এবার বোধ হয় স্বপ্নটা `চেঞ্জ` করতেই হচ্ছে!

উৎপল শুভ্র
২৮ অক্টোবর ২০২১
সুপার টুয়েলভে টানা দ্বিতীয় পরাজয়ে সেমিফাইনালের স্বপ্ন এখন বিবর্ণ, এটা বলতে হলেও অনেক বড় আশাবাদী হতে হয়। মাসকাটে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের যৌক্তিক একটা প্রশ্নের জবাবে সাকিব আল হাসান ‘স্বপ্ন কি প্রতিদিন চেঞ্জ হওয়ার জিনিস’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। তবে তা মনে হয় এখন চেঞ্জ করতেই হচ্ছে।
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১২৪/৯। ইংল্যান্ড: ১৪.১ ওভারে ১২৬/২। ফল: ইংল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুই দলের প্রথম দেখা। শুধু বিশ্বকাপে কেন, বিস্ময়করভাবে টি-টোয়েন্টিতেই। প্রথম ওয়ানডে সেই ২০০০ সালে। ২০০৩ সালে প্রথম টেস্ট। ওয়ানডে-টেস্ট মিলিয়ে ২১ বছরে ৩১টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড, বিস্ময়করভাবে যার একটিও টি-টোয়েন্টি নয়। সেজন্য কি না ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণের বয়স ১৬ বছর আট মাস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো!
সেই প্রথম দেখাটা যে সম্ভব হলে রেকর্ড বই থেকে মুছে দিত বাংলাদেশ, মনে হয় না সেটি আপনাকে আমার কাছ থেকে জানতে হবে। মাত্র ১২৪ রানে আটকে গিয়ে ৮ উইকেটে পরাজয়, সেটিও প্রায় ৬ ওভার বাকি থাকতেই…এসবও লেখার শুরুতে সংক্ষিপ্ত স্কোর দেখে প্রথম জেনেছেন বলে মনে হয় না। পুরো খেলা দেখে না থাকলেও কোনো না কোনোভাবে নির্ঘাত তা আপনার কানে পৌঁছে গেছে। পুরো খেলা না দেখার কথাটা বুঝেই বলা। রেজাল্টের ব্যাপারে এমন নিঃসন্দেহ হয়ে গেলে আর খেলা দেখতে ইচ্ছা করে নাকি! অনেকে মনে হয় দেখেনওনি।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে জয়ের প্রবল সম্ভাবনা জাগিয়েও হেরে যাওয়ার আফসোস ছিল। এদিন আর সেসব ঝামেলা নেই। ম্যাচ শুরু হতে না হতেই শেষ। নির্দিষ্ট করে বললে পাওয়ার প্লে-তেই। যাতে ৩ উইকেট হারিয়ে মাত্র ২৭ রান বাংলাদেশকে ‘পাওয়ারলেস’ করে দিয়ে গেল। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ মনে রেখে এমন বলছি বটে, কিন্তু পাওয়ার প্লে এমন উল্টো রূপে দেখা দেওয়া তো বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কখনো সাকিব, কখনো মুশফিক, কখনো বা মাহমুদউল্লাহ উদ্ধারকর্তা হয়ে দাাঁড়িয়ে গেছেন। এই ম্যাচের আগে আবার টি-টোয়েন্টিতে অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ওঠার সুখবর পাওয়া সাকিব আজ উদ্ধার করবেন কি, পাওয়ার প্লের তৃতীয় উইকেটটা তো তাঁরই।
পাঁচ বা এর নিচে ব্যাটিং করেও পাওয়ার প্লেতে নামতে হওয়াটা মাহমুদউল্লাহর এত দিনে অভ্যাসই হয়ে যাওয়ার কথা। এদিন নামলেন ১৫তম বারের মতো, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে যা সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার কে নেমেছেন জানি না, তবে এটা অনুমান করতে কোনোই সমস্যা হচ্ছে না, যে-ই হোন না কেন, তিনি অনেক ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়।
আগের ১৪ বারে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং গড় ২৮.১৫। ইংল্যান্ডকে একটু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হলেও সেই গড় পারফরম্যান্সকে আজ ছাড়িয়ে যেতে হতো অধিনায়ককে। যেখানে মাহমুদউল্লাহ করতে পারলেন মাত্র ১৯। মাঝখানে মুশফিক রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লু হয়েছেন। রান আউট হয়েছেন আফিফ। মাহমুদউল্লাহর বিদায়ে স্কোরবোর্ডে তখন ৬ উইকেটে ৮৩। ইংল্যান্ডের এই বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষে এরপর ১২৪-ই তো অনেক।
মঈন আলীর প্রথম ওভারে দুটি চার মেরে সব সমালোচনাকে ব্যাট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞাই যেন ঘোষণা করেছিলেন লিটন। ইংলিশ অফ স্পিনারের পরের ওভারে যা ৯ রানেই শেষ। পরের বলে নাঈমকেও তুলে নিয়ে মঈন আলী হ্যাটট্রিকের সামনে। বোলারের যেমন হ্যাট্রটিকের সম্ভাবনা জেগেছিল, তেমনি রান আউটেরও।

কোনোটাই হয়নি, তবে তাতে কোনো ইতরবিশেষ হয়নি। বাংলাদেশের ইনিংস সেই ধুঁকতে ধুঁকতেই এগিয়েছে। টসে জিতে মাহমুদউল্লাহর প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হয়তো একটাই। কারণটাকে ভয়ও বলতে পারেন। ইংল্যান্ডের হাতে প্রথম ব্যাট তুলে দিলে তাদের পাওয়ার হিটাররা এক ইনিংসেই না ম্যাচ শেষ করে দেয়! ভালো একটা স্কোর করলে যেখানে তাদের একটু চাপে ফেলা যাবে। বাংলাদেশের বোলিং কোচ ওটিস গিবসন এই ম্যাচের আগে এমন কিছু বলেই তো ভরসা দিতে চেয়েছিলেন বোলারদের। ইংলিশ বিগ হিটাররা ইচ্ছামতো মারে, তবে মারতে গিয়ে সুযোগও দেয়।
ঝুঁকি নিয়েও মারতে বাধ্য করতে মোটামুটি একটা স্কোরেও কাজ হতো না। বড় একটা স্কোর লাগত। বাংলাদেশের ইনিংসের শুরু থেকেই তাই ইতিবাচকতার একটা বার্তা ছিল। তাতে গিবসনের থিওরিটাই উল্টো অর্থে সত্যি প্রমাণিত হলো। তাতে যা হলো, স্বপ্নটা মনে হয় এখন বদলাতেই হচ্ছে। কোন স্বপ্ন? ওই যে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে সেমিফাইনাল খেলার যে স্বপ্নের কথা শুনিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল।

সুপার টুয়েলভে টানা দ্বিতীয় পরাজয়ে সেই স্বপ্ন এখন বিবর্ণ, এটা বলতে হলেও অনেক বড় আশাবাদী হতে হয়। মানে বিবর্ণ বললেও তো সেটির অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় আগে। মাসকাটে এক সাংবাদিকের এ সম্পর্কিত যৌক্তিক একটা প্রশ্নের জবাবে সাকিব আল হাসান ‘স্বপ্ন কি প্রতিদিন চেঞ্জ হওয়ার জিনিস’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। তবে এখন মনে হয়, স্বপ্নটা চেঞ্জ করতেই হচ্ছে। বাকি তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। এই তিন ম্যাচেই জিতলেও যেখানে সেমিফাইনাল নিশ্চিত নয়; সেখানে দুটি জয়ের আশা করতেই তো রীতিমতো ভয় করছে। একটা জয় পাওয়াটাকেও কি 'স্বপ্ন' বলে মনে হচ্ছে না কখনো কখনো!
খুব বাজেভাবে কোনো ম্যাচ হারলে এমনই মনে হয়। বিশেষ করে এমন ম্যাচ, যেটি প্রায় শুরু থেকেই জয়-পরাজয় নিয়ে সব সংশয় দূর করে দিয়ে সামনে এগোয়। নইলে বাকি তিন ম্যাচের প্রতিপক্ষের অন্তত দুটির বিপক্ষে তো বাংলাদেশের সুখস্মৃতি আছে। ‘বড়’ দলগুলোর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ৫টি জয়। প্রথম দেখাতেই জয় পাওয়ার সুখস্মৃতিও শুধু এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই উপহার। সেটি এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই। ২০০৭ সালে জোহানেসবার্গে যে জয় এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশের একমাত্র জয়ও হয়ে আছে। আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাফল্যের স্মৃতি তো একেবারেই টাটকা। গত আগস্টে মিরপুরে ৪-১ ম্যাচে সিরিজ জয় বাংলাদেশকে বেশি অনুপ্রাণিত করবে, নাকি অস্ট্রেলিয়াকে আরও তাতিয়ে তুলবে, এটাই হলো প্রশ্ন।
আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের তো তেতে ওঠার জন্য বাড়তি কিছু লাগছে না। বাংলাদেশের মতোই টানা দুই ম্যাচে হেরে দুবারের চ্যাম্পিয়নদের পিঠ এমনিতেই দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। বাকি তিন ম্যাচ নিয়ে যদি আশা করতে চান, নিজ দায়িত্বে করাই ভালো।









