শুধু মুখের শব্দেই নয়, শাহাদাতের বোলিংয়েও সমস্যা হতো জয়াবর্ধনের

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ২০০৭

উৎপল শুভ্র

২৯ এপ্রিল ২০২১

শুধু মুখের শব্দেই নয়, শাহাদাতের বোলিংয়েও সমস্যা হতো জয়াবর্ধনের

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্ট ইতিহাসে দুই দলের নির্দিষ্ট কোনো ব্যাটসম্যান ও বোলারের মধ্যে সবচেয়ে ঝাঁজালো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বললে এখনো আমি বলব সেটি জয়াবর্ধনে বনাম শাহাদাত। আশরাফুল-মুরালি একটা লড়াই-ও ছিল বটে, তবে তা এমন আগুনের ফুলকি ছড়ায়নি। জয়াবর্ধনে-শাহাদাতের সেই লড়াইয়ের গল্প আছে এখানে, সঙ্গে সাঙ্গাকারা নামে এক ব্যাটিং গ্রেটের দর্শন।

প্রথম প্রকাশ: ৫ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।

শাহাদাত হোসেনের মধ্যে অদ্ভুত একটা সারল্য আছে। কোনো ভণিতা নেই। যা মনে হয়, পরিষ্কার বলে দেন। কাল সংবাদ সম্মেলনে এসেও তা-ই বললেন।

প্রশ্ন: মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে আবার ঝামেলা হলো?

শাহাদাত: ও আমার বল খেলতে পারে না বলে এমন করে। আমি অন্য দলের বিপক্ষেও খেলেছি, আর কোনো ব্যাটসম্যান এ ব্যাপারে অভিযোগ করে না। শুধু ও-ই করে। আজ আমি তেমন শব্দই করিনি। তার পরও ও আপত্তি করেছে। তবে আজ আম্পায়ার আমার পক্ষে ছিল।

প্রশ্ন: জয়াবর্ধনের সঙ্গে কী কথাবার্তা হলো?

শাহাদাত: ও আমাকে গালি দিয়েছে। আমিও দিয়েছি।

প্রশ্ন: জয়াবর্ধনের উইকেটটি পেয়ে তা হলে খুব খুশি?

শাহাদাত: খুব খুশি। ওর উইকেটটি নেবই—এমন একটা প্রতিজ্ঞা ছিল।

মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে শাহাদাতের ঝামেলাটা অনেক পুরোনো। যা শুরু হয়েছিল দুই বছর আগে এই শ্রীলঙ্কা সফর থেকেই। বোলিং করার সময় মুখ দিয়ে শব্দ করাটা শাহাদাতের অভ্যাস। ব্যাটিং করতে নেমে জয়াবর্ধনের প্রথম কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে এ নিয়ে আপত্তি করা। এসএসসিতে প্রথম টেস্টেও করেছেন। কাল পি সারাতেও করলেন। এর আগেই শাহাদাত তাঁকে প্রথম বলটি দিয়েছেন প্রায় বিমার। জয়াবর্ধনে আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ করার পর দ্বিতীয় বলে বাউন্সার। ওই ওভারেই শাহাদাতের আরেকটি বাউন্সারে পুল করে বাউন্ডারি মেরে জবাব দিয়েছিলেন জয়াবর্ধনে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই টেস্ট ম্যাচে জয়াবর্ধনে আর শাহাদাতের এই লড়াই-ই যা কিছু উত্তেজনার জোগান দিল। জয়াবর্ধনের উইকেটটি পেয়ে শাহাদাত তো ‘খুব খুশি’ হবেনই।

জয়াবর্ধনে যে এটাকে ব্যক্তিগত লড়াই হিসেবে নিয়েছেন, এর প্রমাণ শ্রীলঙ্কার আর কোনো ব্যাটসম্যান এ ব্যাপারে অভিযোগ করেননি। কুমার সাঙ্গাকারা অবশ্য জয়াবর্ধনেরই পক্ষ নিলেন, ‘বোলার বল করার সময় স্টেডিয়ামে মাইকে কোনো ঘোষণা হলে আম্পায়ার খেলা থামিয়ে দেয়। ব্যাটসম্যান যখন মনোসংযোগ করে, তখন শব্দে তাঁর সমস্যা হতেই পারে। হঠাৎ শব্দ শুনে তাঁর মনে সংশয় জাগতে পারে, আম্পায়ার নো বল ডাকল কি না। ব্যাটসম্যান বলটা কী হবে, তা বোঝার জন্য বোলারের প্রতিটি জিনিস খেয়াল করে। শব্দ কম-বেশি থেকে তাঁর মনে হতে পারে, এটা বোধ হয় স্লোয়ার, এটা হয়তো বাউন্সার।’

২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কায় একতরফা টেস্ট সিরিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ ছড়িয়েছিল জয়াবর্ধনে-শাহাদাত লড়াই। ছবি: গেটি ইমেজেস

দিনের খেলাশেষে জয়াবর্ধনেকে হোটেলের লিফটে পেলাম। বোলিংয়ের সময় শাহাদাতের মুখে শব্দ করা নিয়ে শুধু তিনিই আপত্তি করছেন কেন, এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, 'এটা ক্রিকেটের আইনবিরুদ্ধ। বোলার এমন আওয়াজ করলে ব্যাটসম্যানের মনোসংযোগে সমস্যা হয়। কোনো বোলারই এটা করতে পারে না।'

কথাগুলে বলার সময় জয়াবর্ধনের চোখমুখ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, শাহাদাত ভীষণ এক অন্যায় করে ফেলছেন। তবে সাঙ্গাকারার কথায় মোটেই তেমন ঝাঁজ নেই। বরং তিনি শাহাদাতের দিকটাও দেখছেন, ‘আমি বুঝি, একজন ফাস্ট বোলার সর্বশক্তিতে বোলিংয়ের সময় অমন একটু শব্দ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে যেতেই পারে।’ জয়াবর্ধনের আপত্তির আসল কারণটাও বেরিয়ে পড়ল তাঁর কথা থেকে, ‘ও তখন খুব আক্রমণাত্মক বোলিং করছিল। প্রচণ্ড গতিতেও।’

সাঙ্গাকারার তাতে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়নি। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর কোনো সেঞ্চুরি ছিল না, সেই ঝাল মেটালেন অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরি করে। প্রথম টেস্টে মাত্র ৬ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, সেটা যে তাঁকে পোড়াচ্ছিল, সাঙ্গাকারা নিজেই তা বললেন, ‘প্রথম টেস্টে রান পাইনি বলে খুব রাগ হয়েছিল। এবার তাই বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। এটা আমার সেরা সেঞ্চুরি নয়, শুরুর দিকে সমস্যা হচ্ছিল। অন্য সময়ের মতো আমি বোলারদের ওপর চড়াও হইনি বললেই চলে। পুল তো বলতে গেলে মারিইনি। আমার লক্ষ্য ছিল শুধু উইকেটে থাকা। তিন সেশন ব্যাট করা। আমি জানতাম, তিন সেশন ব্যাট করলে আমার সেঞ্চুরি হবেই।’ 

টেস্টে তাঁর ত্রয়োদশ সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি পঞ্চম। সেঞ্চুরি করলে সেটিকে বড় বানিয়ে ফেলাটা সাঙ্গাকারার অভ্যাস। সেটি এমনই যে, তাঁর সেঞ্চুরি-ইনিংসগুলোর গড় ১৭৯.০৭! শুধু ডন ব্র্যাডম্যান (১৮৫.৯৬) ও জহির আব্বাসই (১৭৯.৮৩) এ ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে এগিয়ে। সেঞ্চুরি করার পর ৫টি ইনিংসে অপরাজিত ছিলেন সাঙ্গাকারা, সেটি বিবেচনায় নিলে তাঁর সেঞ্চুরি-ইনিংসগুলোর গড় দাঁড়ায় ২৯১! এ ক্ষেত্রেও সাঙ্গাকারা ব্র্যাডম্যানের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমন লম্বা ইনিংস খেলার গোপন মন্ত্রটা কী? সাঙ্গাকারার ব্যাখ্যা খুব সরল, ‘আমি নেটেও অনেকক্ষণ ব্যাটিং করি। ম্যাচেও অনেকক্ষণ ব্যাটিং করতে চাই।’

কুমার সাঙ্গাকারা: সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্যর্থতার পর ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন পরের দুই টেস্টেই। ছবি: অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট

যেকোনো ব্যাটিং-কীর্তির তুলনাই শেষপর্যন্ত ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গেই করতে হয়। তবে কুমার সাঙ্গাকারার এই বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতা মনে করিয়ে দিচ্ছে আরেক শ্রীলঙ্কানকে। মারভান আতাপাত্তু। তাঁর কাছেও ঋণ আছে সাঙ্গাকারার, ‘মারভান প্রথম ৬টি টেস্ট ইনিংসে ৫টি শূন্য মেরেছিল। এমন একটা শুরুর পর ফিরে এসে ৬টি ডাবল সেঞ্চুরি করা ওর অসম্ভব মনের জোরের প্রমাণ। আমার মনে আছে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ডাবল সেঞ্চুরি করার সময় ও একটা পুলও মারেনি। একের পর এক শট বল এসেছে, আর ও ডাক করেছে।’

মারভান আতাপাত্তু যদি বড় ইনিংস খেলার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে, সর্বশেষ সেঞ্চুরিটির জন্য চামিন্ডা ভাসের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চান সাঙ্গাকারা। ক্রিকেটে যে শেখার কোনো শেষ নেই, একজন ব্যাটসম্যান বোলারের কাছে শিখতে পারে, বোলার ব্যাটসম্যানের কাছে—এর প্রমাণ দিয়ে সাঙ্গাকারা বললেন, ‘প্রথম টেস্টে মাহেলা দারুণ ব্যাটিং করেছে। ও সব সময় তা-ই করে। ভ্যানডর্ট ও প্রসন্নও সেঞ্চুরি করেছে। কিন্তু আমার মনে লেগেছে চামিন্ডার সেঞ্চুরিটা। ও উইকেটে থাকার চেষ্টা করেছে। ওর কাছ থেকে আমিও এটা শিখেছি।’

এই সিরিজ বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি। সবাই যা বলেন, সাঙ্গাকারাও বললেন তা-ই, ‘বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সহজাত প্রতিভা আছে। কিন্তু ওদের উইকেটে থাকাটা শিখতে হবে। শিখতে হবে ইনিংসটিকে বড় করা।’

এ জন্য কুমার সাঙ্গাকারার চেয়ে ভালো শিক্ষক এখন আর বিশ্ব ক্রিকেটে নেই। তাঁর সঙ্গে ব্যাটসম্যানদের একটা সেশনের উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ দল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×