কোচের কাজ খেলোয়াড়দের এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে তারা আগে কখনো যায়নি: জন বুকানন

টেস্ট না খেলেও অস্ট্রেলিয়ার কোচ!

উৎপল শুভ্র

৫ এপ্রিল ২০২১

টেস্ট না খেলেও অস্ট্রেলিয়ার কোচ!

জন বুকানন: কোচিং মানে শুধু খেলা নয়, খেলোয়াড়দেরও বোঝা।

টেস্ট খেলা দূরে থাক, তাঁর ফার্স্ট-ক্লাস ক্যারিয়ারের ব্যপ্তিই মাত্র সাত ম্যাচের। অথচ সেই তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম কোচদের একজন। প্রায় অজেয় সেই অস্ট্রেলিয়া দলের দিক নির্দেশক। কীভাবে তা সম্ভব? জন বুকাননের কাছ থেকেই উত্তরটা জানতে চেয়েছিলেন উৎপল শুভ্র।

প্রথম প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০০২। প্রথম আলো।

আশির দশকে এসি মিলানকে বিশ্বের সেরা ক্লাবে পরিণত করার পর ইতালির দায়িত্ব নেওয়া আরিগো সাচ্চি (উচ্চারণটা কি সাক্কি?) কোনোদিন শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবলই খেলেননি। সমালোচকরা মাঝে-মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করত এই তথ্যটা। ভেবে ভেবে সাচ্চি ভালো একটা উত্তর বের করেছিলেন, ‘ভালো জকি হওয়ার জন্য আপনার ঘোড়া হওয়ার প্রয়োজন নেই।’

‘ক্রিকেটের সাচ্চি’ জন বুকাননের এ রকম কিছু বলার প্রয়োজন পড়ছে না। সমালোচনা হলে না তার জবাব দেওয়ার প্রশ্ন আসে। ’৯৯-এর অক্টোবরে যখন অস্ট্রেলিয়া দলকে হাতে পেলেন, তখন দু ধরনের ক্রিকেটেই দলটি বিশ্বের এক নম্বর। সেই আধিপত্য আরো প্রশ্নাতীত হয়েছে বুকাননের আমলে। অথচ এক শর বেশি টেস্ট খেলা স্টিভ ওয়াহ-মার্ক ওয়াহকে যিনি ভুল ধরিয়ে দেন, সেই বুকানন টেস্ট খেলা দূরে থাক, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও খেলোয়াড় হিসেবে সেভাবে পাত্তা পাননি। কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে মাত্র ৭টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচই তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের সঞ্চয়।

বুকাননকে ইন্টারভিউ করার সময় এই তথ্যটা জানা ছিল না (মনে রাখতে হবে, এটা ২০০২ সাল, এক ক্লিকেই রেকর্ড-পরিসংখ্যান পেয়ে যাওয়ার দিন তখনো আসেনি)। জানা থাকলে টেস্ট খেলার কতটা কাছাকাছি এসেছিলেন— এই প্রশ্ন করে তাকে লজ্জায় ফেলতাম না। ‘নো’ ‘নো’ বলে এমন বিব্রতের মতো হাসলেন যে, তাড়াতাড়ি পরের প্রশ্নে যেতে হলো। চোখে পুরু লেন্সের চশমা, ভারী গলা— ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়ও বুকাননের হাতে একতাড়া কাগজ।

বড় খেলোয়াড় হওয়ার একটা সমস্যাও বললেন। তাঁরা বেশির ভাগ সময় চিন্তা করে, ‘আমি এখানে কী করতাম?’ চিন্তা-ভাবনার সীমানাটা তাই ছোট হয়ে আসে।

টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো তা কাজে লাগতেও পারত বলছেন, তবে একই সঙ্গে যোগ করছেন, ভালো কোচ হওয়ার জন্য ভালো খেলোয়াড় হওয়াটা মোটেই অপরিহার্য কিছু নয়। কোচিংটা শুধুই খেলা বোঝা নয়, খেলোয়াড়দের বোঝা, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তাটা ক্রমশই বড় করা। কেউ ১০০ টেস্ট খেলেছে বলেই তা পারবে, ব্যাপারটা এমন নয়। বড় খেলোয়াড় হওয়ার একটা সমস্যাও বললেন। তাঁরা বেশির ভাগ সময় চিন্তা করে, ‘আমি এখানে কী করতাম?’ চিন্তা-ভাবনার সীমানাটা তাই ছোট হয়ে আসে।

বুকাননের সেই সমস্যা নেই। নিজে কী করতেন, এটা তো তাঁর বিবেচনায় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যেখানে তারা আগে কোনোদিন পা রাখেনি, দলের খেলোয়াড়দের এমন একটা স্তরে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটাই তাঁর কোচিং দর্শনের মূল মন্ত্র, ‘আমার কাজই হলো খেলোয়াড়দের চ্যালেঞ্জ করা। তারা যেভাবে খেলে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করা। যখন আমি দায়িত্ব ছাড়ব, তখন যদি সবাই তাদের স্ব-নির্ধারিত সীমানা ভেঙে একটু হলেও এগিয়ে থাকে, তাহলেই আমি সফল। আমার কাজ সব সময় প্রশ্ন করা— কেন আমরা এটি এভাবে করছি? কেন ওভাবে করছি না? কীভাবে করলে সবচেয়ে ভালো হয়? ।’

বুকানন বিশ্বাস করেন, খেলোয়াড়রা নিজেরাই তাদের সবচেয়ে বড় কোচ। তাদেরকেই নিজের খেলা সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলে কোচের কাজ কী? কোচের কাজ হলো, খেলোয়াড়েরা যাতে তা জানতে পারেন, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

বুকানন বিশ্বাস করেন, খেলোয়াড়দের নিজেদের খেলাটা জানার পরিবেশ সৃষ্টি করাই কোচের সবচেয়ে বড় কাজ। সেই বিশ্বাসের সফল বাস্তবায়নেই জিতেছেন দুটি বিশ্বকাপ। ছবি: এএফপি

এর বাইরেও পুরো দল মাঠে কোন তালে বাজবে, সেটি ঠিক করে দেওয়াটাও কোচেরই কাজ। এই কোচিং দর্শনই সাধারণ খেলোয়াড় জন বুকাননকে পরিণত করেছে অসাধারণ কোচে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের একটি রহস্য ঘুচিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উত্থান তাঁর। বড় ক্রিকেটার কম জন্মায়নি কুইন্সল্যান্ডে, তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে গ্যারি সোবার্স, ব্যারি রিচার্ডস, ইমরান খানের মতো সর্বকালের সেরাদের যোগ করেও শেফিল্ড শিল্ড জিততে পারেনি। বুকানন দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো সে জন্য। ’৯৪-৯৫ মৌসুমে বুকানন দায়িত্ব নিতেই কুইন্সল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন। কুইন্সল্যান্ডের কোচ থাকার সময়ই বিখ্যাত সেই কম্পিউটার প্রোগ্রামটি তৈরি করেন বুকানন। ব্যাটসম্যানরা কোথায় শট খেলছেন, বোলাররা কোথায় বল করছেন জানতে যা এখন বিশ্বের সব দল ব্যবহার করে, যা আপনারা দেখেন টেলিভিশনে।

শুধু প্র্যাকটিস পরিচালনা করা থেকে বড় বড় হতে হতে  ক্রিকেট কোচের কাজ এখন আরও অনেক ব্যপ্ত। তা আরও বাড়বে বলেই বিশ্বাস বুকাননের। ফুটবল, বাস্কেটবলের মতো অল্প সময়ের খেলাগুলোতে অধিনায়ককে শারীরিকভাবে খেলায় এত বেশি মগ্ন থাকতে হয় যে, খেলা নিয়ে ভাবাটা কঠিন। ক্রিকেটে অধিনায়ক ওভারের মাঝে বা ড্রিঙ্কসের সময় ভাবার সুযোগ পান। ক্রিকেট কোচের তাই ফুটবল কোচদের মতো হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ওয়ানডে যথেষ্টই দ্রুত তালে চলে, তাই এখানে কোচের আরও বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলে বুকাননের বিশ্বাস। গত বিশ্বকাপে হানসি ক্রনিয়ের কানে ইয়ার-ফোন দিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন বব উলমার। বুকানন মনে করেন, আপাতত নিষিদ্ধ এই ব্যাপারটি এক সময় হয়তো আইনসিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×