২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

হাসতে হাসতে সেমিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

উৎপল শুভ্র

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

হাসতে হাসতে সেমিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

জয়ের আনন্দ, আরেকটি ফাইনালে ওঠার আনন্দ। ছবি: আইসিসি

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৮৪ রানের জয় টেস্ট ম্যাচের আড়াই দিন বাকি থাকতে ইনিংসে জেতার মতো। অথচ কী আশ্চর্য, পাকিস্তানকে টি-টোয়েন্টিতে তাদের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ৮২ রানে শেষ করে দেওয়ার পরও মাঠে কোনো গ্যাংনাম হলো না!আশ্চর্য, আবার একদমই আশ্চর্য নয়। অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া ম্যাচ জেতার পর কি আর গ্যাংনাম আসে নাকি!

প্রথম প্রকাশ: ২ এপ্রিল ২০১৪। প্রথম আলো।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ২০ ওভারে ১৬৬/৬। পাকিস্তান: ১৭.৫ ওভারে ৮২। ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮৪ রানে জয়ী।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর গ্যাংনাম নাচ তো দেখি সমার্থক হয়ে যাচ্ছে!

না, কাল মাঠে কোনো গ্যাংনাম হয়নি। গ্যাংনাম হলো স্টেডিয়ামের বড় পর্দায়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর তাঁর উদ্দাম গ্যাংনাম নাচের দৃশ্য দেখে ডাগআউটে বসে থাকা ক্রিস গেইলও না হেসে পারলেন না।

যদিও তখন তাঁর হাসার মতো অবস্থা নয়। নিজে শুরুতেই আউট হয়ে এসেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসও এগোচ্ছে মালগাড়ির মতো। পাকিস্তানের সামনে লড়াই করার মতো একটা স্কোর ছুড়ে দেওয়াই তখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

সেই চ্যালেঞ্জে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেভাবে জিতল, সেটি এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়গুলোর একটি। তখন ভাবা যায়নি, ব্রাভো-স্যামির অমন রুদ্র-সুন্দর ব্যাটিংয়ের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে বদ্রি-নারাইনের স্পিন জাদু! ২৬ বলে ৪৬ রানের ইনিংসটির কারণে ম্যাচ-সেরার পুরস্কারটা ডোয়াইন ব্রাভোর হাতে উঠল বটে, তবে সেটি স্যামুয়েল বদ্রিকে দিলেও অন্যায় কিছু হতো না। সান্টোকি প্রথম বলেই আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান আহমেদ শেহজাদকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রথম তিন ওভারেই উইকেট নিয়ে পাকিস্তানকে গলা টিপে মারলেন তো এই লেগ স্পিনারই।

তিন ওভার শেষে বদ্রির বোলিং বিশ্লেষণ: ৩-০-৫-৩! পাকিস্তান ৬ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১৩। ম্যাচ তো আসলে ওখানেই শেষ। আনুষ্ঠানিকতা যেটুকু বাকি ছিল, সেটি শেষ করলেন টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরা বোলার সুনীল নারাইন। ১৬ রান দিয়ে তাঁরও ৩ উইকেট।

উদযাপনের মধ্যমণি ম্যাচ জয়ের অন্যতম নায়ক স্যামুয়েল বদ্রি। ছবি:গেটি ইমেজেস

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৮৪ রানের জয় টেস্ট ম্যাচের আড়াই দিন বাকি থাকতে ইনিংসে জেতার মতো। অথচ কী আশ্চর্য, পাকিস্তানকে টি-টোয়েন্টিতে তাদের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ৮২ রানে শেষ করে দেওয়ার পরও মাঠে কোনো গ্যাংনাম হলো না!

আশ্চর্য, আবার একদমই আশ্চর্য নয়। পাকিস্তানের ইনিংসটা ধুঁকতে ধুঁকতে ১৭.৫ ওভার পর্যন্ত এগোল বটে, কিন্তু অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া ম্যাচ জেতার পর কি আর গ্যাংনাম আসে নাকি!

ম্যাচ শেষে দুই দলের করমর্দনের আনুষ্ঠানিকতার সময় সাকলায়েন মুশতাককেও দেখা গেল পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে। হৃদয়ে পাকিস্তান, কিন্তু পেশাদার দুনিয়ার বিচিত্র খেয়ালে এ দিন তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের। এই ম্যাচের আগেই সাবেক পাকিস্তানি অফ স্পিনার যে কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

গত পরশু মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনকক্ষে অবাক করা দৃশ্যটাও এ কারণেই। পরদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান ম্যাচ আর সংবাদ সম্মেলন করছেন নাকি সাকলায়েন মুশতাক! পাকিস্তানি সাংবাদিকদের অনুরোধে প্রশ্নোত্তর পর্বের একটা অংশ উর্দুতেও হলো। সদাহাস্যময় ড্যারেন স্যামি হাসিটা আরেকটু বড় করে বললেন, ‘এটা না ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল!’

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মূল দুই স্পিনারের ৮ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট। ম্যাচটা আসলে সাকলায়েন মুশতাকই জিতলেন। নাকি একই ম্যাচ তাঁকে জয়-পরাজয়ের মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল! কোচ সাকলায়েন জিতলেন, আর হারলেন মানুষ সাকলায়েন!

অথচ ম্যাচের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ উল্টো কিছুর আভাসই দিচ্ছিল। টি-টোয়েন্টির ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই ক্রিস গেইল। বাঁহাতি জ্যামাইকান তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সীমানা ছাড়িয়ে আসলে টি-টোয়েন্টিরই মুখ। সেই গেইল মাত্র ৫ রানেই আউট। এই বিশ্বকাপে স্টাম্পে বল লাগলেই লাল বাতি জ্বলছে। উইকেটকিপার স্টাম্প ভাঙলেও। গেইলকে করা হাফিজের প্রথম বলেই কামরান আকমলের গ্লাভস যখন স্টাম্পে লাল বাতি জ্বালাল, পাকিস্তানিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসেরও বুঝি লাল বাতি জ্বলে গেছে!

১৪ ওভার পর্যন্ত তো এমনই মনে হচ্ছিল। ইনিংসের ৩৭ বল বাকি থাকতে স্কোরবোর্ডে ৫ উইকেটে ৮১, কতই আর হবে? এর পর ডোয়াইন ব্রাভো আর ড্যারেন স্যামি যা করলেন, টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের বিজ্ঞাপন হিসেবে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। শেষ ওভারে ব্রাভো রানআউট হওয়ার আগে দুজনের ৭১ রানের জুটি। এতে কিছুই বোঝানো যাচ্ছে না। ওভার প্রতি ১৩.৩১ রানে কিছুটা বোঝানো যায়। সবচেয়ে ভালো বোঝানো যায়, শেষ ৪ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৭১ রানে।

ড্যারেন স্যামি আর ডোয়াইন ব্রাভোর ম্যাচ উইনিং পার্টনারশিপ। ছবি:গেটি ইমেজেস

টি-টোয়েন্টি বোলারদের র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে সুনীল নারাইন, তিনে সাঈদ আজমল। তারপরও ম্যাচের আগে একটা তর্ক ডালপালা মেলছিল, টি-টোয়েন্টির সেরা অফ স্পিনার কে? সেটির মীমাংসা এমন করুণভাবে হবে, আজমলের কল্পনাতেও তা থাকার কথা নয়। প্রথম দুই ওভারে মাত্র ৬ রান, ৩ ওভারে ১৭। সেই আজমলের শেষ ওভারে বল তিনবার আকাশচারী হয়ে রান এলো মোট ২৪। ব্রাভো মারলেন দুটি ছয়, স্যামি ছয় আর চারে সমান মনোযোগ দিলেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ অনেক দিনই হাহুতাশ আর স্মৃতিমেদুরতার নাম। তারপরও কখনো কখনো সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা। যত না স্ট্রোক প্লের ঔজ্জ্বল্যে, তার চেয়ে বেশি খেলাটা উপভোগ করার সেই হারিয়ে যাওয়া মানসিকতায়। স্যামি যেমন আজমলকে ছক্কা মেরে বাতাসে যেভাবে মুষ্টি ছুড়লেন, ম্যাচ জেতার পরই সাধারণত এমন কিছু করতে দেখা যায় ব্যাটসম্যানকে। খেলাটা মন থেকে উপভোগ করলেই শুধু সম্ভব স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের এমন প্রকাশ।

স্যামি শুধু এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়কই নন, ‘হাসব-খেলব’ থিমেরও মশালবাহী। ‘হাসব-খেলব’র সঙ্গে এখন ‘জিতব’ কথাটাও যোগ করে দেওয়াই যায়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×