এই টেস্টে বাংলাদেশ ফেবারিট নয়!

উৎপল শুভ্র

৭ জুলাই ২০২১

এই টেস্টে বাংলাদেশ ফেবারিট নয়!

একমাত্র টেস্টের আগে ট্রফি নিয়ে দুই অধিনায়ক মুমিনুল হক ও ব্রেন্ডন টেলর

জিম্বাবুয়ে মানেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রানে ফেরার নিশ্চয়তা, বোলারদের ঝুরি ঝুরি উইকেট পাওয়ার, বাংলাদেশের জয়েরও। কিন্তু খেলাটা জিম্বাবুয়েতে হলে আর তা বলা যায় না। বরং ইতিহাস এর উল্টোটাই বলে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খারাপ সময়ে ইদানীং একটা রসিকতাকে খুব বাজার পেতে দেখি। সেটি হলো, জিম্বাবুয়েকে আমন্ত্রণ জানালেই তো হয়! তা হলেই আর কোনো চিন্তা নেই। ব্যাটসম্যানরা সেঞ্চুরিতে ফিরবেন, আর বোলাররাও টপাটপ উইকেট পেতে শুরু করবেন। বাংলাদেশের জয়ও গ্যারান্টেড। 

কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যাও নয়। জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশে ট্যুরে এলে কখনো-সখনো জিতবে, তবে বেশির ভাগ সময়ই হারবে। গত কয়েক বছরের ইতিহাস তো এমনই বলে। জিম্বাবুয়ের কাছে বাংলাদেশ হারলে চারপাশে একটা ‘হায়-হায়’ রবও উঠে যাবে। ২০১৮ সালে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে হারার পর যেমন উঠেছিল।

এসব যখন হয়, জিম্বাবুয়েকে নিয়ে যখন ওসব কথাবার্তা শুনি, আমি একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আমার মতো আরও হয়তো অনেকেই, যাঁরা জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সাক্ষী। জিম্বাবুয়েই যখন বাংলাদেশের কাছে ছিল ‘ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো’। বোলিং করার সময় অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে বাংলাদেশের বোলারদের কাছে শচীন টেন্ডুলকারের কাছাকাছি কিছু মনে হতো। ব্যাটসম্যানদের কাছে হিথ স্ট্রিককে গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো।

সেই সময়কার জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং আর বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় দুটি নামের কথা বললাম। এর বাইরেও তারকা-মর্যাদা পাওয়ার মতো ক্রিকেটারের অভাব ছিল না জিম্বাবুয়ে দলে। অ্যান্ডির ভাই গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, স্টুয়ার্ট কার্লাইল, স্ট্র্যাং ব্রাদার্স...এঁদের একটু পরের শন আরভিন, অ্যান্ডি ব্লিগনট...কিছুদিন আগের মারে গুডউইন ও নিল জনসনের কথাও হয়তো মনে পড়বে অনেকের।

সেই জিম্বাবুয়েকে বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হয়ে যেতে দেখাও চোখের সামনেই। হারারেতে একমাত্র টেস্ট ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের আরেকটি জিম্বাবুয়ের ট্যুরের শুরুতে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। জিম্বাবুয়েতে চারটি ট্যুর করেছি, ক্রিকেটের মতো দেশটিকেও ক্রমশ মলিনতর হয়ে যেতে দেখেছি। অথচ এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ২০০১ সালে প্রথম জিম্বাবুয়েতে গিয়ে কেমন চমৎকৃত হয়েছিলাম! হারারের কিছু কিছু জায়গায় গিয়ে তো এমনও মনে হয়েছিল, যেন ইউরোপের কোনো শহরে আছি। এরপর ২০০৪, ২০০৭, ২০১১...আরও তিনবার যাওয়া হয়েছে জিম্বাবুয়েতে। প্রতিবারই দেখেছি, অবস্থা আগের চেয়ে আরেকটু খারাপ হয়েছে। 

জিম্বাবুইয়ান ডলারকে ক্রমশ মূল্য হারাতে হারাতে এক বিলিয়ন ডলারের অবিশ্বাস্য নোটে পরিণত হতে দেখেছি। সর্বশেষবার গিয়ে তো দেখলাম, জিম্বাবুইয়ান ডলার বলতেই আর কিছু নেই, ইউএস ডলারই পরিণত হয়েছে সেদেশের 'স্থানীয়' মুদ্রায়। বিধ্বস্ত অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট দেখে অবধারিতভাবেই মনে পড়েছে ২০০১ সালে প্রথম ট্যুরের একটা ঘটনা। জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের প্রথম গ্রেট ব্যাটসম্যান ডেভ হটন হারারে শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে সামান্য একটু দূরে তাঁর ক্রিকেট একাডেমিতে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে। রাস্তায় ছোট একটা ইটের টুকরা, খোয়া বলাই ভালো, তা উঠে গিয়ে দেখা যায় কি যায় না এমন একটা ছোট্ট গর্ত হয়ে আছে। যা দেখে হটন আক্ষেপভরে বলেছিলেন, ‘দেখুন রাস্তার অবস্থা! আমার লজ্জা লাগছে।’

ঢাকা শহরে ভাঙাচোরা রাস্তা দেখে অভ্যস্ত আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এ আর এমন কি! আপনি বলার আগে আমি তো গর্তটা দেখতেই পাইনি।’

ডেভ হটন মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, ‘কী বলছেন! হারারে শহরের রাস্তায় এমন কিছু দেখে আমরা অভ্যস্ত নই।’

এক সময় নিশ্চয়ই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন হটনও। হারারেতে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটে যেমন, শুরুর হতাশা-দুঃখ ভুলে তেমনি ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের ওপর বাংলাদেশের ছড়ি ঘোরাতে দেখতেও। তবে ছড়ি ঘোরানো কথাটাতে একটা টীকার প্রয়োজন পড়ছে। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি সিরিজের সময় ওসব নিয়ে আলাপ করা যাবে। টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে যেহেতু লেখাটা লিখছি, আপাতত টেস্ট ক্রিকেটেই থাকি। ১৭ টেস্টে দুই দলেরই ৭টি করে জয়ে সমতা। তবে এই রেকর্ডকে একটু 'বাংলাদেশে এবং জিম্বাবুয়েতে' ভাগ করে নিলে?

জিম্বাবুয়েতে খেলা সাত টেস্টে বাংলাদেশের মাত্র একটিই জয়। ২০১৩ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়েতে দুই দলের সর্বশেষ টেস্টে

টেস্ট ক্রিকেট এবং জিম্বাবুয়েতে খেলা...এই দুটি মানদন্ড বিবেচনায় নিলে কিন্তু বাংলাদেশের ছড়ি ঘোরানোর কথাটা আর খাটে না। হারারে টেস্টে বাংলাদেশকে নিরঙ্কুশ ফেবারিট ঘোষণা করে দেওয়ারও কোনো উপায় থাকে না। জিম্বাবুয়েতে সাত টেস্ট খেলে বাংলাদেশ যে জিতেছে মাত্র একটিতেই। হেরেছে ৫টি। একমাত্র ড্রটা-ও তো বৃষ্টির আশীর্বাদে। জিম্বাবুয়ের মাটিতে বাংলাদেশের একমাত্র জয়টা অবশ্য সেখানে খেলা সর্বশেষ টেস্টেই। তা প্রায় আট বছর আগের কথা। ২০১৩ সালের সেই ট্যুরেই শুধু বাংলাদেশ জিম্বাবুয়েতে টেস্ট সিরিজ ড্র করে দেশে ফিরতে পেরেছিল।

তিনটি টেস্ট ট্যুরে দুটি করে ৬টি টেস্ট, শুধু ২০১১ সালের ট্যুরেই পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সঙ্গে এবারের মতোই ওয়ান-অফ টেস্ট। বাংলাদেশের বিপক্ষে এই হারারেতে সেই টেস্ট ম্যাচ দিয়েই চৌদ্দ মাসের নির্বাসন কাটিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরেছিল জিম্বাবুয়ে। ফিরেই হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। এতে অবশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও বড় দায় ছিল। টেস্ট ক্রিকেট থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনের সময়টাতে অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ ও দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলে ভালো প্রস্তুতি নিয়েই ফিরেছিল জিম্বাবুয়ে। যেখানে প্রায় চার মাস ক্রিকেটের বাইরে থাকা বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতির জন্য জিম্বাবুয়েতে গিয়ে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়া এক দলের বিপক্ষে নামমাত্র একটা ম্যাচই ছিল ভরসা। সেই টেস্টে পরাজয়ের সঙ্গে ওয়ানডে সিরিজেও ৩-২ ম্যাচে হেরে ফেরার পর বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালকে। অধিনায়কত্ব ও সহ-অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে আড়াল করা হয়েছিল বোর্ডের অপেশাদারত্বকে। যা হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহা বিতর্কিত এক অধ্যায়। (কী ছিল সাকিবের অপরাধ?)

বিতর্কের কথা বলতে গিয়ে ২০০৪ সালের জিম্বাবুয়ে ট্যুর থেকে মোহাম্মদ রফিককে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও মনে পড়ছে। (যে কারণে দেশে ফেরত পাঠানো হলো রফিককে)।     

শুধু বিতর্কই নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্মরণীয় অনেক কিছুর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে জিম্বাবুয়ে। যদি একটা তালিকা করে ফেলি, তাহলে কেমন হয়--

•    টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফর জিম্বাবুয়েতে (এপ্রিল, ২০০১)।

•    টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ সফরে আসা প্রথম দলও জিম্বাবুয়ে (নভেম্বর, ২০০১)।

•    টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশে প্রথম ড্র জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। যদিও ২০০১ সালের নভেম্বরে ঢাকায় সিরিজের প্রথম টেস্টে সেই ড্র পুরোটাই বৃষ্টির কল্যাণে। ২০০৪ সালে বুলাওয়েতে দ্বিতীয় ড্র-টাও তা-ই।

•   ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয়েও প্রতিপক্ষ এই জিম্বাবুয়েই (টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয়)

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয়ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। চট্টগ্রাম, ২০০৫। ছবি: শা. হ. টেংকু
    
এ তো গেল শুধু টেস্ট ক্রিকেট। ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন যুগের সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জিম্বাবুয়ে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর প্রায় পাঁচ বছর কোনো জয়ের মুখ দেখেনি বাংলাদেশ। জয়হীন টানা ৪৭টি ম্যাচের সেই ধারার অবসান জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটা জয় দিয়েই। ২০০৪ সালে সেই জয় এই হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠেই (পাঁচ বছর ও ৪৭ ম্যাচ পর সেই জয়)। 

পরে যা আরও অনেক বড় তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়। যখন বছর তিনেকের মধ্যেই বাংলাদেশ একে একে ভারত, অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় পায়। 

এসব তো আছেই, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোধ করার আরেকটা বড় কারণ তো শুরু থেকেই ছিল। টেস্ট পরিবারে বাংলাদেশের ইমিডিয়েট 'বড় ভাই' তো এই জিম্বাবুয়েই।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×