অভিষেকের অনেক রং

ইয়াং-নাসুম যদি উত্তর মেরু, দক্ষিণ অ্যালেন-শরিফুল

উৎপল শুভ্র

২৮ মার্চ ২০২১

ইয়াং-নাসুম যদি উত্তর মেরু, দক্ষিণ অ্যালেন-শরিফুল

প্রথম ওভারেই উইকেট। সেটিও আবার আরেক অভিষিক্ত ফিন অ্যালেনকে `গোল্ডেন ডাক` উপহার দিয়ে, নাসুম আহমেদের প্রতিক্রয়া তো এমনই হবে

অভিষেক নিয়ে এত কথা বলছি, বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিতে চার ক্রিকেটারকে অভিষিক্ত হতে দেখে। দুই দলের দুই-দুই চারজন। দুই দলের দুই জন রঙিন করে রেখেছেন এই উপলক্ষ, অন্য দুই জন তা ভুলে যেতে পারলেই বাঁচেন।

আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগের রাতে ঘুম হয় ক্রিকেটারদের? স্বপ্ন পূরণের উত্তেজনা ঘুমাতে দেয়?

মনে হয় না। অভিষেকের কথা আগে থেকে না জানলে বরং শাপে বর হয়। সংখ্যাটা হাতে গোণাই হবে, কিন্তু এমন তো হয়েছেই, সকালে কোনো একটা কারণে হঠাৎ অভিষেক হয়ে গেছে কোনো ক্রিকেটারের। বেশির ভাগ সময়ই সেই ‘কারণ’, নির্বাচিত একাদশের কারও কোনো দুর্ঘটনায় ছিটকে পড়া। এভাবে অভিষেক হওয়া বরং ভালো। আগের রাতে ঘুমের সমস্যায় পড়তে হয় না।

অভিষেক নিয়ে এত কথা বলছি, বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিতে চার ক্রিকেটারকে অভিষিক্ত হতে দেখে। দুই দলের দুই-দুই চারজন। এদের মধ্যে উইল ইয়াংয়ের মনে হয় না ঘুমের কোনো সমস্যা হয়েছে। টেস্ট অভিষেক হয়ে গেছে মাস চারেক আগেই, সপ্তাহখানেক আগে ওয়ানডে অভিষেকও। টি-টোয়েন্টি অভিষেক নিয়ে ইয়াংয়ের স্নায়ুতন্ত্রের তাই খুব বেশি উত্তেজিত হওয়ার কথা নয়।

তবে এটা বাজি ধরেই বলতে পারি, গত ডিসেম্বরে এই হ্যামিল্টনেই টেস্ট অভিষেকের আগের রাতে উইল ইয়াং দুই চোখের পাতা এক করতে পারেননি। বার বার মনে হয়েছে, মনে হতে বাধ্য, শেষ পর্যন্ত আমার টেস্ট অভিষেক হবে তো? হবে তো?

আবার যদি অমন কিছু হয়ে যায়!

‘অমন কিছু’ বলতে উইল ইয়াংয়ের মনে যে ‘কু’টা ডাকছিল, তা ভয়াবহ কিছু। টেস্ট অভিষেক তো হওয়ার কথা ছিল আরও পৌনে দুই বছর আগেই। না-হওয়া সেই টেস্ট অভিষেক নিয়ে রোমাঞ্চিত উইল ইয়াংয়ের কথা আমার মাঝেমধ্যেই মনে পড়ত। পরদিন টেস্ট অভিষেক হচ্ছে, ইয়াংয়ের চোখেমুখে ফুটে বেরোচ্ছে সেই আনন্দ। তাঁকে নিয়ে আলাদা স্টোরি করবেন বলে নিউজিল্যান্ডের দুই সাংবাদিকের প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বেড়ে ওঠার গল্প থেকে শুরু করে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন, ক্রিকেটার হিসাবে নিজেকেই নিজে ব্যাখ্যা করা..কথা আর শেষ হয় না। অভিষেক দেখতে ওয়েলিংটন থেকে উড়ে আসছেন বাবা-মা–এটা জানানোর সময় উইল ইয়াংয়ের মুখের হাসিটা এখনো যেন দেখতে পাই।

২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চের সেই সংবাদ সম্মেলন। উইল ইয়াং (ডানে) তখন জানতেন, পরদিন তাঁর টেস্ট অভিষেক হচ্ছে। টিম সাউদি জানতেন, আবারও তাঁকে উইলিয়ামসনের প্রক্সি দিতে হবে। যে টেস্ট আর হয়নি। ছবি: নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট

আমাদের মানে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অবশ্য একটু বিরক্তই লাগছিল। আমরা তো উইল ইয়াংকে নিয়ে আলাদা স্টোরি করব না, আমাদের এত ‘প্যাঁচাল’ শুনতে ভালো লাগবে কেন? তার ওপর আবার ওই দুর্বোধ্য কিউই ইংলিশ!

অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন খেলতে পারবেন না নিশ্চিত হওয়ার পর অগণ্যবারের মতো তাঁর প্রক্সি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলা টিম সাউদিও ছিলেন প্রেস কনফারেন্সে। সাউদির নিজের যখন টেস্ট অভিষেক, তখন বালকবয়সই সেভাবে কাটেনি। হাসি হাসি মুখ করে উইল ইয়াংকে দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই সেই স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর।

ওই হাসিমুখ টিম সাউদি কীভাবে কল্পনা করবেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই কী এক দুঃস্বপ্ন গ্রাস করে নেবে ক্রাইস্টচার্চকে! উইল ইয়াং কীভাবে ভাববেন, তাঁর স্বপ্নের টেস্ট অভিষেক পিছিয়ে যাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। এই পিছিয়ে যাওয়ার কথাও তো বলছি উইল ইয়াংয়ের টেস্ট অভিষেক হয়ে গেছে বলে। নইলে মাঝের সময়টায় যখনই ক্রাইস্টচার্চ হামলার ওই ভয়াল স্মৃতি মনে পড়ত, টুকরো টুকরো ভয়াল সব ছবির কোলাজ পেরিয়ে অবধারিতভাবেই উইল ইয়াংয়ের মুখটা ভেসে উঠত আমার চোখের সামনে। কেন উইলিয়ামসনের ইনজুরি-সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে ডাক পড়েছিল তাঁর। উইলিয়ামসন তো দ্রুতই আবার ফিরে এসেছেন। শূন্যস্থান আবার ভরাট। এমন তো হতেই পারত, দলের আর কেউ ফর্ম হারালেন না বা উইল ইয়াং নিজেই হারিয়ে ফেললেন ব্যাটে রানের ফল্গুধারা। আর কোনোদিন তাঁর টেস্টই খেলা হলো না।

এমন দুর্ভাগ্য একেবারেই কারও হয়নি, তা তো নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের ভাস্কর পিল্লাইয়ের কথা মনে পড়ছে। আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে ঘরোয়া ক্রিকেট ভাসিয়ে দিয়েছেন রানবন্যায়। ভারতের স্কোয়াডেও ঢুকেছেন অনেকবার। কিন্তু খেলার সুযোগ আর পাননি। যে ম্যাচে খেলবেন নিশ্চিত জেনে আগের রাতে ঘুমাতে গেলেন, পরদিন সেই ম্যাচ ভাসিয়ে নিয়ে যায় বৃষ্টি। বেচারার আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা-ই পড়ল না। ঢাকায় খেলতে এসে এই গল্প বলার সময় কণ্ঠটা ধরে এসেছিল পিল্লাইয়ের। তাঁকে নিয়ে লেখাটার হেডিং করেছিলাম–ভাস্কর পিল্লাই: বদ্ধ দুয়ার খোলেনি আর।

উইল ইয়াংয়ের সামনে  সব খুলে গেছে। আজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তৃতীয় ও শেষ দুয়ারটাও। ইয়াংয়ের কল্পনাতেও থাকার কথা নয়, শেষ পর্যন্ত তাঁর টেস্ট অভিষেক হতে দেখে ওই প্রেস কনফারেন্সের বাইরে কোনোদিন দেখা হয়নি-কথা হয়নি, বাংলাদেশের এমন এক সাংবাদিক কেমন খুশি হয়েছিল! নিয়তি নির্ধারিত বলে মনে হচ্ছে এটাকেও, যে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হতে হতেও হয়নি, সেই বাংলাদেশই হয়ে থাকল ইয়াংয়ের যুগল অভিষেকের প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশ ১৩২ রানের বেশি করতে না পারায় ওয়ানডে অভিষেকে বেশি কিছু করার সুযোগ পাননি। ১১ নট আউট মনে রাখার মতো কিছু নয়ও, তবে অভিষেকেই তাঁর ব্যাট থেকে জয়সূচক রান–এটা তো মনে থাকবেই।

নিউজিল্যান্ডের দুই ডেবুট্যান্ট ফিন অ্যালেন ও উইল ইয়াং। অভিষেক টি-টোয়েন্টি দুজনের কাছে হয়ে থাকল পুরো বিপরীত দুই অভিজ্ঞতা। ছবি: নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট

টি-টোয়েন্টি অভিষেকটা সে তুলনায় অনেক রঙিন। ৩০ বলে ৫৩ রান, ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ছক্কা...ম্যাচ শুরুর আগে কাউকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে বললে অন্তত দ্বিতীয়টি করার জন্য ফেবারিট হিসাবে উইল ইয়াংয়ের চেয়ে বেশি ভোট পেতেন ফিন অ্যালেন। নিউজল্যান্ডের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে এমনই ঝড় তুলেছেন, মাইক হেসন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন আইপিএলে তাঁর দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে। ডাক পেয়েছেন ইংলিশ কাউন্টিতেও। অথচ সুখস্বপ্নে ভেসে যাওয়ার এই সময়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর অভিষেকটা কেমন ঘোর দুঃস্বপ্নের নামান্তর হয়ে রইল।

ক্রিকেট কাউকে দেয়, কাউকে বঞ্চিত করে। আবার কখনো কখনো এই দুটোকে একই সুতোয়ও গেঁথে ফেলে। আজ হ্যামিল্টনের ম্যাচেই যেমন নাসুম আহমেদ আর ফিন অ্যালেনকে গাঁথল। দুজনেরই অভিষেক এবং প্রথম ওভারেই দুজন মুখোমুখি। এবং প্রথম বলেই আউট ফিন অ্যালেন!

ক্রিকেটে প্রথম বলেই আউটকে ‘গোল্ডেন ডাক’ বলা আমার কাছে নিষ্ঠুর রসিকতা বলে মনে হয়। এই ‘ডাক’-এর রং সোনালি হয় কীভাবে! এটি তো ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার কথা।

ফিন অ্যালেন আমার সঙ্গে নির্ঘাত একমত হবেন। তবে নাসুম আহমেদ এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখাবেন বলে মনে হয় না। প্রথম ওভারেই উইকেট পেয়েছেন, পরে নিয়েছেন শততম টি-টোয়েন্টি খেলতে নামার আগে রস টেলরের কাছ থেকে একটা স্মারক টুপি ও আলিঙ্গন উপহার পাওয়া মার্টিন গাপটিলের মহার্ঘ্য উইকেটটিও (আর মহার্ঘ্য! গাপটিল থাকলেও এর বেশি এমন কীই-বা হতো!)। তাঁর কী ঠেকা পড়েছে ‘ডাক’ সোনালি না কালো, এ নিয়ে ভাবতে।

না ভাবলে না ভাবুন। নাসুমের মোটামুটি ভালো একটা অভিষেক হওয়াতে আমাদেরও সুবিধাই হলো। গত কিছুদিন নাসুম আহমদ নামটা শুনলেই তো চোখে ভেসে উঠত কদর্য ওই দৃশ্য। প্রেসিডেন্টস কাপে তাঁর বেক্সিমকো ঢাকা টিমমেট মুশফিকুর রহিম তেড়ে যাচ্ছেন তাঁকে মারতে। কী আশ্চর্য, নাসুমের অভিষেক ম্যাচে সেই মুশফিকুর রহিমই মাঠের বাইরের দর্শক। সাকিব তো সেই কবেই এই ট্যুর থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। কদিন আগে ‘ব্যক্তিগত কারণে’ টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে সরে গেছেন তামিমও। সঙ্গে মুশফিকও যোগ হওয়ায় গত পনের বছরে যা ঘটেনি, তারই সাক্ষী হয়ে থাকল হ্যামিল্টনের এই টি-টোয়েন্টি। এই ত্রয়ীকে ছাড়াই মাঠে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে ৬ আগস্ট সাকিবের আন্তর্জাতিক অভিষেকের দিন থেকে যা আর কখনো হয়নি।

অভিষেক নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। দুই দলের দুই-দুই করে চারজনের অভিষেক, মনে আছে তো? অবাক মিল, উইল ইয়াংয়ের যেমন বিপরীত চিত্র হয়ে ফিন অ্যালেন আছেন; বাংলাদেশের দুই অভিষিক্তও এমন দুই মেরুতে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে যাঁকে খেলানোটা প্রায় জনদাবিতে পরিণত হয়েছিল, সেই শরিফুল ইসলামের অবশেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। আর অভিষেকেই অগৌরবের এক রেকর্ড। ৪ ওভারে ৫০ রান টি-টোয়েন্টি অভিষেকে বাংলাদেশের কোনো বোলারের সবচেয়ে বেশি উদারতার প্রমাণ।

ফিন অ্যালেনের সঙ্গী আছে বলছিলাম, শরিফুল বেচারার তা-ও নেই। রেকর্ড সবার এককভাবেই ভোগ করার আকাঙক্ষা থাকে। কিন্তু সেই রেকর্ড যদি এমন হয়, তা ঝেড়ে ফেলতে পারলেই শান্তি। রুবেল হোসেন এখন যে শান্তিটা পাচ্ছেন।  

টি-টোয়েন্টি অভিষেকে ‘গোল্ডেন ডাক’ মারায় ফিল অ্যালেনের তা-ও কিউই সঙ্গী আছে। তা-ও আবার দুজন। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইতিহাসের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে সেই ‘গোল্ডেন ডাকে’ ম্যাথু সিনক্লেয়ার ও কাইল মিলস খুব বেশি মন খারাপ করেননি। খুব বেশি কেন, একটুও মন খারাপ করেননি লিখে দিলেও তা সত্যভ্রষ্ট হবে না। দুই দেশের মধ্যে প্রথম টি-টোয়েন্টিটা তো ছিল নির্ভেজাল মজা। কেউ তখন কল্পনাও করেনি, খুব দ্রুতই তা এমন সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে উঠবে।

ফিন অ্যালেনের সঙ্গী আছে বলছিলাম, শরিফুল বেচারার তা-ও তো নেই। রেকর্ড সবার এককভাবেই ভোগ করার আকাঙক্ষা থাকে। কিন্তু সেই রেকর্ড যদি এমন হয়, তা ঝেড়ে ফেলতে পারলেই শান্তি। রুবেল হোসেন এখন যে শান্তিটা পাচ্ছেন। ১ রান কম দিয়ে আগের রেকর্ডটা যে তাঁরই ছিল। আপনিই বলেন, মুক্তির আনন্দে শরিফুলকে রুবেলের ডিনার করানো উচিত না?

করালেই বা কি! অভিষেকের আগের রাতে যেমন শরিফুলের ঘুম হয়নি বলে অনুমান করি, অভিষেকের রাতটাও তাঁর এমন বিনিদ্রই কাটবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×