২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

বাটলারের এক সেঞ্চুরিতে যেন দুই `ইনিংস`!

রিজওয়ান রেহমান সাদিদ

২ নভেম্বর ২০২১

বাটলারের এক সেঞ্চুরিতে যেন দুই `ইনিংস`!

জস বাটলার: স্পেশাল এক সেঞ্চুরি

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি, সেই সেঞ্চুরিও কোনো সাধারণ সেঞ্চুরি নয়। শারজার স্লো-লো টার্নিং উইকেটেও এমন ঝড় তোলা যায়, সেটির প্রমাণও জস বাটলারের এই সেঞ্চুরি। যেটিতে আবার বিপরীতধর্মী ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী। প্রথম ফিফটিটা যদি হয় উইকেটের চরিত্র বুঝে ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি, দ্বিতীয় ফিফটিতে এসবের থোড়াই কেয়ার করার দুঃসাহস। সব মিলিয়েই বাটলারের এই সেঞ্চুরি `ভেরি ভেরি স্পেশাল`।

হিদার নাইট বলছেন 'অবিশ্বাস্য', ধারাভাষ্যকাররা খানিকক্ষণ পরপরই ফেরত গেলেন ওই ইনিংসের স্তুতি গাইতে। অধিনায়ককে একটু রয়ে সয়ে প্রশংসা করতে হয় বলেই বোধ হয় এউইন মরগান, সেরা বলার আগে লাগালেন 'অন্যতম' বিশেষণ। কিন্তু অন্যতম বিশেষণটা যে এই দিনে বাহুল্য ছাড়া কিছু নয়, সেটা তো জানা হয়ে গিয়েছিল ম্যাচের মাঝপথেই। ইংল্যান্ডের ফিল্ডিং কোচ পল কলিংউড তো বলেই গিয়েছিলেন,  'বল ব্যাটে আসছিল না, ক্রস-ব্যাটে শট খেলা যাচ্ছিল না, পিচটা বেশ মন্থর, বাউন্সটাও অসমান… জস বাটলারের ইনিংসটা এসব কারণেই ভেরি ভেরি স্পেশাল।'

তা কী এমন ইনিংস খেলেছেন বাটলার যে, 'অন্যতম সেরা' বললেও কম বলা হয়ে যাচ্ছে? তেমন কিছু না, ৪৫ বলে হাফ সেঞ্চুরির পরে ৬৭ বলে একটা সেঞ্চুরি করেছেন। আর সেটা করেছেন শারজার উইকেটে, ছোট বাউন্ডারি সত্ত্বেও যে উইকেটে এবারকার আইপিএলে রান উঠেছে ওভারপ্রতি ৭ করে। প্রথম ১০ ওভারে ৪৭ রান করার পরও শেষ ১০ ওভারে ১১৬ তুলে রানটাকে যে শ্রীলঙ্কার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারল ইংল্যান্ড, সেটার কারণও ওই বাটলার।

বাটলার বলেই হয়তো তা এমন কোনো বিস্ময়ের কারণ নয়। ইংল্যান্ড যে লোয়ার মিডল-অর্ডার থেকে প্রমোশন দিয়ে ওপেনিংয়ে তুলে এনেছে তাঁকে, তার কারণ তো এটাই, 'দলের সেরা ব্যাটসম্যানকে যত বেশি সম্ভব ব্যাটিং করার সুযোগ দেওয়া'। বাটলার যে সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন ভালোই, তার প্রমাণ পেতে দুটি সংখ্যা জানলেই চলছে। গড় ৬০.৫০, স্ট্রাইক রেট ১৪৯.১৭...ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে শুরু করার পর বাটলারের পরিসংখ্যান এমনই অবিশ্বাস্য।

তবুও যে আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাটলারের এদিনের ইনিংস, তার কারণ, এই টি-টোয়েন্টি সংস্করণেও ব্যাটসম্যানশিপের পরীক্ষাতে নামতে হয়েছে তাঁকে। এক ইনিংসের মাঝেই কখনো 'অ্যাংকর' হয়ে, কখনো বা 'পাওয়ার হিটিং'য়ে তাঁকে প্রমাণ করতে হয়েছে নিজেরই বলা 'আমি সব জায়গাতেই ভালো' কথার সার্থকতাও।বলের ঠিকানা কোথায়? ছবি: গেটি ইমেজেস

সেই প্রমাণের পরীক্ষাতে যে লেটার-মার্কস পেয়েই উত্তীর্ণ, সেটা বোধ হয় না বললেও চলছে। কিভাবে উত্তীর্ণ হলেন, সেটাই বরং বিশ্লেষণ করা যাক এখানে। শুরুটা বাটলার-সুলভই হয়েছিল। প্রথম বলেই ৩, প্রথম বাউন্ডারি পঞ্চম বলে, প্রথম ১০ বল শেষে ১৫। তিন ওভার শেষেই ইংল্যান্ড তুলে ফেলেছিল ২৫। এই ইংল্যান্ড রানের পাগলা ঘোড়া ছোটাতে শুরু করলে আর নিস্তার নাই  বুঝতে পেরেই শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দাসুন শানাকা আক্রমণে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর দুই বাজির ঘোড়া, মহিশ থিকশানা আর ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে। হাসারাঙ্গা প্রতিদানও দিতেও দেরি করেননি। জেসন রয় আর জনি বেয়ারেস্টো ফিরেছিলেন হাসারাঙ্গার বলে, মাঝে মালানকে ফিরিয়েছিলেন চামিরাও। পাওয়ার-প্লেতে ৩৬ রানে তুলতেই ইংল্যান্ড হারিয়ে ফেলেছে ৩ উইকেট। এবারের বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে আগে ব্যাট করে জয় পাওয়ার উদাহরণ মাত্র তিনটি (ওই ম্যাচগুলোতে পরাজিত তিন দলের নাম স্কটল্যান্ড, নামিবিয়া আর বাংলাদেশ), রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশির বাড়ার শঙ্কা, ইংল্যান্ড তাই ম্যাচ হারের ভয় না পেয়ে পারেই না তখন।

ভয় ছিল আরও। অধিনায়ক এউইন মরগান ফর্মে ছিলেন না গোটা আইপিএল-জুড়েই, আইপিএলে ৫ ম্যাচ খেলে মাত্র ৪২ রান করেছেন লিয়াম লিভিংস্টোন। মিডল-অর্ডারকে পরীক্ষায় নামতে হয়নি আগের তিন ম্যাচেও। দলকে অন্তত লড়াই করার মতো সংগ্রহ এনে দিতে বাটলারের তখন তাই খোলসে ঢুকে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কোনো। চতুর্থ থেকে দশম, এই সাত ওভারে ইংল্যান্ড ওভারপ্রতি পাঁচের বেশি রান তুলতে পারেনি একবারও। ওই সময়টায় বাটলার ১৬ বল খেলে করেছেন ৮ রান। 'রাহু ধৈর্য, রাই ধৈর্যং' শাস্ত্রবচন মেনে ৩০ বল খেলে বাটলারের রান ২৪।ব্যাট তাঁর যেন ধারালো তলোয়ার ছবি: গেটি ইমেজেস

এমনিতেই লেগ স্পিনের বিপক্ষে বাটলারের সমস্যা বোঝা যায় পরিসংখ্যানে তাকালেই। ক্যারিয়ার স্ট্রাইক-রেট যেখানে ১৪৪.০৪, লেগ স্পিনের বিপক্ষে সেটা নেমে আসে ১২৭.৮১-তে। ৩৭টা ছক্কা মারলেও লেগ স্পিনাররা তাঁর হন্তারক হয়েছেন ২৬ বার। ২০২০ সাল থেকে স্ট্রাইক রেটটা প্রায় ১০ বাড়লেও এ সময়ে লেগ স্পিনে উইকেট দিয়েছেন ছয়বার। হাসারাঙ্গাকে তাই খেলেছেন বাড়তি সতর্কতায়, ১১ বল খেলে রান নিয়েছেন ৬। রহস্য স্পিনার থিকসানাও বল করে গেছেন একদম স্টাম্প বরাবর। উইকেটে বল পড়ে নিচু হচ্ছে, বাটলার ঝুঁকি নেননি তাঁর বিপক্ষেও, ৬ রান করতে খেলেছেন ১৩ বল। প্রথম দশ ওভারের পাঁচ ওভারই করেছেন শ্রীলঙ্কার দুই স্পিনার। ইনিংসের পরের অর্ধেকটায় বাটলার তাই পেস বোলারদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন সাত ওভারে, যাদের বিপক্ষে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৫১।

মনে মনে হিসাবটা বোধ হয় কষে নিয়েছিলেন বাটলারও। তাঁর চরিত্রের অন্য রূপটা তাই ধরা পড়ল ইনিংসের দ্বিতীয়ার্ধে। ইংল্যান্ডের ইনিংসের শেষ ৬০ বলের ৩৭টাই খেলেছেন, যা থেকে রান নিয়েছেন ৭৭।

শারজার উইকেটে এবার ব্যাক অব দ্য লেংথ কিংবা শর্ট বলগুলোকেই 'মূল অস্ত্র' বলছেন সবাই। কিন্তু বাটলারের বিপক্ষে সেখানটায় বল করেও ছাড় পাননি শ্রীলঙ্কান পেসাররা। আট মিটারের পেছনে পড়েছে, এমন বলে বাটলার রান তুলেছেন ২০৮ স্ট্রাইক রেটে। স্লট বলগুলোর বিপক্ষে (স্টাম্পের ২-৬ মিটার দূরের বলগুলোতে) অবশ্য ধারণ করেছেন আরও রুদ্রমূর্তি, ৩৭০ স্ট্রাইক রেটই যা বলে দিচ্ছে। আর ওয়াগন হুইলটাও বলছে, রান করেছেন উইকেটের চারদিকেই। উইকেটের ধীরগতির চরিত্রটা খুব সম্ভবত বোঝা যাচ্ছে তাঁর ওয়াগন হুইলে তাকালেও, থার্ডম্যান অঞ্চলটাতে বল গেছে মাত্রই দুবার। আর পেসারদের বিপক্ষে ৪৩ বল খেলে যে ৮৯ রান তুলেছেন, সবচেয়ে বেশি ২৪ রান এসেছে মিড উইকেট অঞ্চল দিয়ে।ব্যাট হাতে অমন সেঞ্চুরি, পরে উইকেট কিপিংয়ে করেছেন রান আউট। বাটলারই তো সবার সামনে থাকবেন মাঠ ছাড়ার সময়। ছবি: গেটি ইমেজেস

শানাকা (৭ বলে ২০), চামিকা করুণারত্নে (৯ বলে ১৫), চামিরা (১৩ বলে ২১), ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন সব পেসারের বিপক্ষেই। লাহিরু কুমারা একটু বাড়তি যত্নআত্তিই পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি ১৬ বল খেলেছেন তাঁর, রান নিয়েছেন ৩৩।

ইনিংসের শেষ বলে চামিরাকে ছক্কা মেরে পূর্ণ করেছেন সেঞ্চুরি। ২৯তম ম্যাচে এসে এবারের বিশ্বকাপ পেল প্রথম সেঞ্চুরির দেখা, সব মিলিয়ে যেটা নবম। বিশ্বকাপে এক ইনিংসে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ছয়টি ছক্কা মারার রেকর্ডটা ছিল দুজনের, লুক রাইট আর অ্যালেক্স হেলসের। জস বাটলার আজ নাম লেখালেন তাঁদের পাশে।

পাশে বসেও অবশ্য ছাড়িয়েই গেলেন বোধ হয়। রাইটের ছয় ছক্কার ম্যাচে ইংল্যান্ড দাঁড় করিয়েছিল ১৯৬ রানের পাহাড়, হেলসের ম্যাচে চট্টগ্রামের পিচে রান উঠেছিল ৩৭৯; এই দুটি তথ্য জানার পরে কথাটার মর্মার্থ নিশ্চয়ই আপনিও বুঝে গেছেন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×