সাকিবের বাঁ হাতই জেতাল বাংলাদেশকে

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমের অভিষেক ম্যাচ

উৎপল শুভ্র

২৪ মে ২০২১

সাকিবের বাঁ হাতই জেতাল বাংলাদেশকে

তামিম ইকবালের আন্তর্জাতিক অভিষেকে বাংলাদেশের জয়ে বড় ভূমিকা ছিল সাকিব আল হাসানের

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিম ইকবালের অভিষেক ২০০৭ সালের জিম্বাবুয়ে ট্যুরে ওয়ানডে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে। করেছিলেন ৫ রান। বাংলাদেশের জয়ে বড় ভূমিকা ছিল সাকিবের। বাঁহাতি স্পিনে ২৯ রানে ১ উইকেট নেওয়ার পর বাঁ হাতের থ্রোতেই তিন-তিনটি রান আউট! যদিও ম্যাচের সেরার স্বীকৃতি তিনি পাননি, ৬৯ রানের ইনিংসের জন্য তা পেয়েছিলেন আরেক বাঁহাতি শাহরিয়ার নাফীস।

প্রথম প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। প্রথম আলো।

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২২৮/৯। জিম্বাবুয়ে: ৪৯.৪ ওভারে ২১৪। ফল: বাংলাদেশ ১৪ রানে জয়ী

নিজের পরিচয় দেন তিনি এভাবে: ‘ক্রিকেটে যা কিছু করি, তার সবই বাঁ হাতে। এর বাইরে আমি ডানহাতি।’ শুধুই ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ সেই বাঁ হাতই বাঁচিয়ে রাখল জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন। প্রথমে বাঁহাতি স্পিনে ১০ ওভারে ২৯ রান দিয়ে ১ উইকেট, এরপর বাঁ হাতের থ্রোতেই তিন-তিনটি রান আউট! সাকিব আল হাসানের বাঁ হাতই তো কাল ১৪ রানের জয় এনে দিয়ে ২-১ ম্যাচে সিরিজে এগিয়ে দিল বাংলাদেশকে।

তারপরও ম্যান অব দ্য ম্যাচ সাকিব নন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইউনিয়নের মিডিয়া ম্যানেজার লাভমোর বান্ডা ম্যান অব দ্য ম্যাচ হিসেবে হাবিবুল বাশারের নাম ঘোষণা করার পর হাবিবুল নিজেই সবচেয়ে অবাক। পুরস্কারটা নিয়ে সতীর্থদের মধ্যে ফেরার পর মুখে গর্বের পরিবর্তে লাজুক হাসি। ব্যাটিংয়ে ৩১ রান, এরপর মিড উইকেটে অনেকটা লাফিয়ে এক হাতে সিবান্দার যে ক্যাচটি ধরেছেন, সেটি সেরা ক্যাচের যেকোনো প্যাকেজে জায়গা পাওয়ার মতো। ২৮তম ওভারে জিম্বাবুয়ে ২ উইকেটে ১২৪, সেখান থেকে যে তারা ২১৪ রানে অলআউট, তাতেও তো হাবিবুলের চতুর বোলিং পরিবর্তনের ভূমিকা আছে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হাবিবুল হতেই পারেন।

এবং তিনিও ম্যান অব দ্য ম্যাচ নন। পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে প্রেসবক্সে আসার পর লাভমোর বান্ডা জানালেন, ৬৯ রানের ইনিংসটির জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন আসলে শাহরিয়ার নাফীস। হাবিবুল ওই ক্যাচের জন্য পেয়েছেন ‘মোমেন্ট অব দ্য ম্যাচ’-এর পুরস্কার। শেষ মুহূর্তে কাগজপত্র পেয়ে উল্টোপাল্টা করে ফেলেছেন, ম্যানেজারের মাধ্যমে শাহরিয়ার নাফীসকে খবরটা দেওয়ার সময় হাবিবুলের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।

না চাইলেও কোনো সমস্যা হতো বলে মনে হয় না। ম্যাচ জয়ের পর হাবিবুলের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখলাম, তাতে অন্তত এদিন তাঁর কারও ওপরই রাগ করার কথা নয়। এক সময় হাত থেকে বেরিয়ে যেতে থাকা ম্যাচটায় যেভাবে ফিরে এসেছে তাঁর দল, ম্যান অব দ্য ম্যাচের চেয়ে সেটিকেই কালকের সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলে মানবেন বাংলাদেশ-অধিনায়ক। ডাফিন ও সিবান্দার উদ্বোধনী জুটিতেই ৯১, এরপর আরও প্রমত্ত হয়ে ওঠা সিবান্দার কল্যাণে ২ উইকেটে ১২৪—স্কোরবোর্ডের চেহারা বাংলাদেশকে ভয়ই দেখাচ্ছিল। হাবিবুলের ওই অবিশ্বাস্য ক্যাচই ঘুরিয়ে দিল ম্যাচ।

জিম্বাবুয়ে ট্যুরে রওনা হওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে তামিম ইকবাল। ছবিতে তাঁর সঙ্গে আছেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, মেহরাব জুনিয়র ও শাহরিয়ার নাফীস

ঢাকার শক্ত খটখটে মাঠে খেলে এসে হারারের নরম আউটফিল্ডে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছিল ফিল্ডিং নিয়ে। অথচ কাল সেই ফিল্ডিংই জেতাল। চার-চারটি রান আউট! ক্যাচও পড়েনি। প্রথম দুই ম্যাচে উইকেটের পেছনে নড়বড়ে মনে হওয়া মুশফিকুর রহিমও একটা স্টাম্পিং করলেন!

বাংলাদেশের জন্য এটি দারুণ ফিরে আসাই। বোলারদের কেউই যে ভালোভাবে শুরু করতে পারেননি! মাশরাফির প্রথম বলটিই লেগ সাইডে, তাতে গ্লান্স করে চার মেরেছেন ডাফিন। তাপস প্রথম বলটিই করলেন ওয়াইড। রাজ্জাক প্রথম ওভারে দিলেন ৭, আর পাঁচ বছর পর প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে মোহাম্মদ শরীফের দুঃস্বপ্নের মতো প্রথম ওভারে এল ১৬ রান!

শরীফের জন্য শেষ পর্যন্তও দিনটি দুঃস্বপ্নই হয়ে থেকেছে। নো বল করেছেন ৭টি, কুঁচকিতে ব্যথা অনুভব করায় ওভার অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে যেতে হয়েছে মাঠ ছেড়ে। ১টি উইকেট পেলেও ৯.৫ ওভারে দিয়েছেন ৫৩ রান। তবে মাশরাফি ও তাপস বাজে শুরুর পর দারুণভাবে ফিরে এসেছেন। মাশরাফির বাজে শুরু বলতে অবশ্য ওই প্রথম বলটাই। ৬-১-১২-০ তাঁর প্রথম স্পেল। শেষ পর্যন্ত ১০ ওভারে ৩২ রানে ১ উইকেট। সেটিও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (যখন জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ২০ বলে ২৫ রান) চিগুম্বুরার গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি। তাপস ৮ ওভারের প্রথম স্পেলে ৪৫ রান দিয়ে ফেলার পর আসল সময়ে ফিরে তাঁর শেষ দুই ওভারে (৪৬ ও ৪৮তম) মাত্র ৫ রান দিয়ে তুলে নিয়েছেন দুটি উইকেট।

শেষ ১৫ ওভারে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল ৮৬ রান, শেষ ১০ ওভারে ৬৯। হাতে উইকেট থাকায় তা একেবারে অসম্ভব বলেও মনে হচ্ছিল না। ৪১ থেকে ৪৫—এই ৫ ওভারে ৩৯ রান তুলে ফেলে চিগুম্বুরা ও দাবেংওয়া শেষ ৫ ওভারে প্রয়োজনটা ৩০ রানে নামিয়ে আনায় ফেবারিট মানতে হচ্ছিল জিম্বাবুয়েকেই। হাতে যে তখনো তাদের ৫ উইকেট।

কিন্তু মাশরাফি ও তাপসের দারুণ বোলিং জিম্বাবুয়েকে আর জিততে দেয়নি। শেষ ওভারে যখন জিম্বাবুয়ের ১৮ রান প্রয়োজন পড়ল, অনেকেরই মনে পড়ে গেল গত আগস্টের ওই ম্যাচটি। ব্রেন্ডন টেলরের ব্যাটে বাংলাদেশের স্বপ্ন ছত্রখান হয়ে যাওয়া। কাল অবশ্য উইকেটে শেষ জুটি এবং তাঁদের কেউ স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান নন (ব্রেন্ট ও আয়ারল্যান্ড)। ওভারটিও মাশরাফি করলেন না। করলেন রাজ্জাক। প্রথম তিন বলে ২ রান দেওয়ার পরই আসলে ম্যাচ শেষ। চতুর্থ বলে দ্বিতীয় রান নিতে যাওয়া ব্রেন্টের রান আউটে জিম্বাবুয়েকে অলআউট করে দিয়ে আরও পূর্ণতা পেল বাংলাদেশের উৎসব।

এই থ্রোও সেই বাঁ হাত থেকে! সাকিব আল হাসানের বাঁ হাত!

আরও পড়ুুন: যে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমের যাত্রা শুরু

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×