সুখস্মৃতির সেই সোফিয়া গার্ডেনে

উৎপল শুভ্র

৯ জুন ২০২১

সুখস্মৃতির সেই সোফিয়া গার্ডেনে

এখন তো কার্ডিফ রূপকথা বললে পাল্টা প্রশ্ন আসে, `কোনটার কথা বলছেন?` তবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন মানে ছিল মোহাম্মদ আশরাফুল, সোফিয়া গার্ডেন মানে আফতাব আহমেদের সেই ছক্কা, সোফিয়া গার্ডেন মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমর এক রূপকথা। সেই মাঠে তাই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফিরে ফিরে আসছিল সেই স্মৃতি।

প্রথম প্রকাশ: ৮ জুন ২০১৭। প্রথম আলো।

স্পনসরদের দাবিতে স্টেডিয়ামের নাম বদলে এসএসই সোয়ালেক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে এখনো এটি সোফিয়া গার্ডেনই। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তো অবশ্যই।

সোফিয়া গার্ডেন নামটা এমনিতেও এসএসই সোয়ালেকের চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর। তবে পুরোনো নামটাই ধরে রাখার কাতরতা এ কারণে নয়। আপনিই বলুন না, এসএসই সোয়ালেক বললে কি সেই সুখস্মৃতি মনে আসে! মনে আসে ১২ বছর আগের কার্ডিফ! 

ভবিষ্যতে স্পনসর বদলাবে, সঙ্গে মাঠের নামও। বদলাতে থাক। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটির নাম সোফিয়া গার্ডেনই থেকে যাবে। এই নামটার সঙ্গে যে জড়িয়ে আবেগের এক গল্প। 

সোফিয়া গার্ডেন মানে মোহাম্মদ আশরাফুল, সোফিয়া গার্ডেন মানে আফতাব আহমেদের সেই ছক্কা, সোফিয়া গার্ডেন মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমর এক রূপকথা। ১২ বছর আগে এই মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিখ্যাত সেই জয়।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের প্রস্তুতি শুরুর আগে কার্ডিিফের সোফিয়া গার্ডেনে বাংলাদেশ দল। ছবি: উৎপল শুভ্র

সেই দলের একজনই আছেন এবার। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কাল সকালে মাঠে আসার পর যাঁর মনে হলো, ভুল করে অন্য কোনো মাঠে চলে এলেন কিনা! ১২ বছর আগের সেই সোফিয়া গার্ডেনকে যে চেনার কোনো উপায়ই নেই। বাংলাদেশের ওই ম্যাচের বছর দু-এক পর আগের স্টেডিয়াম ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। আগে মাত্র পাঁচ হাজার দর্শকের জায়গা হতো। এখন পনেরো হাজারের। ২০০৫ সালের সোফিয়া গার্ডেন ভিক্টোরিয়ান যুগের কথা মনে করিয়ে দিত। ছোট একটা মাঠ। কোনো আড়ম্বর নেই। মাঠের এক পাশে শুধু গ্যালারি। যেন ভিলেজ ক্রিকেট খেলার কোনো মাঠ। এখন যা চারপাশে গ্যালারিতে সাজানো ঝাঁ চকচকে আধুনিক এক স্টেডিয়াম।

সেটির পুরস্কার মিলেছে টেস্ট ভেন্যুর স্বীকৃতি পেয়ে। ২০০৯ সালে এখানে অ্যাশেজের টেস্ট হয়েছে। শততম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে আলাদা একটা মর্যাদাও পেয়ে গেছে এই মাঠ। মজাটা হলো, এর কোনোটাই এই মাঠের পরিচয় হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত নয়। ক্রিকইনফোতে মাঠের পরিচিতিতে গিয়ে দেখুন। যেখানে লেখা, এই মাঠেই হয়েছিল বিখ্যাত সেই ম্যাচ। যাতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছিল বড় এক অঘটনের। ওই ম্যাচের মহিমা তাহলে শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটেই আটকে নেই, এটি এই মাঠেরও বড় পরিচয়। 

সেই সোফিয়া গার্ডেনেই আগামীকাল বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড। যে ম্যাচ হঠাৎই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোর মধ্যে ঢুকে গেছে। যেটিতে জিতলে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলার একটা সম্ভাবনা জাগবে। ম্যাচটা তাহলে ভালো মাঠেই হচ্ছে!

আলিঙ্গনাবদ্ধ আশরাফুল-আফতাব, পেছনে বিস্ময়ে বিমূঢ় রিকি পন্টিং। ছবি: গেটি ইমেজেস

প্রেরণার এমনিতেই অভাব নেই। সোফিয়া গার্ডেন তাতে আরেকটা সংযোজন হতেই পারে। তামিম ইকবাল অবশ্য এমন কোনো ভাবালুতায় ভুগছেন না। ১২ বছর আগে কী হয়েছে না হয়েছে, তাতে যে কিছু আসবে যাবে না, তিনি তা ভালো করেই জানেন। অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে তামিম-সাকিবদের তুমুল আড্ডাতেও মাঠের প্রসঙ্গ খুব একটা এল না। সেই কৌতূহল হয়তো মাশরাফি ড্রেসিংরুমেই মিটিয়ে দিয়েছেন। সব ঠিক বলেছেন তো! নতুন চেহারার সোফিয়া গার্ডেন যে স্মৃতির বড় পরীক্ষা নিচ্ছে! 

ওই ম্যাচের দুটি ফ্রেম বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অমর ছবি হয়ে আছে। একটি সেঞ্চুরির পর আশরাফুলের উদযাপন। অন্যটি গিলেস্পিকে শেষ ওভারে আফতাবের ছক্কা। এক টিভি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মাশরাফি আফতাবের ছক্কাটা যেখানে পড়েছিল বলে আঙুল দিয়ে দেখালেন, সেটি নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে একটা তর্ক হয়ে গেল। ওই ম্যাচ কাভার করেছেন, এমন চারজন এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও আছেন। তাঁদের তিনজন কাল মাঠে। এই প্রতিবেদকও তাঁদের একজন। যাঁর স্মৃতি বলছে, মাশরাফি যেখানে দেখালেন, আফতাবের ছক্কাটা ছিল তার উল্টো দিকে। এর মীমাংসা কে করবে! 

সেবারও লন্ডন থেকেই কার্ডিফে এসেছিল বাংলাদেশ দল। সেটিও ম্যাচের ঠিক আগের দিন। সন্ধ্যা সন্ধ্যায় কার্ডিফে পৌঁছানোয় সেদিন কোনো অনুশীলন হয়নি। এমনকি মাঠটাও দেখেনি বাংলাদেশ দল। ম্যাচের দিন সকালেই সোফিয়া গার্ডেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। জেতার পর বাংলাদেশ দলে তাই একটা রসিকতাও চালু হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচের আগে মাঠ না দেখাটাই তো তাহলে ভালো! এরপর থেকে সরাসরি ম্যাচের দিন মাঠে চলে গেলেই হয়।

কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন, কিংবা এসএসই সোয়ালেক। ছবি: আইসিসি

বিশ্বের শুধু দুটি ক্রিকেট মাঠের নামের সঙ্গেই এই ‘গার্ডেন’ শব্দটা আছে। অন্যটি তুলনায় অনেক বেশি বিখ্যাত। কলকাতার ইডেন গার্ডেন। দুটিই সম্ভ্রান্ত দুই নারীর নামে নাম। দুটিই একসময় ‘গার্ডেন’ মানে বাগানই ছিল। 

বাগান অবশ্য এখানে এখনো আছে। একটু ছোট হয়ে গেছে এই আর কি! ক্রিকেট মাঠের পাশেই টাফ নদী। ‘সোফিয়া গার্ডেন’কে যদি আক্ষরিক অর্থে ধরেন, সেটি এই নদীর ওপারেই। গাছগাছালিতে সাজানো সেই বাগানে ঢুকলেই মনে একটা শান্তি-শান্তি ভাব আসে।
কার্ডিফ শহরটাতেও একটা শান্তি-শান্তি আবহ আছে। ছিমছাম-নিরিবিলি, একটু যেন আয়েশি ভাব। লন্ডনের মতো মেগা সিটি থেকে এলে যা আরও বেশি চোখে পড়ে। কদিন আগে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল উপলক্ষে এই শহরই লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। আবার যা ফিরে গেছে আগের রূপে। ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল আর রাগবি এখানে অনেক বেশি জনপ্রিয়। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল নিয়ে পুরো কার্ডিফ যেমন উন্মাতাল হয়ে উঠেছিল, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে তা নয়। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ নিয়ে তো আরও নয়। কার্ডিফবাসীর কল্পনাতেও আসবে না, এই ম্যাচ নিয়ে হাজার পাঁচেক মাইল দূরের এক দেশ কেমন উত্তেজনায় কাঁপছে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×