অদৃশ্য দ্বাদশ খেলোয়াড়ের নাম ফিলিপ হিউজ

বিশ্বকাপ ফাইনালে বারোজন নিয়ে খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া!

উৎপল শুভ্র

২৯ মার্চ ২০২১

বিশ্বকাপ ফাইনালে বারোজন নিয়ে খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া!

অকালপ্রয়াত প্রিয় বন্ধু ফিল হিউজের সঙ্গে মাইকেল ক্লার্ক। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেই ক্লার্ক বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া শুধু ১১ জন নিয়েই খেলবে না। ছবি: মাইকেল ক্লার্কের ইনস্টাগ্রাম

একে একে সব খেলোয়াড় গলায় পরলেন চ্যাম্পিয়নের পদক। দলের ‘একজন’ শুধু যাননি। যাওয়ার কথাও না। কারণ চার মাস আগেই ক্রিকেট মাঠে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ব্যাটিংয়ের সময় তাঁর মৃত্যু লিখে দিয়েছে ক্রিকেট বল। তবে অদৃশ্য সঙ্গী হয়ে পুরো বিশ্বকাপেই মাইকেল ক্লার্কদের পাশে ছিলেন। ছিলেন আলো ঝলমল এমসিজিতে সোনালি কনফেত্তি-প্লাবিত অস্ট্রেলিয়ার বিজয় উৎসবেও। তাঁর নাম ফিলিপ হিউজ।

প্রথম প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১৫। প্রথম আলো।

একে একে সব খেলোয়াড় চ্যাম্পিয়নের পদক গলায় পরলেন। দলের ‘একজন’ শুধু যাননি। যাওয়ার কথাও নয়। কারণ চার মাস আগেই ক্রিকেট মাঠে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ব্যাটিংয়ের সময় তাঁর মৃত্যু লিখে দিয়েছে ক্রিকেট বল। তবে অদৃশ্য সঙ্গী হয়ে পুরো বিশ্বকাপেই মাইকেল ক্লার্কদের পাশে ছিলেন। ছিলেন কাল রাতে আলো ঝলমল এমসিজিতে সোনালি কনফেত্তি-প্লাবিত অস্ট্রেলিয়ার বিজয় উৎসবেও। তাঁর নাম ফিলিপ হিউজ।

ফিল হিউজ (১৯৮৮-২০১৪)। অনন্তলোক থেকে সেদিন এমন করেই হয়তো তাকিয়ে ছিলেন এমসিজির দিকে! ছবি: গেটি ইমেজেস।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেই বিশ্বকাপ জয়টাকে হিউজকে উৎসর্গ করে এসেছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রসঙ্গ ওঠার পর মাইকেল ক্লার্ক রীতিমতো আবেগাপ্লুত, ‘আমরা এই বিশ্বকাপ ১৬ জন খেলোয়াড় নিয়ে খেলেছি, বাকি ক্যারিয়ারও তা-ই খেলব। এমন এক দিনও যায়নি যে আমরা হিউজিকে নিয়ে কথা বলিনি, এখনো বলছি।’ বিশ্বকাপে কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলেছেন। যত দিন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলবেন, এটি ক্লার্কের সঙ্গী হয়ে থাকবে, ‘টেস্ট ক্রিকেট তো খেলব। যত দিন খেলব, আমার টুপিতে ওর টেস্ট নাম্বার লেখা থাকবে আর হাতে এই কালো ফিতা।’

ফাইনালের আগের দিন ওয়ানডে থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। ৯৩ হাজারেরও বেশি দর্শকের সামনে জীবনের শেষ ওয়ানডেতে স্ট্রোক প্লেতে উজ্জ্বল এক হাফ সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নেওয়া—সেটি আরও বিশেষ হয়ে আছে ফিল হিউজের কারণে। ক্লার্ক নিজেও অভিভূত, ‘খেলাধুলায় রূপকথা হয় না। কিন্তু আজ যা হয়েছে, তা রূপকথার কাছাকাছি। আমাদের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল, যে কারণে প্রচণ্ড চাপও ছিল, সেসব জয় করে নিজেদের দর্শকের সামনে বিশ্বকাপ জেতা—শেষটা এর চেয়ে ভালো আর হতে পারত না।’

যা হয়েছে, সেটিই বা রূপকথার চেয়ে কম কী! হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে এই বিশ্বকাপে খেলাটাই ছিল চরম অনিশ্চিত। অস্ত্রোপচারের পর সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিট করে তুলেছেন নিজেকে। মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছিল নির্বাচকদের বেঁধে দেওয়া ডেডলাইন। মাঠের লড়াইয়ের জেতার আগে ক্লার্ককে জিততে হয়েছে মাঠের বাইরের যুদ্ধ। তাতে জিতে মাঠে ফিরে বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে বিদায়! উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হিসেবেও তো অতিনাটকীয় লাগে! মাইকেল ক্লার্কের বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নেওয়া ক্রিকেটের সুন্দরতম গল্পগুলোর একটি। পরাজয়ের বেদনা ভুলে ব্রেন্ডন ম্যাককালামও যাতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন, ‘ক্রিকেটে মাঝে মাঝে একটু রোমান্স লাগে। আজ রাতে মাইকেল ক্লার্ক এমন রোমান্সের গল্পই লিখেছে।’

ফাইনালের পর সংবাদ সম্মেলনে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ছবি: আইসিসি।

সাংবাদিকেরা নানা সমীকরণ সাজিয়ে অজুহাত খোঁজার সুযোগ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু ম্যাককালাম সেসব পাত্তাই দিলেন না। বারবার শুধু একটা কথাই বললেন, এদিনের অস্ট্রেলিয়া এমনই অসাধারণ যে, তাঁর দলের কিছুই করার ছিল না।

বিশ্বকাপের ফাইনাল হারার পর যেকোনো অধিনায়কেরই ‘যদি অমন না হয়ে এমন হতো’ জাতীয় ভাবনায় সান্ত্বনা খোঁজাটাই স্বাভাবিক। ম্যাককালাম সেটির ধারই ধারলেন না। সাংবাদিকেরা নানা সমীকরণ সাজিয়ে অজুহাত খোঁজার সুযোগ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু ম্যাককালাম সেসব পাত্তাই দিলেন না। বারবার শুধু একটা কথাই বললেন, এদিনের অস্ট্রেলিয়া এমনই অসাধারণ যে, তাঁর দলের কিছুই করার ছিল না।

তা বড় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া কীভাবে এমন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে? এই রহস্যের উত্তর কিছুটা হলেও পাওয়া গেল মাইকেল ক্লার্কের কাছ থেকে। সেই শৈশব-কৈশোর থেকেই দেখে এসেছেন, অস্ট্রেলিয়ার বড় খেলোয়াড়েরা বড় টুর্নামেন্টের বড় ম্যাচে কেমন জ্বলে উঠেছেন! অস্ট্রেলিয়া দলে ঢোকার পর কাছ থেকে দেখেছেন এমন সাত-আটজনকে। যাঁরা বড় ম্যাচে ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়ার বদলে ব্যাটিং করতে চান, বোলিং করতে চান। ফিল্ডিংয়ের সময় যাঁরা চান, প্রতিটি বলই তাঁদের কাছে আসুক। সর্বকালের সেরা অনেকের সঙ্গেই খেলেছেন। তাঁর এই দলেরও অনেকেই ক্যারিয়ার শেষে সেই দলে নাম লিখিয়ে ফেলবেন বলে বিশ্বাস ক্লার্কের। সেই নিবেদনই যে দেখছেন তিনি দলের তরুণদের মধ্যে। ক্লার্ক নিজে থেকেই না বললে কারও কি এটা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল যে, নিউজিল্যান্ডের মাত্র ১৮৩ রান সামনে রেখেও দলের ছয়-সাতজন খেলোয়াড় বিরতির সময় মাঠের পাশে নেটে ব্যাটিং করেছে!

মাঠের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। তাঁর পিছু পিছুই ফাইনাল আর টুর্নামেন্টের সেরা জেমস ফকনার ও মিচেল স্টার্ক। অথচ মাইকেল ক্লার্কের জন্য সাংবাদিকদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। শেষ পর্যন্ত ক্লার্ক সংবাদ সম্মেলনে এলেন ম্যাচ শেষ হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর। বোলারদের পারফরম্যান্সে পঞ্চমুখ হবেন, সেটিই স্বাভাবিক। এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আসলেই রীতিমতো রোমাঞ্চ জাগানোর মতো!

বিস্ময়করই বলতে হবে, ক্রমেই আরও বেশি ব্যাটসম্যানদের খেলার পরিণত ওয়ানডে ক্রিকেটের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দুটি কি না দুই বোলারের! টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং টিমই যে বিশ্বকাপ জিতল—এতেও কি কোনো বার্তা আছে? সেটি হয়তো এমন—টেস্ট ম্যাচ যেমন বোলাররা জেতায়, ওয়ানডে জিততেও এখন উইকেট নিতে পারে, এমন বোলার লাগবে। রিভার্স সুইং কেড়ে নেওয়া দুই নতুন বল আর বৃত্তের বাইরে চারজন ফিল্ডার রাখার নিয়মে রান আটকে রাখার রক্ষণাত্মক বোলিংয়ের দিন শেষ।

বিশ্বকাপ জিতে বিদায়! এমসিজির ফাইনাল শেষ সংবাদ সম্মেলনে মাইকেল ক্লার্ক। ছবি: আইএএনএস।

শেষ মাইকেল ক্লার্কের ওয়ানডে ক্যারিয়ারও। ফাইনাল শেষে ঘোষণাটা না দিয়ে কেন আগের দিন তা দিলেন? ক্লার্ক বললেন, ‘আজ এই ঘোষণা দিলে আপনারা তো কাল এটা দিয়েই পাতা ভরিয়ে ফেলতেন। আমি চেয়েছি, ফাইনালের পরের দিন অস্ট্রেলিয়া দল নিয়ে সবাই কথা বলুক। আশা করি, আগামী সাত দিন আপনারা এই দলের অসাধারণ সব খেলোয়াড়কে নিয়ে লিখে যাবেন।’

অনুরোধটা বোধ হয় রাখবে অস্ট্রেলীয় মিডিয়া! সাফল্যের গল্প লেখার মতো আনন্দ তো আর কিছুতে নেই।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×