উইলিয়ামসনের দুঃখমোচন, তবে আসল জয়ী তো টেস্ট ক্রিকেট!

ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল

উৎপল শুভ্র

২৪ জুন ২০২১

উইলিয়ামসনের দুঃখমোচন, তবে আসল জয়ী তো টেস্ট ক্রিকেট!

টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ড

উইলিয়ামসনের হাতে টেস্ট ক্রিকেটে সেরার সেই প্রতীকী স্বীকৃতিটাকে শোভা পেতে দেখার পর থেকে সেটিকে মনে হচ্ছে `রাজদণ্ড`। সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, ওই রাজদণ্ডটা উইলিয়ামসনের চেয়ে আর কারও হাতে এত ভালো মানাত না। দুই বছর আগে বিশ্বকাপ ফাইনাল তাঁর সঙ্গে যে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছিল, সেই দুঃখও এখন আর আগের মতো পোড়াবে না। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ফাইনালে আসল জয়ী তো টেস্ট ক্রিকেট!

করোনার ভয়ে সাউদাম্পটনে চলে আসা ফাইনালটা লর্ডসে হলে হয়তো আরও ভালো হতো। কেন উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল যে নিষ্ঠুর খেলাটা খেলেছিল, সেই দুঃখ ঘোচানোর চক্রটা একেবারে সম্পূর্ণ হতো। তা হয়নি বলে উইলিয়ামসন কোনো আফসোস করছেন বলে মনে হয় না। 

লর্ডসে না হয়ে সাউদাম্পটনে হয়েছে, সাউদাম্পটনে না হয়ে যদি পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের অন্য কোনো মাঠেও হতো, তাতেও এমনই কিই-বা আসত যেত! দুই বছর আগের সেই ফাইনালের দুঃখ ঠিকই ভুলে যেতেন উইলিয়ামসন। বিশ্বকাপ জিতলে তা হতো নিউজিল্যান্ডের 'প্রথম', টানা দ্বিতীয় ফাইনালে সেই 'প্রথম'-কে মরীচিকার মতো মিলিয়ে যেতে দেখাটাই দুঃখে পোড়াতে যথেষ্ট ছিল। তা বুকে দাউ দাউ আগুন জ্বালিয়ে দিতে যোগ হয়েছিল ওই অদ্ভুত নিয়ম। যেটির কথা আগে কখনো শোনেইনি। ৫০ ওভার শেষে সমান স্কোর, সুপার ওভার শেষেও সমান, শেষ পর্যন্ত কম বাউন্ডারি মারার 'অপরাধে' কিনা বিশ্বকাপ ফসকে গেল হাত থেকে!

তা যদি না-ও হতো, নিউজিল্যান্ডই যদি জিতত সেই বিশ্বকাপ, তা তাদের 'প্রথম' হতো ঠিকই, বিশ্বকাপের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তো আর নিউজিল্যান্ডের নাম লেখা হতো না। আর এখানে, ইংলিশ সামারের পরম প্রার্থিত সোনালি আলোয় আলোকিত বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত এক ফাইনালের শেষ দিনে কেন উইলিয়ামসন যখন গদাসদৃশ ওই ট্রফিটা হাতে তুলে নিলেন, প্রায় দেড় শতাব্দী প্রাচীন টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম অফিসিয়াল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে গেল নিউজিল্যান্ডের নাম। 'গদাসদৃশ' কথাটা এর আগেও অন্য লেখায় ব্যবহার করেছি, উইলিয়ামসনের হাতে টেস্ট ক্রিকেটে সেরার সেই প্রতীকী স্বীকৃতিটাকে শোভা পেতে দেখার পর থেকে আর তা বলতে ইচ্ছা করছে না। বরং সেটিকে মনে হচ্ছে 'রাজদণ্ড'। সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, ওই রাজদণ্ডটা উইলিয়ামসনের চেয়ে আর কারও হাতে এত ভালো মানাত না।

কেন উইলিয়ামসন: প্রথম ইনিংসে ৪৯ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছেন

তার মানে এই নয় যে, বিরাট কোহলির হাতে তা বেমানান লাগত। ওয়ানডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে যত দ্রুতই এগিয়ে যান, আইপিএলে যতই তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হোক, টেস্ট ক্রিকেটটাকে হৃদয়ে ধারণ করেন কোহলি। গত কয়েক বছরে কথাবার্তায় টেস্ট ক্রিকেটকে সবার ওপরে তুলে রাখার কাজটাও তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। তারপরও তুলনাটা যখন উইলিয়ামসনের সঙ্গে হয়, তখন কেন যেন মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটের প্রতীক হিসেবে কোহলির চেয়ে এই কিউইকেই ভালো মানায়।

এই ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে কোহলি আর উইলিয়ামসনকে নিয়ে লিখতে বসে দুই অধিনায়কের মধ্যে তাঁদের দেশের প্রতিচ্ছবি আবিষ্কার করে নিজেই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। 'আবিষ্কার' বলছি ঠিকই, তবে তার মানে এই নয় যে, হঠাৎ করেই নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছিলাম। দুজনের বৈপরীত্য নিয়ে লিখতে বসার আগে জানা জিনিসগুলোই যখন একের পর এক সাজিয়ে নিচ্ছি, হঠাৎই কোহলির মধ্যে ভারতকে দেখতে পেয়েছিলাম, উইলিয়ামসনের মধ্যে নিউজিল্যান্ডকে। ব্যক্তিত্বে-চরিত্রে-ব্যাটিংয়ের ধরনে দুজন পুরোই বিপরীত, এটা তো আগেই জানা ছিল। তবে ভারত আর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও যে দুজনকে এমনভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, এই লাইনে কখনো ভাবিইনি।

টেস্ট ক্রিকেটকে হৃদয়ে ধারণ করেন বিরাট কোহলি

এ কারণেই মনে হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটকে যতই হৃদয়ে ধারণ করুন, ব্যক্তিত্ব বিবেচনায় বিরাট কোহলির সঙ্গে ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিই হয়তো ভালো যায়। উইলিয়ামসনের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেট। উইলিয়ামসনকে যতটুকু চিনি, তাতে এতেও মোটামুটি নিশ্চিত যে, চয়েস দিলে তিনিও হয়তো ওয়ানডের বিশ্বকাপের বদলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নের ওই রাজদণ্ডটাকেই বেছে নিতেন।

জয়ের সময় উইকেটে যে কেন উইলিয়ামসন ও রস টেলর, চাইলে এটারও তো প্রতীকী অর্থ খুঁজে নেওয়া যায়। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকার শুরুতেই এই দুটি নাম। চিরদিন বিশ্ব ক্রিকেটের 'মাঝারি' কাতারে পড়ে থাকা নিউজিল্যান্ডকে সবার ওপরে তুলে নেওয়ায় দুজনেরই অনেক বড় ভূমিকা।

জয়ের সময় উইকেটে যে রস টেলর ও কেন উইলিয়ামসন, চাইলে এটিরও তো প্রতীকী অর্থ খুঁজে নেওয়া যায়

নিউজিল্যান্ড জিতেছে, জিতেছেন কেন উইলিয়ামসন, এ কারণেই এ নিয়ে এত কথা বলে ফেললাম। তা বলতে গিয়ে কাণ্ড দেখুন, এই ফাইনালে আসল জয়ীর নামটাই এখনও বলা হয়নি। সেই জয়ীর নাম? টেস্ট ক্রিকেট! ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালে সন্দেহাতীত জয়ী তো ক্রিকেটের অপূর্ব এই ফরম্যাটই। যার সঙ্গে আর কোনো খেলার তুলনাই চলে না। পরতে পরতে অভাবিত কিছুর এমন পসরা সাজিয়ে বসে থাকে বলেই তো টেস্ট ক্রিকেট এমন অনন্য। ফাইনালের শেষ দিন চাওয়ার সবটুকু পূরণ করে দেওয়ায় টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা আরেকটু বেড়ে গেল। নিউজিল্যান্ডের জয় চাইনি, ভারতেরও না, চেয়েছিলাম টেস্ট ক্রিকেটের জয়। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টির এমন শত্রুতার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে নেই তো! 

সেটি আবার কেমন? ফাইনালের শেষ দিন নিয়ে কাল ভোর রাতে কী লিখেছিলাম, তা তুলে দিলেই প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে যাবেন, "নাটকীয় আর অভাবনীয় সব কাণ্ডের জন্য যে টেস্ট ম্যাচের এমন সুনাম, তা আরেকটু মহিমান্বিত করতেই বৃষ্টির এমন তৎপরতা নয় তো! দুদিন একটা বলও পড়তে পারেনি পিচে, তাতে কি! হিসাবমতো তো পাঁচ দিন চলে গেছে টেস্টের। পুরো খেলা হলে ৪৫০ ওভার হতো, হয়েছে এর অর্ধেকেরও কম। তারপরও অবিশ্বাস্যভাবে আজ শেষ দিনটা শুরু হচ্ছে সম্ভাব্য তিনটি রেজাল্টের সম্ভাবনা নিয়েই।"

প্রথম দিনের পর চতুর্থ দিনটাও বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর কজন ভেবেছিলেন, এই টেস্ট জয়-পরাজয়ের দেখা পাবে! বৃষ্টিকে শাপশাপান্ত করেছেন সবাই। সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি টেস্ট 'গ্রেট' সুনীল গাভাস্কার পর্যন্ত এই টেস্টকে নিশ্চিত ড্র ধরে নিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নিশিপের মীমাংসা হচ্ছে না বলে মন খারাপ করে ফেলেছিলেন। বিজয়ী নির্ধারণের জন্য ফুটবল ও টেনিসে যেমন টাইব্রেকার আছে, তেমন কিছু ভাবতেও তো বলেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেট এমনই, অভাবিত কিছু ঘটিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সবার বিস্ময় উপভোগ করে।

নিউজিল্যান্ড জিতেছে, ভারত হেরেছে..এসব তো মনে থাকবেই। তবে যতবার ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালটার কথা উঠবে, সব ছাপিয়ে আমার প্রথমেই মনে পড়বে আসল জয়ীর নাম। 

আহা, টেস্ট ক্রিকেট!   

আরও পড়ুন:

বৃষ্টির কল্যাণেই তো ক্রিকেটের অন্য রোমাঞ্চ
কোহলি-উইলিয়ামসন: লক্ষ্য এক, পথ ভিন্ন

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×