আফিফ যা চেয়েছিলেন...

আফিফ যা চেয়েছিলেন...

ছবি: এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা দুই জয়। প্রথমটির মতো দ্বিতীয়টিও দুর্দান্ত টিম ওয়ার্কের ফসল। তার মধ্যেও আলাদা হয়ে থাকায় ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা পেলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। এর সঙ্গে বাড়তি প্রাপ্তি, যে চাওয়া নিয়ে ব্যাটিং করতে নামা, তা করতে পারার তৃপ্তি।

টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটা জয় পেতে অপেক্ষা ছিল ১৪ বছরের আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কিনা দু'দুটি জয়! প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে জিতেছিল বাংলাদেশ, দ্বিতীয় ম্যাচে পরে ব্যাটিং করে। প্রথমটা ২৩ রানে, দ্বিতীয়টা ৫ উইকেটে।সপ্তমবারের মতো কোনো নির্দিষ্ট দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের টানা দুই জয়।

এই পরিসংখ্যান কিছুটা বলছে। আসলে কিছুই বলছে না। কারণ দলটার নাম অস্ট্রেলিয়া, যাদের বিপক্ষে আগে কখনো টানা দুটি টি-টোয়েন্টিই খেলার সুযোগই আসেনি। সঙ্গে যোগ করুন। জয়ের ধরন। মাহাত্ম্যটা বেড়ে যাবে আরও অনেক গুণ। তামিম-মুশফিক-লিটনরা নেই সিরিজের আগে থেকেই; এদিন আবার রান তাড়ায় নেমে বাংলাদেশ ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলল ৫৯ তুলতেই, যার মধ্যে আছে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর উইকেটও। নয় বলের মধ্যে বাংলাদেশের এই দলের দুই ব্যাটিং নির্ভরতার বিদায়ের পর বাংলাদেশকে জেতানোর দায়িত্ব তখন দলের তরুণ ব্রিগেডের ওপর। কেউ বা বয়সে তরুণ, কেউ অভিজ্ঞতায়...তাঁরা কি পারবেন? অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ে হীনবল হতে পারে, কিন্তু বোলিং তো তা নয়।

৪ উইকেটে ৫৯ থেকে ৫ উইকেটে ৬৭ হতে বেশি সময় লাগল না। ময়-মুরুব্বির অশেষ দোয়া সঙ্গী করে নামা মাহেদী হাসানের ভাগ্যের কোটা শেষ হয়ে যাওয়ায় যখন ২৩ রানে স্টাম্পড হয়ে গেলেন, ১২২ রানের টার্গেটকেও মনে হচ্ছে অনেক দূরের কোনো বাতিঘর। উইকেট যদিও বাকি ৫টি, তবে গোটা বাংলাদেশই তখন জানে, ব্যাটসম্যান আছেন আফিফ হোসেন ধ্রুব, নুরুল হোসেন সোহান আর শামীম পাটোয়ারীই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন অঙ্গনে যাঁরা এখনো নিজের প্রতিষ্ঠিত করার সূচনালগ্নেই আছেন।

বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে পরাজয়ের শঙ্কা ভিড় করাটা তখন তাই খুবই স্বাভাবিক। ম্যাচ শেষের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও স্বীকার করছেন, তা একটু ভর করেছিল বৈকি। সেই শঙ্কা আস্তে আস্তে কর্পূরের মতো উবে গেল আফিফ হোসেন ধ্রুব আর নুরুল হাসান সোহানের সৌজন্যে। দুজনের ৬৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি, সফল রান তাড়ায় ষষ্ঠ উইকেটে যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ; ম্যাচ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার বেশ খানিকটা আগেই আসলে তা শেষ করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে দেড় ওভার বাকি থাকতেই। জয়ের আনন্দ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, তবে আফিফ ও সোহানকে এমন ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ বের করে নেওয়াটাতে আছে স্বস্তির উপাদানও। শুধু এই ম্যাচেই যার শেষ নয়, তা ভবিষ্যতের পাথেয়ও।

মাহমুদউল্লাহর প্রতিক্রিয়াতেও ওই স্বস্তি শব্দটা এলো। শূন্য রানে আউট হয়ে যাওয়ার পর অধিনায়কই যে সবচেয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। যে কারণে বলছেন, 'আফিফ ও সোহানকে এভাবে ব্যাট করতে দেখা অনেক স্বস্তির। ওরা দুজন আমাদের জয় পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ম্যাচিউরিটি দেখিয়েছে। দ্রুত কিছু উইকেট হারানোর পর ড্রেসিংরুমে দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। কিন্তু আফিফ ও সোহান যেভাবে ব্যাট করেছে, তাতে দুশ্চিন্তা কমে গেছে।'

আফিফের মধ্যে অবশ্য দুশ্চিন্তা ভর করেছিল বলে মনে হয় না। এমনিতেই তাঁর তেজোদীপ্ত চাহনিতে খেলা করে আত্মবিশ্বাসের ঝলকানি, সব সময়ই নিষ্কম্প স্নায়ু রাখতে পারার গুণ নিয়েই যেন জন্মেছেন। আর ক্যারিয়ার যতই ছোট হোক, এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ার অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন নয়। নিজের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচেই যা উড়িয়ে দিয়ে হেসেছিলেন তিনি বিজয়ীর হাসি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ৬০ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে। সেখান থেকে আট নম্বরে নামা আফিফ স্ট্রোকের দ্যুতি ছড়ানো ফিফটিতে জয় এনে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে।

তবে এদিন তো আর প্রতিপক্ষ শেন উইলিয়ামস-টেন্ডাই চাতারাদের জিম্বাবুয়ে ছিল না, বোলারদের নাম স্টার্ক-হ্যাজলউড-অ্যাগার...। আস্কিং রেটও কোনো ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং দাবি করছে না। আফিফ তাই ধীরেসুস্থে ম্যাচ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে বের করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করাতেই মন দিলেন। ব্যাটিংয়ে নামার সময় মাহমুদউল্লাহও যে করণীয়টা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে।প্রথম ২-৩ ওভার যেন তিনি নরমাল ক্রিকেটটাই খেলেন।

আফিফ তাই খেলেছেন। ম্যাচ শেষে জানালেন, শুরুতে তাই কিছুটা সময় নিয়েছেন উইকেটের চরিত্র বুঝতে। যত যা-ই হোক, উইকেটে টিকে থাকাটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর, 'আমার পরিকল্পনা ছিল শেষ পর্যন্ত যেন উইকেটে থেকে ম্যাচটা শেষ করে আসতে পারি। আমার বিশ্বাস ছিল, রিকোয়ার্ড রান রেট যতই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত উইকেটে থাকলে ম্যাচটা ভালোভাবে শেষ করতে পারব।’

ম্যাচের সেরা শট নিশ্চিত করেই। ছবি: ইউটিউব

তিনি টিকে থাকলেও জয়টা এত সহজ হতো না, যদি অন্য প্রান্ত থেকে সমর্থনটা না পেতেন। আফিফকে সেই সমর্থন জুগিয়েছেন সোহান। স্কোরকার্ড যদিও দেখাবে তিনি করেছেন মোটে ২২ রান, স্ট্রাইকও রেট ১০৪.৭৬; তবে আফিফ জানেন, এই উইকেটে এই টিকে থাকা ইনিংসটাই কী দারুণ প্রয়োজন ছিল! আর জানেন বলেই বলছেন, ‘সোহান ভাই অনেক ভালো ব্যাটিং করেছে। দুইজনেরই পরিকল্পনা ছিল, আমরা উইকেট দেব না। তখন বল টু বল রান দরকার ছিল। উইকেট না দিয়ে কীভাবে রান নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করছিলাম। অপর দিক থেকে ভালো সাপোর্ট পাওয়ায় কোনো চাপ অনুভব করিনি।’

ব্যাটসম্যানদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে দেওয়ার কাজটা অবশ্য বোলাররাই করেছিলেন। মাত্র ১২১ রানে অস্ট্রেলিয়াকে বেঁধে রেখে জয়ের মঞ্চটা তাদেরই তৈরি করে দেওয়া। ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগাতে পারায় আফিফ কৃতিত্ব দিলেন বোলারদের, সঙ্গে নিজেদের ফিল্ডিং নিয়েও তৃপ্ত তিনি, 'মিরপুরে আমাদের হোম কন্ডিশনে বোলিংয়ের একটা অ্যাডভান্টেজ থাকে, বোলাররা সেই অ্যাডভান্টেজটা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের ফিল্ডিং-ক্যাচিংও বেশ ভালো হচ্ছে।'

উইকেটের সুবিধা কাজে লাগানোর প্রশংসা আফিফের আগেই ঝরেছে রিয়াদের কণ্ঠেও, ‘বোলাররা অনেক ভালো করেছে, যে কারণে অস্ট্রেলিয়াকে ১২১ রানে আটকাতে পেরেছি। এমন কন্ডিশনে মুস্তাফিজ অনেক কার্যকরী এক বোলার। শরিফুলও ভালো করেছে, অন্য বোলাররাও অনেক ইকোনমিক্যাল ছিল।'

এদিন বাংলাদেশের জয়ে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটল। বল হাতে ২২ রান দিয়ে নিয়েছেন ময়েজেস হেনরিকেসের উইকেট; পরে ব্যাট হাতেও করেছেন ১৭ বলে ২৬, যার মধ্যে ছিল মুখোমুখি হওয়া প্রথম ওভারেই মিচেল স্টার্ককে মারা তিনটি চারও। তবুও এই দিনটায় সাকিব পড়ে রইলেন আড়ালেই, সে রকম কোনো উচ্চবাচ্যই তো হচ্ছে না তাঁকে ঘিরে। মাহমুদউল্লাহ অবশ্য ভুললেন না সাকিবের কথা। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শুরুতেই বললেন, 'সাকিব ব্যাটিং ও বোলিং দুই বিভাগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ও দেখিয়েছে, দলে তাকে কতটা প্রয়োজন।'

সিরিজে ২-০ তো হলো। এবার কি লক্ষ্য সিরিজ জয়? সরাসরি জবাব না দিলেও রিয়াদ যখন বলেন, 'আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ এগোতে চাই', মানেটা আপনি সহজেই অনুবাদ করে নিতে পারেন।

আরও পড়ুন:

ধ্রুবতারা হতে পারবেন আফিফ?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×