অস্ট্রেলিয়া-বধের পর বাংলাদেশের প্রথম জয়
বাঘের থাবায় সিংহ কাত
নামে-ভারে বড় দলকে এর আগেও হারিয়েছিল বাংলাদেশ, তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বগুড়ার জয়ের মাহাত্ম্য আলাদা। এর আগ পর্যন্ত দলটির নাম উচ্চারিত হতেই কালো ছায়া নেমে আসত বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চোখে-মুখে। এই একটি দল, যাদের বিপক্ষে ক্রিকেট-লড়াইয়ে বাংলাদেশের মনে রাখার মতো কিছু ছিল না, ছিল শুধুই লজ্জার ইতিহাস।
প্রথম প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। প্রথম আলো।
শ্রীলঙ্কা: ৪৯ ওভারে ২১২। বাংলাদেশ: ৪৭ ওভারে ২১৩/৬। ফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী।
ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের পুষ্পস্নান হয়ে গেল। ওপর থেকে যে তখন ঝরে পড়ছে ফুলের পাপড়ি। বাংলাদেশের ‘দৈত্য বধ’ এই প্রথম নয়, তবে এমন ফুলেল অভ্যর্থনা? এটাই প্রথম।
অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় আনন্দের দিনটি এসেছে দূর কার্ডিফে। সেখানে ফুল-টুল আনবে কে? দেশের মাটিতে এর আগে যা কিছু সাফল্য, সেগুলোও ফুল-টুল আনার অবকাশ দেয়নি। ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে অনিশ্চয়তা ছিল বাংলাদেশের জয় নিয়ে। কাল বাংলাদেশ এমনভাবেই জিতল যে, স্থানীয় সংগঠকরা ম্যাচ শেষ হওয়ার আধঘণ্টা আগেই চলে যেতে পারলেন ফুলের দোকানে।
দু'ওভার বাকি থাকতে ৪ উইকেটের জয়—অথচ ওভার আরও বেশিও অব্যবহৃত থাকতে পারত, জয়ের ব্যবধানও বড় হতে পারত আরও। আর বাংলাদেশের এমন দাপুটে জয় কাদের বিপক্ষে! শ্রীলঙ্কা—যে নামটি উচ্চারিত হতেই কালো ছায়া নেমে আসত বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চোখে-মুখে। এই একটি দল, যাদের বিপক্ষে ক্রিকেট-লড়াইয়ে বাংলাদেশের মনে রাখার মতো কিছু ছিল না, ছিল শুধুই লজ্জার ইতিহাস। কাল বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দল শুধু সে সব দুঃস্বপ্নকে কবরই দিল না, একই সঙ্গে পুরো দেশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিল একটা বার্তাও। আমাদের ওপর আস্থা হারিও না, আমরাও খেলতে পারি।
সেটিই যে বাংলাদেশ দলের বড় সমস্যা। সিরিজের প্রথম ম্যাচে বোলারদের সাফল্যও ব্যাটসম্যানদের শোচনীয় ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এমনই ব্যর্থ হয়েছিল যে, নতুন আন্তর্জাতিক ভেন্যু হওয়ার আনন্দ ভুলে গিয়ে বগুড়ার মানুষজন পর্যন্ত মুখর হয়ে উঠেছিল সমালোচনায়। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়দের নামিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এমন কথা তো হাবিবুলদের শুনিয়ে শুনিয়েই বলছিলেন অনেকে। কাল তাই জয়ের পর বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে যত না উৎসব হলো, তার চেয়ে বেশি হলো এসব সমালোচনার বিরুদ্ধে অগ্ন্যুৎপাত।
মুখে অবশ্য তাদের আর কিছু না বললেও চলত। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা হলো, সেটিই তো যা বলার বলে দিয়েছে। সকালে টস জেতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ যা চেয়েছে, তা-ই তো হয়েছে। নতুন বলে অসাধারণ বোলিং করেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সৈয়দ রাসেল। সনাৎ জয়াসুরিয়া উইকেটে, অথচ প্রথম ১০ ওভারে স্কোরবোর্ডে ১৯ রান! ১২ ওভারে ২৬! মাশরাফির জায়গায় এসে নাজমুলের প্রথম দুই ওভারেই ২৭ রান দিয়ে দেওয়ার ওই সময়টুকু বাদ দিলে বাংলাদেশের বোলারদের ওপর শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের চড়াও হওয়ার ঘটনাই তো ঘটল না। শুধু কি নিয়মিত বোলাররা, অলক কাপালি ও আফতাব আহমেদের মতো পার্ট টাইমাররাও নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের এক প্রদর্শনী সাজিয়ে বসলেন। উইকেটও নিলেন। ফিল্ডিংটাও হলো বোলিংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মিড উইকেটে হাবিবুল যে ক্যাচটি নিয়ে ফারভিজ মাহরুফকে ফিরিয়ে দিলেন, সেটি মনে করিয়ে দিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচটির কথা। ডিরেক্ট থ্রোতে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের এত বার উইকেট ভাঙার ঘটনাও এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

৩৫৬ ওয়ানডের অভিজ্ঞতার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে এক সনাৎ জয়াসুরিয়াই যা গলার কাঁটা হয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। আগের দিনই রসিকতার ছলে মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ বড় বড় সব দলকে হারালেও শ্রীলঙ্কাকে একবারও হারাতে পারেনি। ৯৬ রানে আউট হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই বড় দুঃখ নয়, তবে পরাজয়টা জয়াসুরিয়ার এমনই বুকে বিঁধেছে যে, ম্যাচ রেফারির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনের বদলে সংবাদ সম্মেলনে আসার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন।
কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়া-বধের পর এটাই বাংলাদেশের প্রথম জয়। শুধু সে কারণেই কার্ডিফের কথা মনে হলো না, আফতাবের ছক্কাও যে মনে করিয়ে দিল তা। কার্ডিফে গিলেস্পির বলে ছক্কার সঙ্গে কাল রুচিরা পেরেরার বলে ছক্কাটির অদ্ভুত মিল। দুটিই মিড উইকেটের ওপর দিয়ে এবং কার্ডিফের মতো বগুড়াতেও আফতাবের ছক্কাতেই সব অনিশ্চয়তার অবসান। ২১ বলে ৩৩ রান করে আফতাব ম্যান অব দ্য ম্যাচ একজন কাউকে পুরস্কারটা দিতে হয় বলেই। নইলে বাংলাদেশের এই জয় টিম ওয়ার্কের এক ডকুমেন্টারি। বোলাররা তাদের কাজ করেছেন। জাভেদ ওমর ও শাহরিয়ার নাফিস গড়ে দিয়েছেন শুরুর ভিত্তিটা। এরপর কার্ডিফের মতোই আশরাফুল আর হাবিবুলের জুটি আস্তে আস্তে দীর্ঘতর করে দিয়েছে ম্যাচে বাংলাদেশের ছায়াটাকে।

পরপর দুই ওভারে দুজনই অকারণে বিগ হিট নিতে গিয়ে আউট হয়ে যাওয়ার পরও কাজ অনেকটাই বাকি ছিল। আশরাফুল যখন আউট হলেন, বাকি ৬৯ বলে প্রয়োজন তখন ৫৭ রান। মাত্র ৬.১ ওভারে ৫১ রানের জুটিটিই সহজ করে দিল এই সমীকরণ। সেই জুটিতে আফতাবের সঙ্গী কে জানেন? অলক কাপালি!
আগের ম্যাচে ডেভ হোয়াটমোর যাঁকে নয় নম্বরে নামিয়েছিলেন! ক্যারিয়ারের শুরুতে যা তাঁকে আলাদা করে দিয়েছিল, কাল আবার সেই ঠাণ্ডা মাথার প্রমাণ রেখে অলকের ২৩ বলে ১৮ রান। এমনিতে এমন কিছু নয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিচারে এই জয়ের মতোই অমূল্য।
 আরও পড়ুন: বগুড়ায় সেই জয়ের আগের দিন...
                     মধুর বিড়ম্বনা



										
										
										
										
										
										

            




