অধিনায়কত্বের আরেক দিকও দেখছেন হাবিবুল

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-২

উৎপল শুভ্র

২৭ মার্চ ২০২১

অধিনায়কত্বের আরেক দিকও দেখছেন হাবিবুল

টেস্ট অভিষেকের চার বছর দুই মাস পর ধরা দিয়েছিল সেই আরাধ্য স্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই জয় চিরদিনই অন্যরকম একটা জায়গা নিয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই টেস্টের প্রতিটি দিনই তাই আবার ফিরে দেখার মতো।

প্রথম প্রকাশ: ৬ জানুয়ারি ২০০৫। প্রথম আলো।

পুরো দেশ যে মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে, মনে মনে সেটির কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছেন তিনিও। চট্টগ্রাম টেস্টে জয় পেলে পুরো দেশের মতো তাঁর জন্যও সেটিই হবে আসল স্বপ্নপূরণের দিন। তবে চট্টগ্রাম টেস্ট শুরুর আগের দিনই হাবিবুল বাশারের একটা স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল।

‘আমরা পজিটিভ খেলব’, ‘লড়াই করার চেষ্টা করব’—ভাঙা রেকর্ডের মতো একই কথা বারবার বলার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে এই প্রথম কোনো টেস্টের আগে জয়ের স্বপ্নের কথা বলতে পারলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। এই প্রথম ‘বাংলাদেশ ফেবারিট কি না’—এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো তাঁকে। ‘জিম্বাবুয়ে, নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস; বাংলাদেশের আসল প্রতিপক্ষ কোনটি’—এই প্রশ্নেরও!

‘এত দিন শুধু এই দিনটির স্বপ্নই দেখে এসেছি। একদিন আমরা এমন অবস্থায় আসব, যখন টেস্ট ম্যাচের আগে জয়ের কথা বলতে পারব। সেদিক থেকে আজকের দিনটি তো একটু অন্য রকমই’— হাবিবুলের মুখে তৃপ্তির হাসি। তবে খুব বেশিক্ষণ সেই তৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না, কারণ এই তৃপ্তিটাই তো শেষ কথা নয়, এর হাত ধরেই আসছে চাপ। অধিনায়কের ভূমিকাটাও নতুন করে আবিষ্কার করতে হচ্ছে তাঁকে। 

এত দিন ক্রিকেটামোদীরা রসিকতা করে বলতেন, ক্রিকেট বিশ্বে রিকি পন্টিং আর হাবিবুল বাশার, এই দুই অধিনায়কের কাজটাই সবচেয়ে সহজ। পন্টিং যেমন জানেন, তাঁর দল জিতবেই; তেমনি হাবিবুলও জানেন, তাঁর দল হারবেই। রসিকতাটা শুনে হাবিবুল খুব হাসলেন। এর আগে প্রতিবারই টস করতে গেছেন পরাজয়ের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, এবার তাঁর চোখে থাকবে জয়ের স্বপ্ন। দুটোর মধ্যে তফাত হাবিবুলের চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারেন? ‘এক দিক থেকে আগের কাজটা সহজ ছিল, চাপ অনেক কম থাকত। তবে একই সঙ্গে তা ছিল খুব হতাশারও। কখনো কখনো নিজেকে খুব অসহায় লাগত। এবার যেটা হচ্ছে, চাপটা অনেক বেশি। তবে খেলার আসল উদ্দেশ্য তো জেতা, এ জন্যই তো ক্রিকেট খেলা। এবার যা হচ্ছে, দিস ইজ ক্রিকেট। দিস ইজ লাইফ।’

অধিনায়কের ভূমিকাটা যে নতুন করে আবিষ্কারের কথা বলা হলো, সেটি কেমন? খেলোয়াড়দের সঙ্গে আগেও কথা বলেছেন, অধিনায়ককে তো তা বলতে হয়ই। তবে আগে যেখানে সতীর্থদের সাহস দিতেন, এবার তাঁদের সঙ্গে বসতে হচ্ছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে। অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স সব কিছুতেই এগিয়ে থাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটা খুব সহজ হবে— এমন একটা সর্বনাশা চিন্তায় দলের কাউকে কাউকে আক্রান্ত হতে দেখেছেন বলেই হাবিবুলের এই বাড়তি সতর্কতা।

টেস্ট ম্যাচ যে টেস্ট ম্যাচই, এখানে সাফল্যের আলোকচ্ছটার ঠিক পেছনেই যে ঘাপটি মেরে থাকে ব্যর্থতার অন্ধকার, এই জিম্বাবুয়েই তো তা সবচেয়ে ভালোভাবে শিখিয়েছে হাবিবুল বাশারকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আগের ৬ টেস্টের ১১ ইনিংসে তার ১টি সেঞ্চুরি ও ৪টি হাফ সেঞ্চুরি যেমন আছে, তেমনি আছে ৪টি শূন্যও! দুই ইনিংসেই প্রায় সেঞ্চুরি করে ফেলার কৃতিত্ব (২০০১ সালের নভেম্বরে এই চট্টগ্রামেই ১০৮ ও ৭৬) যেমন আছে, তেমনি আছে দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হওয়ার (গত ফেব্রুয়ারিতে হারারেতে) দুঃসহ অভিজ্ঞতাও। 

অধিনায়কত্বের আরেক দিকের সঙ্গে পরিচয়টা মধুরই হয়েছিল হাবিবুলের। ছবি: শামসুল হক টেংকু

আবার জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হয়ে হাবিবুলের মনে তাই অনেক স্মৃতির আনাগোনা। সব কিছু ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে উঠছে, তিন বছর আগের জিম্বাবুয়ে সফরে হারারে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের ৭৬। এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, সেটিকেও কীভাবে ছাড়িয়ে যায় ওই ৭৬? সেন্ট লুসিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরির আগ পর্যন্ত এই ৭৬-কেই নিজের সেরা ইনিংসের মর্যাদা দিয়ে এসেছেন, তবে এর আসল মাহাত্ম্যটা অন্যখানে। আজ তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে, এর পেছনে ওই ৭৬-এরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেখেন হাবিবুল, ‘সেদিন আমি অসাধারণ খেলেছিলাম। তার চেয়েও বড় কথা, ওই ইনিংসটিই আমার পুরো ক্যারিয়ার বদলে দিয়েছে।’

দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৬-এর আগে ওই হারারে টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৬৪। এরপর সে বছরই জিম্বাবুয়ের ফিরতি সিরিজে প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর হাবিবুলের পরের ৩টি ইনিংস ৬৫, ১০৮ ও ৭৬ রানের। এর কিছুই দেখেননি জিম্বাবুইয়ান অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবু। উইকেটের পেছনে থেকে তিনি যে হাবিবুলকে দেখেছেন, তিন ইনিংসে তাঁর রান মাত্র ৪। জিম্বাবুয়েতে গত সফরে হারারেতে অধিনায়কত্বের অভিষেকে ‘পেয়ার’ পাওয়ার পর বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া বুলাওয়ে টেস্টের একমাত্র ইনিংসে ওই ৪। জিম্বাবুয়ের এই দলের শুধু একজনই হাবিবুলকে ভালো চেনেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে আগের তিনটি সিরিজেই খেলেছেন ডিওন ইব্রাহিম। দেখেছেন চট্টগ্রামে তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিও। হাবিবুলই যে জিম্বাবুয়ের জন্য আসল ‘ডেঞ্জারম্যান’, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে তাই একটুও ভাবতে হচ্ছে না তাঁকে। 

হিথ স্ট্রিকও তাঁকে খুব ভালো চিনতেন। চিনতেন বলেই হারারেতে ওই ‘পেয়ার’-এর পরও সে সময়ের জিম্বাবুইয়ান অধিনায়ক বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘হাবিবুল কতটা বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান, আমরা তা ভালোই জানি।’ 

দলের অন্যদের নিয়ে হাবিবুলকে খুব ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, অধিনায়ককে তা থাকতেই হয়। তবে হাবিবুল বাশারের ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে পারা না-পারার ওপর যে অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের ব্যাপারটি, এটি পুরো দলই জানে। 

হাবিবুল নিজেও তা জানেন। জানা মানেই তো আরও চাপ। হাবিবুল হাসলেন। সেই হাসি কী বলল, অনুমান করাই যায়। ‘দিস ইজ লাইফ!’

আরও পড়ুন...
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৩
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৪
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৫
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৬
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৭
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৮

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×