হায় আশরাফুল!
উৎপল শুভ্র
১ এপ্রিল ২০২১
মোহাম্মদ আশরাফুলের ৫৭ বলে ৭০ উল্টো হয়ে গেল আক্ষেপ! আশরাফুল আউট হয়ে যাওয়ার পর দেখতে না দেখতেই বাংলাদেশ চিরাচরিত চেহারায়! ২০০৭ সালের বক্সিং ডেতে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে বাংলাদেশের প্রথম সেই ম্যাচ। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড প্রথম ওয়ানডে।
প্রথম প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭। প্রথম আলো।
বাংলাদেশ: ৪৬.৩ ওভারে ২০১। নিউজিল্যান্ড: ৪২.৩ ওভারে ২০৩/৪। ফল: নিউজিল্যান্ড ৬ উইকেটে জয়ী
ইডেন পার্কের বিগ স্ক্রিনটার দিকে এক পলক তাকানোর পর ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে আরও বেশি উদভ্রান্ত মনে হলো। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ক্রিকেট: এনিথিং ক্যান হ্যাপেন!’ কথাটার তখন একটাই অর্থ— নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়টাও আজ এসে যেতে পারে।
বাংলাদেশের ইনিংসের ২৬তম ওভারটি মাত্র শেষ হয়েছে। স্কোর ২ উইকেটে ১৩০। এই ওভারেই তামিম ইকবালের ফিফটি হলো। মোহাম্মদ আশরাফুলের হয়েছে আগেই। বাংলাদেশ কত করবে? ২৬০? ২৭০? আশরাফুল আর তামিমের ব্যাট যেভাবে হাসছে, তাতে আরও বেশিও হতে পারে।
একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের অলিখিত একটা সূত্র হলো, হাতে উইকেট থাকলে ৩০ ওভারের স্কোর ৫০ ওভার শেষে দ্বিগুণ করা সম্ভব। ৩০ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ১৫১, অথচ শেষ পর্যন্ত সেটি ২০১-এর বেশি হলো না। ৩০ ওভার আর ৫০ ওভারের সূত্র এখানে খাটবে কেন? শর্তটা যে ‘হাতে উইকেট থাকলে’। ৩০ ওভার শেষে বাংলাদেশ ১৫১ ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে যে ৬ উইকেট নেই! ওয়ানডেতে ‘পাপ’ বলে বিবেচিত পুরো ৫০ ওভার খেলতে না পারার ঘটনাও যে ঘটেছে। সাড়ে তিন ওভার বাকি থাকতেই শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের ইনিংস!
নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশের জন্য বরাবরের ‘বগি টিম’। এতটাই যে, আশাভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকা এই ২০১ রানই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯টি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর। দু শ পেরোনোর ঘটনাও এই প্রথম। আগের সর্বোচ্চ ১৯৮ ছিল ২০০৩ বিশ্বকাপে কিম্বার্লিতে। তাতেও সবচেয়ে বড় অবদান ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের। বাংলাদেশের ইনিংসে সর্বোচ্চ ৫৬ রান এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই।
কিন্তু ১৪ রান বেশি বলেই নয়, কালকের ৭০ রানের ইনিংসটির সঙ্গে ওই ৫৬-র কোনো তুলনাই চলে না। কালকের আশরাফুল কার্ডিফের আশরাফুল, গায়ানার আশরাফুল। এই তুলনাটাও বোধ হয় ঠিক হলো না। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সেঞ্চুরির শুরুতে রীতিমতো নড়বড়ে ছিলেন, গায়ানায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাপড়ি মেলতেও সময় নিয়েছেন। আর কাল শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, এটা তাঁরই দিন। আর এটা তো এত দিনে সবারই জানা, আশরাফুলের দিন মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে লাল অক্ষরে লিখে রাখার মতো আরেকটি দিন।
কালকের ৫৭ বলে ৭০ তার বদলে উল্টো আক্ষেপের কারণ হয়ে গেল! ওরামকে পুল করে সোজা ডিপ মিড উইকেট ফিল্ডারের হাতে বল তুলে দিয়ে আশরাফুল ফিরে যাওয়ার পর দেখতে না দেখতেই প্রথম ওয়ানডে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের চিরাচরিত চেহারায়! পুরো ইনিংসে আশরাফুলের ওই একটিই ভুল। আর সেই ভুলটাকে আরও বড় বানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েই যেন নামলেন পরের ব্যাটসম্যানরা।
আশরাফুলের বিদায়ে বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ১৫০। ৩.২ ওভারের মধ্যে মাত্র ৪ রান যোগ করতেই বাংলাদেশের মিডল অর্ডার বলতে আর কিছু থাকল না। সাকিব, মেহরাব ও মুশফিকুরের কল্যাণে(!) ৩ উইকেটে ১৫০ থেকে চোখের পলকে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ১৫৪! সেখান থেকে দু শ’ও তো হলো রাজ্জাকের ধুমধাম কিছু বাড়ি লেগে যাওয়ায়।
আশরাফুলের আগেই ফিরেছেন তামিম। ফিফটি হওয়ার পর অভিনন্দন জানিয়ে তাঁকে বেশ সময় ধরে কী যেন বোঝালেন আশরাফুল। ‘এখনো অনেক কাজ বাকি’—এটাই হবে। তামিম যে বোঝেননি, তা বোঝাতে একদমই সময় নেননি। ৪০ রানে ভেট্টোরিকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মার্টিনের কল্যাণে নতুন জীবন পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই জীবনকে ১০ রানের বেশি অর্থবহ করে তুলতে পারলেন না তামিম। এর আগে ভেট্টোরিকেই মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মেরেছেন দুই ছক্কার প্রথমটি। ‘লাইফ’ পাওয়ার পর ওরামের বলে দ্বিতীয়টি লং অফের ওপর দিয়ে।
সেই ওরামেরই পরের ওভারে অফ স্টাম্পের বাইরের বলে চালিয়ে দিয়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ। যাতে শুধু বাংলাদেশের ইনিংসেরই নয়, ম্যাচেরও উজ্জ্বলতম অধ্যায়টির সমাপ্তি। তার পরও তখন অনুমান করা কঠিন ছিল, দল বেঁধে মাঠে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের উত্তাল করে তোলা আশরাফুল ও তামিমের ৯১ বলে ৯৭ রানের পার্টনারশিপটি ছাড়া এ ম্যাচে বাংলাদেশের মনে রাখার মতো আর কিছু থাকবে না। আশরাফুল যে তখনো ছিলেন।
নেমেই কাইল মিলসকে কভারের ওপর দিয়ে চোখধাঁধানো যে শটটি খেললেন, একটুর জন্য তা ছক্কা হয়নি। গিলেস্পির এক ওভারে দুটি চার ও একটি ছয়। একটি চার সেই স্কুপ—আশরাফুলস্ শট! আশরাফুলের এই মূর্তি দেখে ভেট্টোরি আর তৃতীয় পাওয়ার প্লেটা নেওয়ার সাহস পাননি। ২৫ ওভার শেষে রানরেট ঠিক ৫। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া সফরে আত্মবিশ্বাসের সবটুকু খুইয়ে আসা কিউই ব্যাটসম্যানদের জন্য অনতিক্রম্য একটা টার্গেট দাঁড় করিয়ে ফেলাটা তখন অবধারিত বলেই মনে হচ্ছিল। সেই ‘অবধারিত’ ব্যাপারটিই হলো না তামিমের মতো আশরাফুলও উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসায়।
ছোট মাঠ, ‘ড্রপ ইন পিচ’টা যেন ব্যাটসম্যানদের অর্ডারমতো বানানো। ২০১ যে এখানে কোনো ব্যাপারই নয়, তা প্রমাণ করার কাজটা করে ফেলেছে নিউজিল্যান্ডের ওপেনিং জুটিই। জেমি হাউ ও ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ৯০ রানের পার্টনারশিপেই লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তা। ১ উইকেট হারিয়েই ১৫৭ রান করে ফেলার পরও নিউজিল্যান্ডকে যে ‘মাত্র’ ৬ উইকেটে জিততে হলো, সেই কৃতিত্ব সাকিব আল হাসানের।
তবে তাঁর ৩ উইকেট শুধু ম্যাচটাকে আরেকটু দীর্ঘই করেছে, অনিশ্চয়তার কণামাত্রও ফিরিয়ে আনতে পারেনি।