ উইকেট শিকারের ভূমিকা ম্যাচগুলো দেখলে আপনি ভালোই বলতে পারবেন। 

নতুন বলে ব্যাটসম্যানের ওপর চাপ তো সিমাররাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই চাপকে কাজে লাগিয়েই বাকি কাজ সহজেই সেরেছেন জাম্পা। সিমাররাও গতির ঝড় তোলার চেষ্টার বদলে কন্ডিশন মাথায় রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে বোলিংকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যে কারণে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কারও ফেবারিটের তালিকায় না থাকলেও এখন অস্ট্রেলিয়া সবারই সমীহ পাচ্ছে।

কিউই আর ইংলিশদের পেস অ্যাটাক আর স্পিন দুটোই দূর্দান্ত। দু'দলের তুলনা হলে কিউইরা কিছুটা এগিয়ে থাকবে স্পিনে মিচেল স্যান্টনার আর ইস সোধির কারণে। 

সুপার টুয়েলভের আগে কোয়ালিফায়ার খেলা আসালাঙ্কা, নিসাঙ্কা আর ভিজেকে বাদ দিলে ওয়ার্নারও শীর্ষ পাঁচেই জায়গা করে নেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায়। অ্যাডাম জাম্পাকে তো বোলিংয়ে শীর্ষেই ধরে নিতে হবে বেশি ম্যাচ খেলা হাসারাঙ্গা আর সাকিবকে বাদ দিলে। জাম্পার পরের স্থান তাহলে বোল্টের। আদিল রশিদও উঠে আসবেন উপরে। পরিসংখ্যান টানলেও স্পষ্ট নন এশিয়ানদের দাপট।

ইনফোগ্রাফিক্‌স: ইএসপিএন ক্রিকইনফো

আইপিএলের অভিজ্ঞতা, দক্ষ নেতৃত্ব, শক্তিমত্তার কথা তুলে ধরা হলেও আরেকটি বিষয় বাদ পড়ে গেছে। তা হলো — তিন বিভাগেই কমপ্লিট প্যাকেজ অব পারফেক্ট ক্রিকেট। ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং তিন দিকেই সমান প্রত্যয়ী ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাউন্ডারিতে জেসন রয়ের ঝাঁপিয় পড়া ক্যাচ। মোহাম্মদ হাফিজের  হাওয়ায় ভাসানো বল নিজেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে ডেভন কনওয়ের লুফে নেওয়া ক্যাচে এখনও চোখ আটকে আছে সবার। 

এমন তেজি ফিল্ডিংয়ে মাঠে শরীরী ভাষাকে স্বাভাবিকের চেয়েও দ্বিগুণ চাঙা করে তোলে। এমন হাল না ছাড়া ফিল্ডিং ম্যাচে প্রতিপক্ষের সাথে পার্থক্যের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়। ফিল্ডিংয়ে শতভাগ প্রচেষ্টা প্রতিপক্ষের ওপর চাপও বাড়িয়ে দেয়। ম্যাচ জিততে এমন ফিল্ডিংয়েরও অনেক বড় ভূমিকা।

ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড সবকিছু ঠিকঠাক করে দেখাতে পেরেছে বলেই সম্ভব হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো প্রতিকূল পরিবেশে বিশ্বকাপ খেলতে এসে সেমির মঞ্চে নিজেদের নাম লেখানোয়। অদৃশ্য আরেকটি ফ্যাক্টর হলো আইপিএলের পরপরই বিশ্বকাপ খেলতে নেমেও কোনো শারীরিক ক্লান্তি বা মানসিক অবসাদ গ্রাস করতে পারেনি তিন দলের আইপিএল সদস্যদের।

সর্বশেষ তিনটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই হয়েছে এশিয়ায়। যার দুটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন। প্রথমবার স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা আর পরেরবার ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। এবারও ফাইনালে এশিয়ার বাইরের একটি দল নাম লেখাচ্ছে, এটা তো নিশ্চিতই। আবার, নন এশিয়ান ফাইনাল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাও তো আছে। 

তিন বিভাগেই বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিকেট, নেতৃত্ব, আইপিএল অভিজ্ঞতা, শক্তির জায়গা নিয়ে আপোস না করাই মূল অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এই তিন দলের সাফল্যে। পাকিস্তানের হয়তো আইপিএল অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু তাদের ছিল জেদ। নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের পাকিস্তান সফর বাতিল করার জবাবটা বড় কিছু করে দেওয়ার তাড়না ছিল পাকিস্তানিদের মনে। এ কারণেই হয়তো চার সেমিফাইনালিস্টের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে আছে শুধু পাকিস্তানই।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×