টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬

রূপকথা প্রতিদিন হয় না, হলোও না

উৎপল শুভ্র

৩১ জুলাই ২০২১

রূপকথা প্রতিদিন হয় না, হলোও না

২৯ বলে অপরাজিত ৪৯ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছিলেন মাহমুদউল্লাহ

বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দুই বোলার তাসকিন আহমেদ আর আরাফাত সানি নেই। ম্যাচের আগে আবার পেটের সমস্যায় নেই তামিম ইকবালও। তারপরও ব্যাঙ্গালোরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেনের ম্যাচে পরাজয়ের ব্যবধানটা ৩ উইকেট রাখতেই পারাটাই তো ছিল বড় ব্যাপার।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৬/৫ অস্ট্রেলিয়া: ১৮.৩ ওভারে ১৫৭/৭ ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী

মোহাম্মদ মিঠুন যদি শেন ওয়াটসনের ক্যাচটা না ফেলতেন! তাতে আসলে কিছুই আসত যেত না। ওয়াটসন তো এরপর মাত্র ৮ রানই করতে পারলেন

আল আমিন যদি হ্যাস্টিংসের ক্যাচটা না ফেলতেন! তাতেও কিছু আসত যেত না। অস্ট্রেলিয়ার তো তখন মাত্র ৯ রান দরকার বল বাকি ১৫টি আউটও হয়ে গেছেন সাকিবের ওই ওভারেই। কিছুতেই কি কিছু আসত যেত!

অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ১৩ ওভার পর্যন্ত এমনই মনে হচ্ছিল শেষে এসে কিন্তু ব্যাপারটা এমন সরল থাকল না দুভাবে দেখতে পারেন ম্যাচটাকে নয় বল বাকি থাকতে ৩ উইকেটে জয় টি-টোয়েন্টির আয়নায় ‘হেসেখেলে’ না হলেও ‘অনায়াস’ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত আবার একটু অন্যভাবে দেখলে যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার একটার পর একটা উইকেট পড়ছিল, তাতে জয়টা খুব অনায়াসে এসেছে বলাটা কেমন যেন বেমানান লাগে

অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেটে ১১৫ করে ফেলার পর থেকেই আসলে ম্যাচের ফল নিয়ে সংশয়-টংশয় সব আকাশে উড়ে গেছে শুধু এটা ভেবেই বাংলাদেশ তৃপ্তি পেতে পারে যে আসলে যেমন হয়েছে, স্কোরকার্ডে জয়টা মোটেই তেমন একতরফা দেখাবে না বাংলাদেশের পরাজয়ই ছিল এই ম্যাচের অনুমিত ফল সেটিই হয়েছে রূপকথা তো প্রতিদিন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে না!

বাংলাদেশ জিতে গেলে তো তা রূপকথাই হতো দুই বোলারকে হারিয়ে এমনিতেই বিপর্যস্ত এক দল এর চেয়েও বড় একটা দুঃসংবাদ পেল ম্যাচের আগে তামিম ইকবালকেও পাওয়া যাচ্ছে না! এক সময় ভারত সফরে এসে পশ্চিমা দলগুলো মাঠের খেলা নিয়ে যতটা চিন্তা করত, প্রায় ততটাই পেটের সমস্যা নিয়ে এখন দিন বদলেছে ইংল্যান্ডে যে খাবার পাওয়া যায়, ভারতের পাঁচ তারকা হোটেলেও তা মেলে অথচ এমন একটা ম্যাচের আগে তামিম নাকি সেই সমস্যাতেই আক্রান্ত!

বিকেলের ধাঁধাটার উত্তরও পাওয়া গেল এতে সকালে দুই ঘণ্টার মিটিংয়েও বাংলাদেশের একাদশ চূড়ান্ত হয়নি শুনে একটু বিস্ময়ই জেগেছিল তাসকিন-সানি নেই, এটা তো দুদিন আগে থেকেই জানা তাহলে মাঠে আসার ঘণ্টা তিনেক আগেও কেন শোনা যাবে, ১২ জনও নয়, একাদশ ঘুরপাক খাচ্ছে ১৩ জনকে ঘিরে! তাসকিন-সানির সঙ্গে যে ততক্ষণে তামিম ইকবালেরও যোগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে! শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়েছে দলের সঙ্গে মাঠেও এসেছেন তামিম কিন্তু একটু দৌড়াতে গিয়েই বুঝে ফেললেন, এই ম্যাচে তাঁকে দর্শক হয়েই থাকতে হচ্ছে

দুদিন ধরে তাসকিনকে নিয়ে অনেক হাহাকার তবে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রেক্ষাপটে তামিমকে হারানো আরও অনেক বড় ক্ষতি তারপরও বাংলাদেশ কিন্তু বড় দলগুলোর বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে তাদের ‘পার স্কোর’ই করল মূল কৃতিত্বটা অবশ্যই মাহমুদউল্লাহর তবে শুরুটা করে দিয়েছিলেন সাকিব

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আগের ৩টি টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পক্ষে একটাই হাফ সেঞ্চুরি ঢাকায় গত আসরে সাকিবের ৬৬ কালকের ইনিংসটা এর অর্ধেক দুঃখটা বোধ হয় দ্বিগুণ দারুণ খেলতে খেলতে জাম্পার বলটাকে যেভাবে পয়েন্টের হাতে তুলে দিয়ে এলেন, সেটির ক্রিকেটীয় নাম 'সফট ডিসমিসাল'

দলকে ১০৫ রানে রেখে সাকিব যখন আউট হলেন, ইনিংসের মাত্র ২৮টি বল বাকি কত রানই বা হবে? বড়জোর ১৪০-১৪৫ সেখানে ১৫৬ হয়ে গেল মাহমুদউল্লাহর ২৯ বলে অপরাজিত ৪৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটির কল্যাণে প্রায় ১৬৯ স্ট্রাইক রেটের ইনিংস বললে যেমন মনে হয়, মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ে মোটেই তেমন মার মার কাট কাট ব্যাপার নেই তাঁর কোনো কিছুতেই তা নেই

গত পরশু ম্যাচের আগের দিন হোটেলের লিফটে কথোপকথন কিছুটা হয়তো বোঝাতে পারে

দল নাকি বিপর্যস্ত?

‘একটু তো হওয়ারই কথা

এসব সময়ই বীরের জেগে ওঠার সময়...

মাহমুদউল্লাহ হেসে বললেন, ‘ইনশা আল্লাহ’

শুধু ‘ইনশা আল্লাহ’ বললে হবে! ‘কাল দেখিয়ে দেব’ টাইপ কিছু বলেন, তাহলেই না প্রিভিউটা জমে

মাহমুদউল্লাহ আবারও হাসেন ‘দেখিয়ে দেব’ বলার মতো চরিত্রই নন

মাঠে কিন্তু ঠিকই দেখিয়ে দিলেন মুশফিকের সঙ্গে অসমাপ্ত ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২৮ বলে ৫১ রান এর ৩৫-ই মাহমুদউল্লাহর

শেষ ৩ ওভারে ৪৪ রানের ৩২-ই তাঁর ব্যাট থেকে

কাটার আর স্লোয়ারে অস্ট্রেলিয়ার ডাকাবুকো ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মোস্তাফিজ

গত কিছুদিন মাহমুদউল্লাহ যদি ধারাবাহিকতার প্রতিশব্দ হয়ে থাকেন, সৌম্যও ধারাবাহিক তবে বিপরীত অর্থে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং দেখে প্রথম আলোতে লেখা কলামে সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন ফর্মহীনতার যে কথা লিখেছিলেন, কালকের সৌম্য তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রায় ওয়াইড বলটাকে পয়েন্টের হাতে যেন তুলে দিয়ে এলেন! টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংটা আসলে ঠিক বুঝেই উঠতে পারছেন না নইলে ১৭ ইনিংসে ব্যাটিং গড় ১৬ কেন! কমপক্ষে ১৫ ইনিংস খেলেছেন, এমন ওপেনারদের মধ্যে যা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন আফগানিস্তানের কে যেন শুধু তাঁর নিচে!

তামিমের জায়গায় মিঠুনকে দিয়ে ঠেকা দেওয়া গেছে কিন্তু তাসকিন-সানির অভাব কে ঘোচাবে! মাশরাফি প্রথম ওভারে ছয় খেয়ে আর বোলিংয়েই এলেন না তারপরও যে অস্ট্রেলিয়ার ৭টি উইকেট পড়ল, সেটি মোস্তাফিজ ও সাকিবের কারণে মোস্তাফিজ শুরু করেছিলেন ওয়াইড দিয়ে এরপর যা করলেন, সেটি এই ম্যাচের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গল্প উইকেট দুটি (মিঠুন ক্যাচটা ধরতে পারলে তিনটি হতো), কিন্তু কাটার আর স্লোয়ারে যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার ডাকাবুকো ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে ছাড়লেন, তা দেখার মতো দৃশ্য

মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং আর মোস্তাফিজের বোলিং—বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচ থেকে মনে রাখার মতো স্মৃতি এই দুটিই পরাজয়ের পর তো এসবই খুঁজতে হয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×