মাহমুদউল্লাহ শূন্য রানে আউট হলেও প্রশ্নগুলো থাকতই!

উৎপল শুভ্র

৯ জুলাই ২০২১

মাহমুদউল্লাহ শূন্য রানে আউট হলেও প্রশ্নগুলো থাকতই!

ড্রেসিংরুমে ফিরছেন অপরাজিত নায়ক। প্রায় দেড় বছর পর দলে ফিরে টেস্টে `বাতিল` মাহমুদউল্লাহ করেছেন অপরাজিত ১৫০ রান। ছবি: বিসিবি

টেস্ট ক্রিকেটে বাতিল বলে ঘোষিত মাহমুদউল্লাহ প্রায় দেড় বছর পর ঘটনাচক্রে আবার টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েই খেলেছেন ক্যারিয়ার-সর্বোচ্চ ইনিংস। এতে প্রশ্নটা বড় হয়েছে হয়তো, তবে মাহমুদউল্রাহ শূন্য রানে আউট হলেও কিন্তু প্রশ্নটা থাকতই। কারণ যে প্রশ্নটা তুলছি, সেটি রান করা না-করার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

টেস্ট ক্রিকেটে বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে কোনো ব্যাটসম্যানকে। প্রায় দেড় বছর পর বাধ্য হয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হবে, কারণ দলের মূল দুই ব্যাটসম্যান চোটের কারণে খেলতে পারবেন কি না ঠিক নেই। তাঁদের একজন ঠিকই খেলতে পারবেন না। ‘টেস্টে চলে না’ বলে সিল লাগিয়ে দেওয়া ওই ব্যাটসম্যান সুযোগ পেয়ে খেলে ফেলবেন ক্যারিয়ার-সর্বোচ্চ ইনিংস। 

সিনেমার চিত্রনাট্য হিসেবে দারুণ। কিন্তু বাস্তবে বোধ হয় গল্পটা একটু অবাস্তবই হয়ে যায়। কল্পনা ভালো, কিন্তু তা  লাগামছাড়া হলেই মুশকিল। কিন্তু ওই যে বলে না, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’, মাহমুদউল্লাহর গল্পটা সেটাকেই আবার সত্যি বলে প্রমাণ করেছে। সঙ্গে তুলে দিয়েছে কিছু প্রশ্নও।

সেই প্রশ্ন তোলার আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া মনে হয় জরুরি। হারারে টেস্টে মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত ১৫০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন বলে প্রশ্নটা হয়তো আরও বেশি ফণা তুলছে। কারণ এই ইনিংসটাই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলাদেশ টেস্ট দলে মাহমুদউল্লাহর জায়গা আছে। তাঁকে বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা কতটা অসার এবং অন্যায় ছিল, প্রমাণ করে দিয়েছে তা-ও।  

এবার অন্য একটা দৃশ্যকল্প কল্পনা করুন তো! মাহমুদউল্লাহ সুযোগ পেলেন এবং প্রায় দেড় বছর আগে তাঁর সর্বশেষ টেস্ট ইনিংসটার মতো প্রথম বলেই আউট হয়ে গেলেন। তখনো কিন্তু প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকতই। যে প্রশ্নটা আসলে মাহমুদউল্লাহকে আবার টেস্ট দলে ফিরিয়ে আনার সময়ই মনে জেগেছে। তা এরকম: যখন আমি/আমরা কোনো ক্রিকেটারকে টেস্ট ক্রিকেটে চলে না বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে তা জানিয়েও দেব, আমার/আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা তো তাঁকে বাদ দিয়েই আবর্তিত হবে। যাদেরকে আমি/আমরা টেস্ট দলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভাবছি, তাদের মধ্যে এক বা একাধিক ক্রিকেটারকে না পাওয়া গেলেও তাদের বিকল্প কোনোভাবেই ওই ‘বাতিল’ ঘোষিত ক্রিকেটার হবেন না, বিকল্প তো ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময়ই আমাদের হাতে বা মাথায় থাকবে।

আমার কথা কি বেশি জটিল মনে হচ্ছে? তাহলে একটু সহজ করে বলি। বাজে ফর্মের কারণে যেকোনো ক্রিকেটারই যেকোনো ফরম্যাট থেকে বাদ পড়তে পারেন। আবার নিজে ভালো খেলে বা অন্যদের ব্যর্থতায় অথবা জরুরি কোনো পরিস্থিতি দেখা দিলে আবার দলে ফিরতেও পারেন। মাহমুদউল্লাহও সেভাবে বাদ পড়লে বা ফিরলে কোনো প্রশ্নই উঠত না। বাদ পড়ার আগে চার টেস্টের আট ইনিংসে মাত্র একটা ফিফটি, এই যুক্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়াই যেত। 

মাহমুদউল্লাহর এই চিৎকার শুধু সেঞ্চুরির উল্লাস নয়, প্রতিবাদও। হারারে, ২০২১যদিও আরও পাঁচটা টেস্ট পিছিয়ে গেলেই দেখা যেত, সর্বশেষ চার টেস্টে খারাপ করার পরও ৯ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৪৪.২৬। ৩টি সেঞ্চুরি ও ১টি ফিফটি। সেই তিন সেঞ্চুরিও আবার চার টেস্টের মধ্যে। এর মধ্যে একটি হ্যামিল্টনের বাউন্সি উইকেটে নিউজিল্যান্ডের দুর্দান্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে হারারের আগে তাঁর টেস্ট-সর্বোচ্চ ১৪৬। একমাত্র ফিফটিটিও ওয়েলিংটনে পরের টেস্টে হ্যামিল্টনের চেয়েও বেশি ব্যাটিং-দুরূহ কন্ডিশনে। যে দুই টেস্টে আবার মাহমুদউল্লাহই ছিলেন বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়ক।

তার মানে আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে চারটি টেস্টে ব্যর্থ হলেও টেস্ট ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর অকার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো কারণই ছিল না। ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মামেন্ট’...ক্রিকেটের বহু পুরোনো আপ্তবাক্যটা মনে রাখা উচিত ছিল। তা মনে না রাখলেও বড়জোর বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়তে পারতেন। কিন্তু তাঁকে টেস্ট ক্রিকেট থেকেই ‘বাতিল’ ঘোষণা করাটা কোন যুক্তিতে?

মজাটা হলো, এই ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেনি। এর আগেও টেস্ট ক্রিকেটে ‘বাতিল’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে। চার টেস্টে ওই তিন সেঞ্চুরি প্রথমবার ‘বাতিল’ বলে ঘোষিত মাহমুদউল্লাহ আবারও দলে ফিরে আসার পরই। এটাও খুব কৌতূহলোদ্দীপক যে, মাহমুদউল্লাহ ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারকে নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাটে এভাবে বাতিল বলে ঘোষণা করার ঘটনা নেই। মুমিনুল অনেকদিন ধরে শুধুই টেস্ট ক্রিকেট খেলেন, কিন্তু কখনোই এটা আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়নি যে, তিনি আর কোনোদিনই সাদা বলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারবেন না।

মাহমুদউল্লাহর টেস্ট-যোগ্যতা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

আর কারও ক্ষেত্রে যা একবারও ঘটেনি, মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রে তা দুবার ঘটেছে। দুবারই তিনি সুযোগ পেয়েই ব্যাট হাতে জবাব দিয়েছেন। এর চেয়েও বিস্ময়কর মিল, দুবারই নির্বাচকেরা কাজটা করেছেন কোচের কাঁধে বন্দুক রেখে। প্রথমবার কোচের নাম চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, দ্বিতীয়বার রাসেল ডমিঙ্গো।

টেস্টে মাহমুদউল্লাহকে 'বাতিল' ঘোষণা করার প্রথম ঘটনা ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে বাংলাদেশের শততম টেস্টের আগে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে শুধু তা করেই ক্ষান্ত হননি, রীতি বহির্ভূতভাবে মাহমুদউল্লাহকে দেশেও ফেরত পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বোর্ডের হস্তক্ষেপে যদিও শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ পুরো দলের সঙ্গেই দেশে ফেরেন। নিয়তির কী খেলা, বছর না ঘুরতেই শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে বাংলাদেশ ট্যুরে এসে হাথুরুসিংহে দেখলেন, যাঁকে তিনি টেস্টে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন, সেই মাহমুদউল্লাহই বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক!

কোচ রাসেল ডমিঙ্গোই নাকি মাহমুদউল্লাহকে টেস্ট দলে চাননি

মাহমুদউল্লাহকে দ্বিতীয়বার টেস্টে ‘বাতিল’ ঘোষণা করার দায় বা কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে। তিনিই নাকি মাহমুদউল্লাহকে আর টেস্ট দলে চাননি। লাল বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার কথা ভুলে গিয়ে শুধু সাদা বল নিয়ে ভাবতেও বলে দিয়েছেন তাঁকে। পরপর দুজন বিদেশি কোচ কেন মাহমুদউল্লাহকে টেস্টে অনুপযুক্ত বলে ভাবলেন, তা একটা প্রশ্ন বটে। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তো আর তাঁদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।

আমার প্রশ্ন অন্য। কোচের মত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তিনি বললেই একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের একটা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে? নির্বাচকদের নিজেদের কোনো বিচার-বিবেচনা নেই? হাথুরুসিংহে মাহমুদউল্লাহকে বাতিল করে দেওয়ার পর বিজ্ঞ নির্বাচকেরাই তো তাঁকে আবার টেস্ট দলে নিয়েছেন। শুধু দলের সাধারণ একজন খেলোয়াড় হিসেবেই খেলেননি মাহমুদউল্লাহ, সাকিবের অবর্তমানে বেশ কয়েকটা টেস্টে অধিনায়কত্বও করেছেন। রাসেল ডমিঙ্গো যদি সত্যি সত্যি মাহমুদউল্লাহর টেস্ট খেলার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন, তাহলে তাঁকে কি অতীত কাহিনিটা জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য ছিল না নির্বাচকদের?

কোচ তাঁর মত দিতেই পারেন, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো নিয়েছেন বা নেওয়া উচিত নির্বাচকদের

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, রাসেল ডমিঙ্গো তো আর নির্বাচক নন, তিনি তাঁর মত জানাতেই পারেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তো নির্বাচকদের। মাহমুদউল্লাহকে টেস্ট ক্রিকেটে অপাংক্তেয় ঘোষণা করার দায় নিতে হবে তাই তাঁদেরকেই। কোচ চান না, তাই...এই কথাটা দায় এড়ানোর ঢাল ছাড়া আর কিছুই নয়। আরেকটা প্রশ্নও কিন্তু ওঠে। নির্বাচক না হওয়ার পরও অধিনায়ক ও কোচের চাওয়া না-চাওয়া কোনো খেলোয়াড়ের দলে থাকা না-থাকার প্রভাবক হতেই পারে। কিন্তু এই তথ্য বাইরে আসবে কেন? নির্বাচকেরা দল নির্বাচন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, অনেক বছর ধরেই এটা আর অবৈতনিক কোনো কাজও নয়; নির্বাচন নিয়ে সব কিছুর জন্য জবাবদিহিতাও তাই তাদেরকেই করতে হবে। কোচের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ এখানে নেই। কোচের চাওয়াই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে আর তাঁরা আছেন কেন?

আগেই বলেছি, মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত ১৫০ রানের ইনিংস খেলায় প্রশ্নগুলো হয়তো বেশি বড় হয়ে উঠেছে। তবে এটাও কিন্তু বলেছি, মাহমুদউল্লাহ শূন্য রানে আউট হলেও তা কিন্তু থাকতই।

কিন্তু কে দেবে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর?

আরও পড়ুন:
তাঁকে নিয়েই যেন ওই পঙ্‌ক্তিগুলো

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×