লর্ডস কেন লর্ডস?

উৎপল শুভ্র

২৮ জানুয়ারি ২০২১

লর্ডস কেন লর্ডস?

টেরাকোটা প্যাভিলিয়ন তো ছিলই, মহাকাশযান সদৃশ এই মিডিয়া সেন্টারও এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে লর্ডসের প্রতীক। ছবি: উইকিপিডিয়া

লর্ডসে অন্তত একবার না খেললে ক্রিকেটার জীবন পূর্ণতা পায় না। আসলেই কি তাই? তা লর্ডস কেন অন্য সব মাঠের চেয়ে আলাদা! ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ইংল্যান্ড সফরে প্রথম টেস্ট ম্যাচটিই ছিল লর্ডসে। লর্ডস কেন লর্ডস, এই প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজার আদর্শ সময়ও।

প্রথম প্রকাশ: ২৫ মে, ২০০৫। প্রথম আলো।

শাহাদাত হোসেন রাজীবের উচ্ছ্বাসটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু ডেভ হোয়াটমোরেরটাকে কী বলবেন?

বাংলাদেশ দলে ঢুকেছেন এবারই প্রথম এবং টেস্ট অভিষেকের সামনে দাঁড়িয়ে শাহাদাতের রোমাঞ্চিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সম্ভাব্য টেস্ট অভিষেকের প্রতিক্রিয়া যেখানে রোমাঞ্চতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেই অভিষেকের সঙ্গে লর্ডসের নাম জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাতেই চলে আসছে‘স্বপ্ন-টপ্ন’ জাতীয় শব্দগুলো। ‘বাংলাদেশের হয়ে একদিন না একদিন খেলতামই, তবে অভিষেকটা যদি লর্ডসে হয়, তাহলে এটা স্বপ্নের মতোই লাগবে’—বললেন ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার বাংলাদেশের দ্রুততম বোলার।

টেস্ট অভিষেকের সঙ্গে ‘স্বপ্নের মতো’ কথাটা যোগ করলেই সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ান বাংলাদেশের এক ব্যাটসম্যান। অভিষেকেই টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়া সেই মোহাম্মদ আশরাফুলও দেখলাম, লর্ডসে অভিষেকের কথা ভেবে একই রকম রোমাঞ্চিত। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির মতোই গত বছর ভারতের বিপক্ষে তাঁর অপরাজিত ১৫৮ রানের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটিও এখন ক্রিকেট রূপকথার অংশ। আশরাফুলের কথাবার্তায় মনে হলো, লর্ডসে যদি সেঞ্চুরি করেই ফেলেন, তাহলে কলম্বো আর চট্টগ্রামও হয়তো এর পেছনে পড়ে যাবে! একজন ব্যাটসম্যানের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন যে লর্ডসে সেঞ্চুরি করা।

লর্ডসের বিথ্যাত সেই টেরাকোটা প্যাভিলিয়ন। প্যাভিলিয়নের মতো এই মাঠের সবকিছুতেই আলাদা একটা আভিজাত্য। ছবি: শামসুল হক টেংকুকিন্তু কেন? লর্ডস কেন আলাদা? অন্য আর দশটি মাঠের মতো এটিও তো একটি মাঠই। ডেভ হোয়াটমোরের এমনই বলার কথা। গত আটটি অ্যাশেজ সিরিজ যতই একতরফা হোক না কেন, টেস্ট ক্রিকেটের দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজটা এখনো আগের মতো তীব্র। এতটাই যে, ‘পম’আর ‘অজি’ শব্দ দুটোকে আপনি ‘সাপে-নেউলে’বাগধারার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ান হয়ে ইংল্যান্ড ঐতিহ্যের জয়গান কীভাবে গাইতে পারেন ডেভ হোয়াটমোর? কী আশ্চর্য, হোয়াটমোর তা-ই গাইছেন। প্রসঙ্গটা যে লর্ডস!

লর্ডসে কোনো ম্যাচই খেলেননি, খেলোয়াড়-হোয়াটমোরের লর্ডস-স্মৃতি বলতে ১৯৭৯ বিশ্বকাপের ম্যাচে ড্রিংকস ট্রলি বয়ে নিয়ে যাওয়া। তারপরও হোয়াটমোরের কাছে লর্ডস মানে ‘বিশেষ কিছু’। কারণ হিসেবে ইংরেজরা যা বলে, হোয়াটমোরের মুখেও সেই শব্দটাই। ‘ট্র্যাডিশন’!

বাংলাদেশের কোচের সঙ্গে এই জায়গাটাতে অধিনায়কেরও মিল। লর্ডসে পা দিয়েই নাকি আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, ‘এই মাঠের কথা এত শুনেছি, এত পড়েছি... এখন সেই মাঠেই খেলতে যাচ্ছি, এই অনুভূতিটা আসলেই অন্য রকম।’ ঐতিহ্যের কারণে লর্ডসকে ‘বিশেষ কিছু’ বলে মানলেও হোয়াটমোর-হাবিবুল কারও প্রিয় মাঠই কিন্তু লর্ডস নয়। হোয়াটমোরের মুখে এমসিজি (মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড) শুনতে পাওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল, এটিই যে তাঁর হোমগ্রাউন্ড। হাবিবুলেরটা চমক। যে মাঠে এখনো কোনো ম্যাচই খেলেননি, সেই এমসিজি তাঁরও প্রিয় মাঠ!

মশালটা বয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সেই শুরু থেকেই পালন করে যাচ্ছে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। ক্রিকেটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এমসিসি, এই মাঠের মালিকও তারাই। 

চমক, কারণ ক্রিকেটারদের ‘প্রিয় মাঠ’ দর্শনটা বোঝা খুব সহজ। দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণ নিয়মটা হলো, যে মাঠে যার সবচেয়ে বেশি সাফল্য, সেটিই তাঁর প্রিয় মাঠ। যে কারণে সুনীল গাভাস্কার পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালের কথা উঠলেই উচ্ছ্বাসে ভেসে যান। এই মাঠে তাঁর এমনই সাফল্য যে, অবাধ যৌনতার দেশ ত্রিনিদাদের লোকজন নাকি এখনো আক্ষেপ করেন, কেন গাভাস্কার ত্রিনিদাদিয়ান কোনো নারীর গর্ভে কোনো উত্তর পুরুষ রেখে আসেননি!

ক্রিকেটের তীর্থভূমি বলে লর্ডসের পরিচিতি, ‘ঐতিহ্য’ নিয়ে এত আবেগাপ্লুত কথাবার্তা, অথচ মজার ব্যাপার হলো, ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি তো নয়ই, ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট ম্যাচটিও লর্ডসে হয়নি। ইতিহাসের প্রথম টেস্ট হয়েছে এমসিজিতে, ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্টের আয়োজক লন্ডনেরই আরেক মাঠ ওভাল (১৮৮০ সালে)। এমনকি ১৮৮৪ সালে লর্ডসে প্রথম টেস্ট ম্যাচের আগেই টেস্ট হয়ে গেছে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডেও। ঐতিহ্যের দিক থেকে এমসিজি, ওভাল বা ওল্ড ট্রাফোর্ড তো তাহলে লর্ডসের চেয়েও এগিয়ে। লর্ডস কি তবে শুধুই ইংরেজদের তৈরি করা মিথ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সবাই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে?

মশালটা বয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সেই শুরু থেকেই পালন করে যাচ্ছে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। ক্রিকেটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এমসিসি, এই মাঠের মালিকও তারাই। এমনই মালিক যে, এই মাঠে টেস্ট ম্যাচ বা ওয়ানডে যা-ই হোক, ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্বই থাকে তাদের হাতে। এমনকি সাংবাদিকদের জন্য আলাদা প্রেসকার্ডও দেয় তারাই। ইংল্যান্ডের সব মাঠের প্রেসকার্ড দেয় ইসিবি, শুধু লর্ডসের ম্যাচগুলোর জন্য আলাদা প্রেসকার্ড নিতে হয় এমসিসি থেকে। এখনো ম্যাচ চলাকালে কোট-টাই ছাড়া লর্ডসের প্যাভিলিয়নে ঢোকার অধিকার নেই। এটা যদি বিস্ময়কর মনে হয়, তার চেয়েও বিস্ময়কর হলো, নয় বছর আগেও লর্ডসের প্যাভিলিয়নে কোনো নারীর প্রবেশাধিকার ছিল না! এ ব্যাপারে এমসিসির গোঁড়ামিটা এমনই ‘ইংরেজ-সুলভ’ ছিল যে, একবার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া এক দর্শককে দেখতে আসা দুই মহিলা ডাক্তারকে পর্যন্ত প্যাভিলিয়নে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মনে হওয়া স্বাভাবিক, লর্ডসকে আলাদা করে রাখার প্রতিজ্ঞা থেকেই করা হয়েছে এত কিছু।

‌এই ছবিটা পাঁচ বছর পরের। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সফরে লর্ডসের ব্যালকনিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ছবি: শামসুল হক টেংকুসেই উদ্দেশ্য যে পুরো সফল, লর্ডস নিয়ে এই আলাদা লেখাই তো তার প্রমাণ। প্রমাণ দুই দশক আগে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই চিঠিটিও, ‘এখন আমি নিশ্চিত যে, এই দেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। গত শনিবার, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট হচ্ছে, আমি লন্ডনের এক ক্যাবিকে (ট্যাক্সি ড্রাইভার) লর্ডসে নিয়ে যেতে বলার পর আমাকে পথ চেনাতে হলো!’

এই চিঠি লিখেছিলেন এক ইংরেজ। কিন্তু লর্ডসের মোহ তো শুধু ইংরেজদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। থাকলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সতীর্থ ও পরে ক্রিকেট লেখক হিসেবে আরো বেশি নাম করা জ্যাক ফিঙ্গলটন কেন লিখবেন, ‘বাকিংহাম প্রাসাদ, হাউস অব কমন্স, ন্যাশনাল গ্যালারি, লাল দোতলা বাসের মতো লর্ডসও লন্ডনের প্রতীক’? ফিঙ্গলটনের আরেকটি লেখায় লর্ডস-বন্দনা আরও উচ্চকিত, যার একটি লাইন এ রকম, 'লর্ডসে হাঁটার সময় পাশে হাঁটে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।'

ফিঙ্গলটনের কথার শেষ শব্দটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। আগামীকাল লর্ডসে হাবিবুল বাশার যখন মাইকেল ভনের সঙ্গে টস করতে নামবেন, অন্তত টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তো তাঁর পাশে হাঁটবেই।

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×