দুঃস্বপ্নের এক দিন

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

দুঃস্বপ্নের এক দিন

অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের চোখেমুখে দুঃস্বপ্নের আঁকিবুকি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ম্যান অব দ্য ম্যাচ কেমার রোচকেও তাই গম্ভীর হয়ে থাকতে হলো। ছবি: শামসুল হক টেংকু

৫৮ শুধুই একটি সংখ্যা নয়। নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের একটা গল্প লেখা এতে। দুঃখ আছে, হতাশা আছে, একটু লজ্জাও বোধ হয় মিশে আছে এই ৫৮-তে। বিশ্বকাপের আলোয় ঝলমলে বাংলাদেশে একটু আঁধারও নামিয়ে এনেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই ৫৮। মিরপুর স্টেডিয়ামে অবিশ্বাস্য এই ম্যাচ যৌথ স্বাগতিকদের সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন বিবর্ণ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুছে দেওয়াতেও রেখেছিল বড় ভূমিকা।

প্রথম প্রকাশ: ২০ মার্চ, ২০১১। প্রথম আলো।

৫৮! ৫৮!! ৫৮!!! 

শুধুই একটা সংখ্যা। 

শুধুই একটা সংখ্যা!

এই ৫৮ শুধুই একটি সংখ্যা নয়। নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের একটা গল্প লেখা এতে। দুঃখ আছে, হতাশা আছে, একটু লজ্জাও বোধ হয় মিশে আছে এই ৫৮-তে। বিশ্বকাপের আলোয় ঝলমলে বাংলাদেশে একটু কি আঁধারও নামিয়ে আনল এই ৫৮!

ক্রিকেটে মাঝেমধ্যে এমন কিছু দিন আসে, যেটির কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। ব্যাটিং-বোলিংয়ের সীমানা ছাড়িয়ে যা পৌঁছে যায় অব্যাখ্যনীয় রহস্যময়তায়। কাল মিরপুর স্টেডিয়ামে নেমে এল তেমনই একটা দিন। স্বপ্নের মায়াঞ্জন চোখে ঘুম ভেঙেছিল যে দিনটির, বিকেল আসতে আসতে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর নিকষ কালো হয়ে গেল সেটিই।

৫৮! ৫৮!! ৫৮!!! ওয়ানডেতে একটা দল কীভাবে ৫৮ রানে অলআউট হতে পারে! বিস্ময়চিহ্নগুলো থাকুক, তবে ঘটনা এটাও যে ওয়ানডেতে ৩৫ রানে ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। কাল বাংলাদেশের ৫৮, ওয়ানডেতে তো নয়ই, বিশ্বকাপেরও সর্বনিম্ন স্কোর নয়। বিশ্বকাপে এর চেয়েও ছোট স্কোর আছে আরও তিনটি। তবে বাংলাদেশের কপালে ঠিকই লজ্জার তিলক এঁকে দিল একটা ‘রেকর্ড’—বিশ্বকাপে কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের সর্বনিম্ন স্কোর এটাই।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন স্কোর—এটা তো না বললেও চলছে (আগের সর্বনিম্ন ১০৮, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্লুমফন্টেইন, ২০০৩)। ওয়ানডেতেই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের করুণতম গল্প এই ৫৮। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডারউইনে ৭৪ রানকেও যা অনেক ‘ভালো’ মনে করাচ্ছে!

প্রত্যাশার সঙ্গে চরমতম প্রতারণার গল্পও এই ৫৮। বিশ্বকাপের গ্রুপিং হওয়ার পরই বাংলাদেশ পাখির চোখ করেছিল এই ম্যাচটাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট অনেক দিন ধরে নামছে তো নামছেই। মাঝখানে ওদের মাটিতে ওদের হোয়াইটওয়াশ করে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ আসতে আসতে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়েও বাংলাদেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এই ম্যাচের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিনায়ক ড্যারেন স্যামিকে তাই ‘বাংলাদেশই ফেবারিট কি না’ এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হয়েছে। এই একটা ম্যাচ, যেটিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখার প্রত্যাশায় তাকিয়ে ছিল বিশ্বকাপ। এই একটা ম্যাচ, যেটির বাংলাদেশকে উত্সবের রঙে রাঙানোর কথা ছিল। সেই ম্যাচ কিনা ৩১.১ ওভারেই শেষ!

সেটিও তো ৫৯ রান করতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১২.২ ওভার লাগিয়ে ফেলল বলে। বাংলাদেশের ইনিংস তো ১৯ ওভারও স্থায়ী হলো না! কী ব্যাখ্যা এই ব্যাটিংয়ের? ব্যাখ্যা একটাই—কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেমার রোচ নিয়মিতই ১৪৫ কিলোমিটারের আশপাশে বল করেছেন। এমন গতির বল কি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা আর খেলেননি! ড্যারেন স্যামি একেবারে জায়গামতো বল ফেলেছেন। কিন্তু সেটি কি আর আনপ্লেয়েবল কিছু ছিল! সুলিমান বেন ফ্লাইটের খেলা দেখিয়েছেন। এর চেয়ে অনেক ভালো স্পিনারকেও কি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তুলাধোনা করেননি!

ইনিংসের তৃতীয় বলেই তামিম ইকবালের আউট হয়ে যাওয়াটা বড় একটা ধাক্কা ছিল। তাই বলে সেটি তো আর এমন ধাক্কা নয় যে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের ইনিংস! একজন ব্যাটসম্যানও স্রোতের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারলেন না। উইকেটে যাওয়া-আসার মিছিল দেখে রোচকে মনে হলো ম্যালকম মার্শাল! বেনকে আলফ ভ্যালেন্টাইন! স্যামিকে বোঝাতে কোনো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের নাম মনে পড়ছে না, ধরে নিন ইংলিশ কন্ডিশনে ব্রায়ান স্ট্যাথাম!

স্যামি করলেন সর্বোচ্চ ৭ ওভার। রোচ ৬, বেন ৫.৫। আর কোনো বোলারকে বলই হাতে নিতে হলো না। ১৮.৫ ওভারে মাত্র ৫৮ রানে কোনো ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ার পর অবধারিতভাবে প্রশ্ন উঠবে উইকেট নিয়ে। এখানে উঠছে না। উইকেটে কোনো জুজু ছিল না। ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বোলিংয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে ড্যারেন স্যামি, ‘এটা যে একেবারেই ফ্লাট উইকেট ছিল’ মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না। জানালেন, উইকেট ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল বলে টসে জিতলে তিনিও প্রথমে ব্যাটিংই করতেন।

৫৮ রানের তাই কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা নেই। তাহলে কি চাপ? পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশার চাপেই এমন চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা? নাকি চিরন্তন সেই আপ্তবাক্যেই খুঁজতে হবে কারণ—ক্রিকেটে এমন কিছু দিন আসে, যেটির কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে সেটির ফল নিয়ে খুব একটা থাকার কথা নয়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে জঘন্যতম ব্যাটিং প্রদর্শনীটা সম্ভবত এটাই। সাকিব আল হাসান যথার্থই বলেছেন, শুধু বাংলাদেশের এই দলের নয়, এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যই ‘ব্যাড ডে’।

‘খারাপ দিন’টা ‘সবচেয়ে খারাপ দিন’-এ পরিণত হলো ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই। সেটির দায় ক্রিকেট দলের নয়। সমর্থকদের আবেগের বাড়াবাড়ির। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর যা হয়েছে, সেটি ছিল বাড়াবাড়ি। কালকের বিপর্যয়ের পর যা হলো, সেটি তো অবশ্যই। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হওয়ার আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শক। শেষ ২-৩টি উইকেট পড়ার সময় তুমুল করতালি উঠেছে গ্যালারি থেকে। মাঠে ঢিল-টিলও পড়েছে। অগ্রহণযোগ্য হলেও প্রত্যাশাভঙ্গের নিদারুণ হতাশায় তা-ও সেটির একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু খেলা শেষে যা হলো, সেটির কী ব্যাখ্যা?

ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম বাসের কাচ ভাঙল ঢিলে। বাস থেকে ক্রিস গেইলের টুইট মুহূর্তেই ক্রিকেট-বিশ্বে ছড়িয়ে দিল সেই খবর। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে উত্সবমুখর জনতা ক্রিকেট-বিশ্বে অন্য আলোয় আলোকিত করেছিল বাংলাদেশকে। আর কাল ক্রিস গেইল টুইটারে লিখলেন, তিনি এই দেশে আর এক মুহূর্তও থাকতে চান না।

এটি বোধ হয় ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার চেয়েও অনেক বড় লজ্জা।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×