দোষটা কি আসলেই মিরপুরের উইকেটের?

উৎপল শুভ্র

১৮ অক্টোবর ২০২১

দোষটা কি আসলেই মিরপুরের উইকেটের?

দুই সুখস্মৃতির পাশে একটা দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচিহ্ন এঁকে দেওয়ার হুমকিও এখন স্কটল্যান্ড। প্রথমবারের মতো ‘একটা কিছু করেও ফেলতে পারি’ আওয়াজ তুলে যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যাওয়া, সেটির মূল পর্বে যাওয়াটাই এখন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জে পরিণত স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ে। দোষটা কি আসলেই মিরপুরের উইকেটের?

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্কটল্যান্ডের একটা আলাদা জায়গা আছে। সেটি কিভাবে? ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে এই স্কটল্যান্ডকে হারিয়েই নিশ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ। 

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্কটল্যান্ডের একটা আলাদা জায়গা আছে। সেটি কিভাবে? বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় এই স্কটল্যান্ডকে হারিয়েই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ-যাত্রার সময়ই এডিনবরায় যে ম্যাচটাকে বাংলাদেশ ‘ফাইনাল’ ধরে নিয়েছিল। পরে পাকিস্তানকে হারানোয় একটু আড়ালে চলে গেছে সত্যি, তবে এডিনবরাতেই আসলে সুসম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ‘বিশ্বকাপ মিশন’। পাকিস্তান ছিল অপ্রত্যাশিত এক বোনাস।

এই দুই সুখস্মৃতির পাশে একটা দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচিহ্ন এঁকে দেওয়ার হুমকিও এখন স্কটল্যান্ড। প্রথমবারের মতো ‘একটা কিছু করেও ফেলতে পারি’ আওয়াজ তুলে যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যাওয়া, সেটির মূল পর্বে যাওয়াটাই এখন চ্যালেঞ্জে পরিণত স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ে।

পরিস্থিতি এখন এমন যে, বাকি দুই ম্যাচে মনেপ্রাণে স্কটল্যান্ডের জয় কামনা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তাতেই মূল পর্ব নিশ্চিত হয়ে যাবে, এমন নয়। তবে স্কটল্যান্ড বাকি দুই ম্যাচেই জিতলেই শুধু মূল পর্বে ওঠার সমীকরণটা সহজ-সরল থাকবে। ওমান আর পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে বাকি দুই ম্যাচে জিতলেই বাংলাদেশের হাতে এসে যাবে মূল পর্বের টিকিট।

 টুর্নামেন্ট-পূর্ব এই অংশটাকে বিশ্বকাপের অংশ করে নিতেই আইসিসি এটির বাহারি নাম দিয়েছে ‘প্রাথমিক পর্ব’। নইলে বাংলাদেশ যেটা খেলছে, সেটি তো আসলে নির্ভেজাল বাছাই পর্ব। এবং বাছাই পর্ব বলেই মূল পর্বে যাওয়া না-যাওয়াটাই এখানে মূল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ও শুধুই একটা ম্যাচ হারার চেয়ে আরও অনেক গুণ বেশি তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও (বলতে পারেন শঙ্কাও) এ কারণেই। কিন্তু মূল পর্বে উঠলেই কি আর এই ক্ষত সহজে শুকানোর মতো!

আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, এসব ‘ক্ষত-টত’ বলাটা বাড়াবাড়ি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সহযোগী সদস্য দেশের কাছে পরাজয় তো আর বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০০৯ বিশ্বকাপে নটিংহামে আয়ারল্যান্ডের কাছে পরাজয় এর চেয়েও বড় ধাক্কা হয়ে এসেছিল। নিজেদের দেশে ২০১৪ বিশ্বকাপে চট্টগ্রামে হংকংয়ের কাছে পরাজয় আরও বেশি। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এর আগে যে একটি মাত্র টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ, সেটিতেও তো পরাজয়ের গ্লানিই। তারপরও এবারের পরাজয়টা বুকে এত বেশি লাগছে কেন? 

কারণ ওই যে এবার ‘একটা কিছু করে ফেলতে পারি’ আত্মবিশ্বাসের বিশ্বকাপ-যাত্রায় সঙ্গী হওয়া। তা সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি কী? অবশ্যই প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়। লাইনটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিরপুরের ওই চষা-খেত সদৃশ উইকেট আপনার চোখে ভেসে উঠছে বলেই অনুমান করছি।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়ার রাতে সাকিবের এই ছবিটাকে প্রতীকী ধরতেই পারেন

ওঠারই কথা। ওই দুটি সিরিজের মতো ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো সিরিজেই উইকেট এমন মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে বলে মনে পড়ে না। অস্ট্রেলিয়ার মতো নিউজিল্যান্ডেরও আসল টি-টোয়েন্টি দল বাংলাদেশ সফরে আসেনি, সঙ্গে ওই উইকেট...অভূতপূর্ব ওই যুগল সাফল্যে তাই একটা কাঁটা বিঁধেই ছিল। এক সময় ওই ঘ্যানঘ্যানে ক্রিকেট দেখাটা অসহ্যও হয়ে উঠেছিল বটে। প্রশ্নটাও তুলছিলেন অনেকেই, এমন উইকেটে খেলে জয় পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আদর্শ বিশ্বকাপ-প্রস্তুতি বলতে যা বোঝায়, তা কি হচ্ছে? বিশ্বকাপে এটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তো!

জয় আশ্চর্য এক টনিক। যেখানেই আসুক, যেভাবেই আসুক, একটা দলের মনোজগত রঙিন করে তোলায় সেটির তুল্য আর কিছু হয় না। তাসমান সাগরের দুই পারের দুই দেশকে হারানোর পর এটিকেই বড় করে দেখিয়েছিলেন সাকিব-মাহমুদউল্লাহরা। কিছুটা একমত তো হতেই হয়েছিল। যা হওয়ার বড় একটা কারণ ছিল বিশ্বকাপের উইকেটের সম্ভাব্য চেহারা। আইপিএলে ক্ষতবিক্ষত দুবাই-আবুধাবি-শারজার উইকেট মিরপুরের মতো হয়তো হবে না, কিন্তু খুব বেশি রানপ্রসবাও কি হবে? 

পুরো আলোচনাটাই ছিল প্রাথমিক পর্বকে উপেক্ষা করে। আরে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডই পাত্তা পাচ্ছে না; স্কটল্যান্ড-ওমান-পাপুয়া নিউ গিনি কোনো ব্যাপার নাকি! বাংলাদেশ তো হেসেখেলেই পার হয়ে যাবে ওই বৈতরণী। যে কারণে বিশ্বকাপ নিয়ে এত আলোচনায় ওমানের নামটা একবারও আসেনি।

তা না-ই বা এলো। ওমানে যে উইকেটে বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড ম্যাচটা হলো, সেটি নিয়ে প্রশ্ন করায় মাহমুদউল্লাহকে বলতে শুনলাম, 'বিউটিফুল উইকেট টু ব্যাট অন'। তাহলে কি ব্যাটিং দুরূহ উইকেটে ব্যাটিং করতে করতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা 'বিউটিফুল উইকেটে' ব্যাটিং করতে ভুলে গেছেন? কথাটাই হাস্যকর। বোলিং বান্ধব উইকেটে টানা খেলে গিয়ে ব্যাটিং উইকেটে বোলারদের সমস্যা হতে পারে, কিন্তু ব্যাটসম্যানদের তো তাতে আরও সাবলীল ব্যাটিং করার কথা।

স্কটল্যান্ডের জন্য এ ছিল এক উৎসবের রাত

স্কটল্যান্ডের কাছে পরাজয়ে কেউ যদি তাই মিরপুরের উইকেটের দায় দেখেন, মনে হয় না, তা ঠিক হবে। এমন তো নয় যে, ১৩০-১৪০ রানের ম্যাচ খেলতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে হঠাৎই এখানে ১৮০-১৯০ চেজ করতে বলা হয়েছে। লক্ষ্য তো ছিল মাত্রই ১৪১। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সিরিজের একটা ম্যাচেও বাংলাদেশ যা করেছে। দুর্দান্ত বোলিংয়ের সঙ্গে বাজে ব্যাটিং যোগ না হলে ওমানের ওই উইকেটে ১৪০ যেকোনো বিচারেই বিলো-পার স্কোর। যা করেও বিরতির সময় স্কটল্যান্ডের খুশি হওয়ার কারণ ছিল। কারণ ছিল বাংলাদেশের মন খারাপ করারও। 

৬ উইকেটে ৫৩ হয়ে যাওয়ার পর ওই ১৪০-কেই স্কটল্যান্ডের 'যা করেছি, ভালোই তো করেছি’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষকে এমন ভূপাতিত করে ফেলার পর একটু হলেও উঠে দাঁড়াতে দেওয়ায় বাংলাদেশের 'এটা কী হলো' অনুভূতিও; কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর সময়কার চিত্রটা তো তাতে একটুও বদলায়নি। তাহলে বাংলাদেশ হারল কেন?

দুর্দান্ত বোলিং আর বাজে ব্যাটিংয়ের যে কম্বিনেশনের কথা বলছিলাম, এর মধ্যে দ্বিতীয়টির দায়ই এখানে বেশি। ৫৩ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে বিশ্বকাপে সহযোগী সদস্য দেশগুলোর সুযোগ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া একটা দল শেষ পর্যন্ত জিতে যাচ্ছে, এতে আপনি ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তার জয়গানও শুনতে পারেন। একবার ফিরে যান না ওই সময়টায়। পুরো ২০ ওভার ব্যাটিং করতে পারবে কি না এই প্রশ্ন তুলে দিয়ে স্কটল্যান্ড ধুঁকছে, সাকিব এক ওভারে ২ উইকেট নিয়ে উঠে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে উইকেটশিকারিদের চূড়ায়...কে তখন কল্পনা করেছিল, এই ম্যাচের শেষের চিত্রটা এমন হবে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×