২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

এই সপ্তাহটা ওমানের...

উৎপলশুভ্রডটকম

১৫ অক্টোবর ২০২১

এই সপ্তাহটা ওমানের...

শুধু বিশ্বকাপ আয়োজন করেই নয়, মাঠের খেলাতেও স্মরণীয় পারফরম্যান্স উপহার দিতে চায় ওমান

শারজাহর ছিল আব্দুল রহমান বুখাতির। ওমানের আছেন পঙ্কজ খিমজি। যে দেশের মানুষের ক্রিকেট দেখার বা খেলার তেমন আগ্রহ নেই বলতে গেলে সেই দেশে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসছে। কংক্রিট থেকে সবুজ ঘাসের উইকেটে ওমানকে নিয়ে যাওয়ায় পঙ্কজের অনন্য অবদান। ওমান ক্রিকেট মানচিত্রে জায়গা করে নিচ্ছে মাঠের বাইরের তৎপরতাকেও। বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া ওমানের গল্পটা বেশ রেমাঞ্চকর।

লর্ডস, ইডেন গার্ডেনস কিংবা এমসিজি নয়! ওইসব বিখ্যাত স্টেডিয়াম থেকে বেশ দূরের দেশ ওমানের আল আমিরাত স্টেডিয়ামে ১৭ অক্টোবর পর্দা উঠছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ছয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে এই মাঠে। তাই আগামী এক সপ্তাহের জন্য হলেও ক্রিকেট বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে ওমান।

অথচ ২০১৬ সালেও এই ওমান আইসিসির পঞ্চম বিভাগে ক্রিকেট খেলতো। শুধু কি তাই! মাত্র এক যুগ আগেও দেশটির ওমানের ছিল না কোনো ঘাসের উইকেট। ছিল কংক্রিটের রাজত্ব। ধূ ধূ  মরুভূমি থেকে বিশ্বকাপের সবুজ গালিচা কিংবা পঞ্চম বিভাগ ক্রিকেট থেকে ক্রিকেট বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে আসার পুরো গল্পটাই এক স্মরণীয় বিবর্তন। আর এই বিবর্তনের স্বপ্নদ্রষ্টা ওমান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পঙ্কজ খিমজি। স্বপ্নটা যে শুধু তার সে কথা বললে হয়তো ভুল হবে, মূলত স্বপ্নটা তাঁর বাবার।বিজয় উদযাপনে পঙ্কজ খিমাজিকে কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন ওমানের ক্রিকেটাররা। তাঁর কাঁধে ভর করেই তো এগিয়ে যাচ্ছে ওমানের ক্রিকেট

আর এই স্বপ্নপূরণের জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিটাও শেষ। যদিও ওমান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়্যারমান পঙ্কজ খিমজির দাবি অবকাঠামো কিংবা অন্যান্য সার্বিক প্রস্তুতির চেয়ে মাঠের খেলা নিয়ে বেশি চিন্তিত তিনি। ওমান ক্রিকেট দলকে তিনি দ্বিতীয় পর্বে দেখতে চান।

তিনি জানান, স্টার স্পোর্টসের দেওয়া তথ্যমতে এটি হতে পারে সর্বকালের তৃতীয় বৃহত্তম টেলিভিশন ক্রীড়া ইভেন্ট যা সম্ভবত ৩ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাবে। ওমানে অনুষ্ঠিত ৬টি খেলা যদি ১ বিলিয়ন মানুষের কাছেও পৌঁছে যায় সেটাও দেশটির ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় কিছু।

ক্রিকেটে ওমানের যাত্রা ততটা সহজ ছিল না। এক সময় ওমানের ক্রিকেটাররা যেকোনো টু্র্নামেন্টের ৫ থেকে ৭ দিন আগে একত্রিত হত। এমনকি তাদের কোনো কোচও ছিল না। সামান্য কয়েকদিন নেট প্রাকটিস করেই নেমে পড়ত মাঠে। ফলাফল প্রতি ম্যাচেই লজ্জাজনক হার। প্রতিপক্ষের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।

তবে এভাবে বেশিদিন চলতে দেয়নি তারা। তারা জানতো ভালো করতে হলে সবার আগে দরকার ভালো মাঠ। সেজন্য ওমানের ক্রিকেট কর্তারা সেদেশের ক্রীড়া মন্ত্রীর কাছে মাঠ তৈরীর জন্য জায়গা চায়। ক্রীড়া মন্ত্রীও তাতে সাড়া দেন। মাসকট থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে ছোট শহর আল আমিরাতে তাদের ৭০,০০০ বর্গফুটের একটা প্লট দেওয়া হয়।

পাকিস্তানি দুজন চালকের সহায়তায় জেসিবি আর বুলডোজার দিয়ে মাঠকে সমতল করা হয়। যাতে খরচ হয়েছিল ১০ হাজার রিয়াল বা ২৬ হাজার ডলার।

শুরুতে ড্রেসিংরুমটা ছিল অস্থায়ী। শারজাহ ক্রিকেট মাঠের গ্রাউন্ডসম্যান যিনি এক দশক আগে অবসরে গিয়েছিলেন তাঁকে করাচি থেকে এনে আবার একই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাসকট উপকূল থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে বারখার খিমজি ফ্যামিলি ফার্মে প্রথমে একটা পিচ তৈরি করা হয়। প্রথম সারির খেলোয়াড়রা সেখানে সপ্তাহে তিন দিন অনুশীলন করত। তবে ২০১২-১৩ মৌসুমে আমিরাতের মাঠে ঘাস গজাতে শুরু করে।বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ওমান দল। ছবি: ওমান ক্রিকেট

প্রতিকূলতা এখনো মাঠ ও মাঠের বাইরে। ওমানের স্থায়ী বাসিন্দাদের ক্রিকেটের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। বিশ্বকাপের ১৫ সদস্যের ওমান দলে ১৪ জনই প্রবাসী। শুধুমাত্র সুফিয়ান মেহমুদই ওমান বংশোদ্ভূত।যারা আছেন তারাও পুরোপুরি পেশাদার নন।

উত্থান পতন অব্যাহত ছিল মাঠের ক্রিকেটেও। আন্তর্জাতিক টি -টোয়েন্টি খেলার ৬ বছরে ওমান খেলেছে ৩৬টি ম্যাচ। এর হার ১৯টিতে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আশা জাগানিয়া দু’টি জয় পেলেও তার  মাহাত্ম্য আবার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে ঘরের মাঠে কাতারের বিপক্ষে হারে।

তাছাড়া ২০১৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে ঘরের মাঠে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ২৪ রানে অলআউট হয় ওমান। ৬ জন ব্যাটসমানই প্যাভিলিয়নে ফেরেন শূন্য হাতে।

তবে মাঠের বাজে পারফরম্যান্সের চেয়েও ওমান ক্রিকেটের জন্য বড় ধাক্কা ছিল ওমানের সাবেক ক্রিকেটার  ইউসুফ আব্দুল রহিম আল-বালুশিকে দুর্নীতির চারটি অপরাধে দেওয়া সাত বছরের নিষেধাজ্ঞা। যা ওমান ক্রিকেটের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানে।

এত ওঠা-নামার পরও ওমান ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেন কোচ দিলিপ মেন্ডিস। মেন্ডিস শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের ম্যানজার। সাবেক এই ক্রিকেটার এখন ওমান জাতীয় দলের কোচ। তাঁর মতে, গত বিশ্বকাপেই খেলাটাই ছিল ওমানের জন্য বাজিমাত। আর এবার  তো বিশ্বকাপ ঘরের মাঠে। লক্ষ্য তাই আরও বড়। গ্রুপে থাকা বাংলাদেশ, স্কটল্যান্ড ও পাপুয়া নিউ গিনিকে টক্কর দিতে মুখিয়ে তারা।

মূল পর্ব বা শেষ বারোতে দল খেলবে বলে আশাবাদী মেন্ডিস। ‘আমাদের মূল শক্তির জায়গা ব্যাটিং হলেও বোলাররাই আসল কাজটা করছে। পাশাপাশি আমাদের দলে ৪-৫ জন ভালো অলরাউন্ডারও রয়েছে যা দলকে করেছে ভারসাম্যপূর্ণ।’ মেন্ডিস বলেছেন, ‘আমাদের  পেস অ্যাটাককে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর মাঝে সেরা মনে করি আমি। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে আমি খুব আত্মবিশ্বাসী'।

পঙ্কজ খিমজি ওমানের ক্রিকেটের সঙ্গে মেন্ডিসের মনেও দাগ কেটেছেন। মেন্ডিসের কাছেই শুনুন তা। ‘ওমানের সাথে ১০ বছর ধরে কাজ করছি শুধুমাত্র ওমানের মানুষ, বোর্ড এবং বিশেষত পঙ্কজের জন্য। তারা সবাই খুব সরল মনের এবং উৎসাহী মানুষ।’ মেন্ডিস জানান, ‘আমরা সবাই মিলে ওমান ক্রিকেটকে সামনে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।’

সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য বিশ্বকাপ তো অনেক বড় মঞ্চ। খেলোয়াড়রা খেলবেন মাঠে। তবে মাঠের বাইরের চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে পঙ্কজ খিমজিকেও। আবদুল রহমান বুখাতির যেমন মরুর বুকের শারজাহকে  ক্রিকেট বিশ্বের এক অনন্য নামে পরিণত করেছেন, তেমনি আল আমিরাতকেও ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে আরো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে পঙ্কজ খিমজিকে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×