আক্ষেপের নাম সোহাগ গাজী

উৎপল শুভ্র

৫ আগস্ট ২০২১

আক্ষেপের নাম সোহাগ গাজী

এই বলেই সোহাগ গাজীর ইতিহাস। ছবি: এএফপি

টেস্ট অভিষেকেই পেয়েছিলেন ৯ উইকেট। পরে তো গড়েছেন একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিকের অদ্বিতীয় কীর্তিও। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যা করেছেন আরও, মাইক প্রোক্টর ছাড়া আর কেউ যা একাধিকবার করতে পারেননি। সেই সোহাগ গাজী কোথায়-কীভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন, তা এক অনন্ত আক্ষেপের গল্প।

সবচেয়ে ভালো কী হতে পারে? অবশ্যই উইকেট। সবচেয়ে খারাপ? বড় জোর ছক্কা, এই তো! এমনিতে ধুকপুক করা হৃদপিন্ড বুকে তখন ড্রাম বাজাচ্ছে। মনে চলছে সবচেয়ে ভালো আর সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কাটাকুটি খেলা! টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটি করতে যাচ্ছেন বোলার। দর্শকও একটু নড়েচড়ে বসেছেন। হয়তো আগেই বোলারের নাম শুনেছেন, হয়তো শোনেনইনি। তাতে কি আসে যায়! টেস্ট ক্রিকেটে কোনো বোলারের প্রথম বলটি নিয়ে বাড়তি একটু আগ্রহ থাকেই। বেশির ভাগ সময় তাতে বলার মতো কিছুই হয় না। বোলার ছাড়া আর কারও হয়তো একটু পরে মনেই থাকে না, বলটিতে কী হয়েছিল। প্রথম বলেই উইকেট পেয়ে গেলে অবশ্যই মনে থাকে। ছক্কা খেয়ে গেলেও।

রেকর্ড বইয়ে প্রথম বলেই উইকেটের বিস্তারিত সব লেখা আছে। কিন্তু প্রথম বলেই ছক্কার নেই। একটু ভুল হলো। একটা ছক্কার আছে। কারণ সেটি শুধু অভিষিক্ত বোলারেরই প্রথম বল ছিল না, ছিল টেস্টেরও প্রথম বল। ম্যাচের প্রথম বলেই ছক্কা এই একবারই দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। প্রথম বলটিতেই তাই ইতিহাস হয়ে গেছেন সোহাগ গাজী।

ক্রিস গেইল ছক্কা মেরে দেওয়ার আগেই ইতিহাস নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেটি সোহাগ গাজীর হাতে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বল তুলে দেওয়ার পরই। কী আশ্চর্য, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটিই করছেন কিনা এই টেস্টেই অভিষিক্ত একজন স্পিনার! এর আগে হয়েছে এমন? খুঁজতে খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয়েছে এক শ বছরেরও বেশি। অবশেষে যা পাওয়া গেছে ১৯০৯ সালে গিয়ে। এই তো, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওভাল টেস্টের প্রথম বলটি করেছিলেন অভিষিক্ত ইংলিশ লেগ স্পিনার ডগলাস কার।

২০১২ সালের নভেম্বরে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হকচকিয়ে দেওয়া এমন একটা শুরুর পরও সগৌরবে ফিরে এসেছিলেন সোহাগ গাজী। প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে আরেকটি ছক্কা খেয়েছেন। দুটি লেগ বাইসহ সেই ওভারে রান উঠেছে ১৮। নিজের তৃতীয় ওভারে গেইলকে আউট করে শেষ হাসিটা সোহাগই হেসেছেন। পরে তো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনারকে তাঁর 'বানি'-ই বানিয়ে ফেলেছেন। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে উইকেট পাওয়ার পর মাশরাফি আলিঙ্গনে বেঁধেছেন সোহাগ গাজীকে, কিন্তু ঝরে পড়া থেকে বাঁচাতে পারলেন কই! ছবি: এএফপি

টেস্ট-ওয়ানডে-বিপিএল সবখানে মাঠে সোহাগ গাজীর 'অত্যাচার' আর প্রেস কনফারেন্সে এ নিয়ে প্রশ্ন শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত গেইলের মেজাজ হারিয়ে ফেলার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। বিপিএলের একটা ম্যাচের পরই তো মনে হয়, 'গাজী, গাজী, গাজী...এক কথা আর কত' বলে তাঁর বিস্ফোরিত হওয়া! প্রথম বলে ছক্কা খাওয়ার পর গেইলকে আউট করার কারণেই শুধু স্মরণীয় হয়ে নেই সোহাগ গাজীর অভিষেক টেস্ট। এর চেয়ে বড় কারণও আছে। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬। টেস্ট অভিষেকে বাংলাদেশের কোনো বোলারের সেরা বোলিংয়ের সেই রেকর্ড এখনো ভাঙেনি।

এটি তো শুধুই বাংলাদেশের রেকর্ড। অনেকের তা মনেও থাকে না। সোহাগ গাজীর আসল রেকর্ড তো অন্য। বিশ্ব ক্রিকেটকে সচকিত করে তোলা সেই রেকর্ড। কত বড় বড় অলরাউন্ডার দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট, তাঁদের কেউ যা করতে পারেননি, ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে সেটিই করে ফেলেন সোহাগ। একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিক! 

সপ্তম টেস্টে অভূতপূর্ব এই কীর্তি গড়ার পর কোথায় সত্যিকার এক অলরাউন্ডার হয়ে উঠবেন, তা না, উল্টো যেন হারিয়ে যেতে লাগলেন সোহাগ। এরপর খেলেছেন আর মাত্র তিনটি টেস্ট। সর্বশেষটি প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে। মেহেদী হাসান মিরাজের পর নাঈম হাসানেরও আবির্ভাবে এক রকম নিশ্চিতই হয়ে গেছে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টটিকে এক সময় 'সর্বশেষ' থেকে 'শেষ' লিখতে হবে। শেষটাও তাহলে তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তির সাক্ষী চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামেই!

ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবে। চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের ওই অনন্য 'ডাবল' তো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর দ্বিতীয়। এর আগে জাতীয় লিগেও তা করেছেন একবার। দক্ষিণ আফ্রিকার মাইক প্রোক্টর ছাড়া আর কেউ যা দুবার করতে পারেননি। ১০ টেস্ট আর ২০ ওয়ানডেতেই সোহাগ গাজীর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলে সেটি তাই বড় আফসোস হয়ে থাকবে। টেস্টের পর ওয়ানডেতেও কী দারুণ শুরু! ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই সফরেই খুলনায় ২৯ রানে ৪ উইকেট ছিল অভিষেকে কোনো অফ স্পিনারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। পরপর দুই ওভারে গেইল আর স্যামুয়েলসকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশের জয়ের ভিতটাও তাঁর হাতেই গড়া। ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফিটা ছিল সেটিরই স্বীকৃতি।

চট্টগ্রাম টেস্টে ওই অনন্য `ডাবল` ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সোহাগ গাজীর দ্বিতীয়। ছবি: এএফপি

দুই বছর পার হওয়ার আগেই সেই সোহাগ গাজী কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অপাংক্তেয় হয়ে পড়লেন, এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর সেভাবে খোঁজা হয়নি। ফিটনেস নিয়ে অমনোযোগী, অনুশীলনে অবহেলা...ছাড়া ছাড়া শোনা যাওয়া এ সব কথাই সত্যি হয়ে থাকলে মনে প্রশ্নটা জাগেই। তারকাখ্যাতির আলোতেই কি তাহলে ঝলসে গেছে তাঁর চোখ? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্ব রেকর্ড গড়া ওই সিরিজ শেষে ঈদ করতে পটুয়াখালীতে তাঁর বাড়িতে যাবেন। সেটি নিয়েই জাতীয় দৈনিকে লঞ্চের কেবিনে বসে থাকা সোহাগ গাজীর বড় একটা ছবি দিয়ে স্টোরি। যেখানে যাচ্ছেন, ঘিরে ধরছে মানুষ। এ সবেই কি মাথা ঘুরে গিয়েছিল?

সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের চট্টগ্রাম টেস্টের পর কথা বলে কিন্তু অন্যরকমই মনে হয়েছিল। হ্যাটট্রিক করেছিলেন টেস্টের শেষ দিনে। খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনেও এসেছেন। কিন্তু সেখানে এক-দুই লাইনের উত্তরে মন ভরেনি। সংবাদ সম্মেলনে বসেই তাই ঠিক করে ফেলেছি, সোহাগ গাজীর একটা একান্ত সাক্ষাৎকার নিতে হবে। নইলে এমন একটা রেকর্ডের প্রতি অবিচার করা হয়। সেটি কঠিন কিছু নয়। দুই দলই আগ্রাবাদ হোটেলে উঠেছে, আমিও তাই। সোহাগ গাজীর রুমও আমার ফ্লোরেই। তবে রুমে ঢুকে যাওয়ার আগেই তাঁকে ধরতে হবে, ডেডলাইনের তাড়ায় পরে আর সময় পাওয়া যাবে না।

মাঠ থেকে শশব্যস্ত হয়ে হোটেলে ফিরেই অবশ্য একটা দুঃসংবাদ পেলাম। একটু পরেই বাংলাদেশ দলের ঢাকা ফেরার ফ্লাইট। ক্রিকেটাররা হোটেলে এসেই বেরিয়ে যাবেন। সোহাগের রুম আমার রুমের দুটি কি তিনটি রুম পরে। আমি রুমের দরোজা খুলে তাই অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরই সেটির সামনে সোহাগ। ইন্টারভিউয়ের কথা বলতেই পূর্ব অনুমিত উত্তরটা পেলাম---হাতে একদম সময় নেই। এখনই বেরিয়ে যেতে হবে। 'আরে, দশ মিনিটে কিছু হবে না' বলে সোহাগের হাত ধরে রুমে এনে বসালাম। এমন তাড়াহুড়ো, তারপরও সংবাদ সম্মেলনে মুখচোরা সোহাগ ইন্টারভিউয়ে অনেক স্বতঃস্ফুর্ত। বাংলাদেশ দলে খেলার জন্য কত কষ্ট করেছেন, সেই বর্ণনা দিতে দিতে এক সময় বয়সভিত্তিক কোনো জাতীয় দলেই সুযোগ না পাওয়ার দুঃখের কথা বলছিলেন। আর বলেছিলেন, বন্ধুরা সবাই বাংলাদেশ দলের জার্সি পড়লেও তিনি কোনো দিন তা পরেননি। মনে একটা জেদ ছিল, নিজে জাতীয় দলে খেলেই সেই জার্সি পরবেন। স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার পর কি তাহলে সেই জেদটা হারিয়ে গিয়েছিল?

শুধু সোহাগ গাজীই দিতে পারেন এই প্রশ্নের উত্তর।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×