টম ল্যাথামকে কি ফোন করেছেন তাঁর বাবা?

উৎপল শুভ্র

৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

টম ল্যাথামকে কি ফোন করেছেন তাঁর বাবা?

একটুর জন্য! দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির পর টম ল্যাথাম

যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এর আগে টি-টোয়েন্টিতে জয় ছিল না, তাদের বিপক্ষে সপ্তাহখানেকের মধ্যে চার-চারটি জয়। যে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে এর আগে দশ ম্যাচের দশটিতেই হার, টানা দুটি হার ফিরিয়ে দেওয়া গেছে তাদের। দ্বিতীয় ম্যাচটা নিউজিল্যান্ডকে প্রায় জিতিয়ে দেওয়া টম ল্যাথামের বাবা কি ওই ম্যাচের উইকেট দেখে ফোন করেছেন ছেলেকে?

বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলা হলো যে উইকেটে, তা তো রীতিমতো ‘ব্যাটিং স্বর্গ’! এটা পড়ে যদি আপনার ভুরু কুঁচকে গিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, মিরপুরে এর আগের ৬টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আপনি দেখেননি। সর্বশেষ দুটি তো অবশ্যই নয়। যে দুটি ম্যাচ বিখ্যাত হয়ে গেছে তাসমান সাগরের দুই পারের দুই দেশের চরম অসহায়ত্বের সাক্ষী হিসেবে। অনেক বছর পরও যে দুই ম্যাচের কথা উঠলে কেউ না কেউ বলবে, কোন ম্যাচের কথা বলছেন, ‘৬২’-এর ম্যাচ না ‘৬০’-এর ম্যাচ? অস্ট্রেলিয়া বললে অংকটা  ‘৬২’ হবে, নিউজিল্যান্ড বললে ‘৬০’।

একটা কৌতূহল থেকে ওই দুই ম্যাচের চারটি ইনিংস যোগ করে দেখলাম। ৬০-৬২ মনে গুঞ্জরিত হওয়াতেই ওই কৌতূহল, ৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের একটা ম্যাচেই কি মিরপুরের আগের দুই ম্যাচের চেয়েও বেশি রান হয়ে গেল? তা অবশ্য হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার ‘৬২’-এর ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করে বাংলাদেশ ১২২ রান করে ফেলেছিল বলে ওই দুই ম্যাচের মোট রানসংখ্যা আজকের ম্যাচের রানের চেয়ে বেশিই থাকছে। তবে খুব বেশি নয়। মাত্র ২৪।

যে কারণে দ্বিতীয় ম্যাচের মিরপুরের উইকেটকে ‘ব্যাটিং স্বর্গ’ বলছি, একই কারণে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিটাকে ‘হাই-স্কোরিং’ বলে ফেলা যায়। গত মাসেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩১ করে বাংলাদেশের আরামে জেতার বিস্ময়টা পরের দুই ম্যাচেই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে কম স্কোর ডিফেন্ড করে বাংলাদেশের জয়ের রেকর্ডটা যে পরের দুই ম্যাচেই নেমে এসেছিল ১২৭ ও ১২১ রানে। সেখানে আজ বাংলাদেশ ১৪১ করে ফেলার পর নিউজিল্যান্ডের ১৩৭, শেষ ওভারের পঞ্চম বলে মোস্তাফিজুরের বিমার ৫ রান এবং একটা ফ্রি হিট উপহার দেওয়ার পর হঠাৎই নিউজিল্যান্ডের জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেওয়া, শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪ রানে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি...হাই-স্কোরিং ম্যাচই তো!

বাংলাদেশের জন্য অনেক `প্রথম`-এর আনন্দ নিয়ে এসেছে এই টি-টোয়েন্টি মৌসুম

লেখার প্রথম লাইনে ‘ব্যাটিং-স্বর্গ’ পড়ে যদি আপনার ভুরু কুঁচকে গিয়ে থাকে, তাহলে এখানে এসে আবারও তা দেখতে পাচ্ছি। ২৭৮ রানের টি-টোয়েন্টিকে বলছে হাই-স্কোরিং, এই লোকের মাথা ঠিক আছে তো! ভাই রে, মাথা ঠিকই আছে। তবে এই পৃথিবীতে সবই তো আসলে আপেক্ষিক। টি-টোয়েন্টির আধুনিক যুগে ১৭৫-১৮০ যে ‘পার’ স্কোরে পরিণত, ২০০ পেরিয়ে যাওয়াটাও এখন কোনো ব্যাপারই নয়, তা কি আর আমি জানি না! আগে যেখানে টু হান্ড্রেড প্লাস স্কোরগুলো মুখস্ত বলে দেওয়া যেত, এখন সেই তালিকাটা ইয়া লম্বা। যেখানে বাংলাদেশের নামও আছে তিনবার। সব জানা থাকার পরও ২৭৮ রানের ম্যাচকেই হাই-স্কোরিং মনে হওয়ার কারণ আগের ৭টি ম্যাচের হ্যাং ওভার। 

`ব্যাটিং-স্বর্গ` উইকেট বলেই তো লিটন-নাঈমের এমন ওপেনিং জুটি। `ব্যাটিং স্বর্গ` কথাটা অবশ্যই আপেক্ষিক

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টির এই ভরা মৌসুম অনেক ‘প্রথম’ উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এর আগে কোনো টি-টোয়েন্টিতে কোনো জয়ই ছিল না, এক সপ্তাহের মধ্যে সেই অস্ট্রেলিয়াকে চার-চারবার হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রেকর্ড তো ছিল আরও করুণ। ১০ ম্যাচ খেলে ১০টিতে হারই শুধু নয়, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের করুণতম তিনটি গল্পও কিউইদেরই লিখে দেওয়া। সর্বনিম্ন তিনটি স্কোরই তো এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই নিউজিল্যান্ডকে টানা দুই ম্যাচে হারিয়ে দেওয়া উৎসবের উপলক্ষ নয় তো কি! ৭৮-৭৬-৭০ রানের লজ্জাও যেখানে ‘৬০’ দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া গেছে।

নিউজিল্যান্ডের এই দলে বিশ্বকাপ দলের একজনও নেই, এটা মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আমি তা জানি। এটাও জানি যে, দ্বিতীয় ম্যাচটাকে শেষ বল পর্যন্ত অনিশ্চয়তার দোলায় দোলানো টম ল্যাথাম প্রায় চার বছর নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি দলে ব্রাত্য হয়ে ছিলেন। বায়ো বাবলের নতুন বাস্তবতায় ক্রিকেটারদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে একের পর এক ট্যুরের সমঝোতা করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট সেই 'ব্রাত্য' ক্রিকেটারকেই বাংলাদেশে অধিনায়ক করে পাঠিয়েছে। এর আগে টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতেও একই সুযোগ আসবে, কিছুদিন আগেও টম ল্যাথামের তা কল্পনা করারও কথা নয়। 

প্রায় চার বছর টি-টোয়েন্টিতে ব্রাত্য হয়ে থাকা টম ল্যাথাম তালেগোলে হয়ে গেছেন নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক

টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকটা দুঃস্বপ্নের মতো হলেও দ্বিতীয় ম্যাচটা তো একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন প্রায়। প্রথম ম্যাচটা যে উইকেটে হয়েছে, এমন উইকেটে নিশ্চিতভাবেই আগে কখনো খেলেননি টম ল্যাথাম। তবে দ্বিতীয় ম্যাচের উইকেট নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের আরেক 'ল্যাথাম'-কে পুরোনো একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই পারে। সেই ল্যাথামের পুরো নাম রড ল্যাথাম। নিউজিল্যান্ডের সাবেক ওপেনার। সম্পর্কে টম ল্যাথামের বাবা।

অস্ট্রেলিয়া সিরিজ অস্ট্রেলিয়ায় সম্প্রচারিত হয়নি। তবে নিউজিল্যান্ড সিরিজ হচ্ছে। ম্যাচ শুরুর সময় দুই ঘণ্টা এগিয়ে আনাও এ কারণেই। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের মতো সন্ধ্যা ৬টায় খেলা শুরু হলে নিউজিল্যান্ডে তখন বাজত রাত ১টা। এখন যা রাত ১১টায় শুরু হয়ে যাচ্ছে। ছেলে অধিনায়কত্ব করছে, রড ল্যাথাম নিশ্চয়ই খেলা দেখছেন। দেখতে দেখতে ১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা তাঁর মনে পড়তেই পারে। সেই বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর টম ল্যাথামের জন্ম। তবে বাবা তাঁকে সেই গল্প না শুনিয়ে পারেনই না। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে যৌথভাবে আয়োজিত সেই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড সব ম্যাচই খেলেছিল নিজেদের দেশে। তখন বিশ্বকাপের উইকেটেও হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার সুযোগ ছিল, কারণ তা তৈরির দায়িত্ব থাকত স্বাগতিক দেশের ওপরই। সেই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন অকাল প্রয়াত মার্টিন ক্রো। তাঁর মাথা থেকেই বৈপ্লবিক কিছু ধারণা এসেছিল। যার একটা ছিল, অফ স্পিনার দিয়ে বোলিং আক্রমণ শুরু করা। আরেকটা স্লো লো উইকেট বানিয়ে শুধু স্পিনার আর স্লো মিডিয়াম পেসারদের দিয়ে বোলিং করানো। এই স্ট্র্যাটেজির সফল রূপায়ণ করেই সব ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। দলের সবচেয়ে গতিময় বোলার ড্যানি মরিসনকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, ক্রিস কেয়ার্নসেরও নিয়মিত খেলা হয়নি বলে বেশি গতি থাকার 'অপরাধে'। এর বদলে বোলিং আক্রমণ সাজানো হয়েছিল ডিবলি-ডবলি-উইবলি-উবলিকে দিয়ে। এ আবার কেমন ধারা নাম? 

বাবা রড ল্যাথামের সঙ্গে টম ল্যাথাম। ছবি: ব্ল্যাকক্যাপস্

নামগুলো ছিল আসলে গ্যাভিন লারসেন, ক্রিস হ্যারিস, উইলি ওয়াটসন ও রড ল্যাথাম। যাঁদের রান আপ ও বোলিং দেখে টিভি কমেন্ট্রিতে এমন নাম দিয়েছিলেন ডেভিড লয়েড। চার বোলারের নাম যদি ভালোমতো পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন এর সঙ্গে টম ল্যাথামের কী সম্পর্ক। ওই বোলার চতুষ্টয়ের একজন, 'উবলি'-ই তো তাঁর বাবা।

সেই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের উইকেটের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে মিরপুরের উইকেটের অনেক মিল। বেন সিয়ার্সকে অভিষেকে মাত্র এক ওভারের বেশি বোলিং না করানোতেও যেমন আমি মিল খুঁজে পেলাম। ১১ রান দিয়েছেন তো মূলত বলে বেশি গতি থাকার 'অপরাধেই'। এমন উইকেটে বলে বেশি গতি মানেই ব্যাটসম্যানদের মারার সুযোগ করে দেওয়া। কে জানে, রড ল্যাথাম এরই মধ্যে ছেলেকে ফোন করে পরের ম্যাচে 'ডিবলি-ডবলি-উইবলি-উবলি'কে নিয়ে নামতে বলে দিয়েছেন কি না!     

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×