২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

`আমি বর্ণবাদী নই`

উৎপলশুভ্রডটকম

২৮ অক্টোবর ২০২১

`আমি বর্ণবাদী নই`

কুইন্টন ডি কক

ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা হুট করেই জানিয়েছিল, দলের সব সদস্যকেই `ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার` আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে ম্যাচের আগে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে। তবে কুইন্টন ডি কক মানতে পারেননি আচমকা এই সিদ্ধান্ত। নিজেকে তাই সরিয়ে নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে। এ নিয়ে তোলপাড় ক্রিকেট বিশ্বে। অবশেষে এক বিবৃতিতে কুইন্টন ডি কক জানালেন তাঁর অবস্থান।

জল্পনা-কল্পনার ডালপালা অনেক ছড়িয়েছে দুদিনে। শঙ্কা জেগেছিল, কুইন্টন ডি কককে আর কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে দেখা যাবে কি না। তবে এক বিবৃতির মাধ্যমে সব শঙ্কা-প্রশ্ন উড়িয়ে দিলেন ডি কক নিজেই। জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেতে, বাকিদের মতোই 'টেকিং দ্য নি' গ্রহণে কোনো আপত্তি নেই তাঁর। কেন আগের ম্যাচের ঠিক আগে আগে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে, জানালেন সেটাও। ডি ককের পাঠানো বিবৃতির অনূদিত রূপ এখানে:

'আমার সতীর্থদের এবং দেশে থাকা ভক্তদের স্যরি বলে শুরু করতে চাই আমি। আমি কখনোই এটাকে 'কুইন্টন ইস্যু' বানাতে চাইনি। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর গুরুত্ব আমার জানা। আমি এ-ও বুঝি যে, উদাহরণ তৈরি করা খেলোয়াড়দের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

যদি আমার ‘টেকিং এ নি’ অন্যদের শিক্ষিত করে, অন্যদের জীবনযাত্রা উন্নত করে, তাহলে সেটা আমি খুশি মনেই করব। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে না খেলে কাউকে আমি অসম্মান করতে চাইনি, বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দলকে অসম্মানের আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কেউ কেউ সম্ভবত বুঝতে পারবে না যে, ব্যাপারটা আমরা জানতে পেরেছিলাম মঙ্গলবারেই, যখন আমরা খেলার জন্য মাঠে যাচ্ছি।

যে রাগ-ক্ষোভ-জ্বালার জন্ম আমি দিয়েছি, তার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। এখন পর্যন্ত এই ইস্যুতে আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার একটু ব্যাখ্যা করা দরকার।

যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, আমি কিন্তু একটা মিশ্রবর্ণ পরিবার থেকে এসেছি। আমার সৎ-বোনেরা মিশ্র বর্ণের, আমার সৎ মা কালো। জন্ম থেকেই আমার জন্য তাই, 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার'। এর জন্য কোনো আন্তর্জাতিক আন্দোলন চলছে বলেই না। সব মানুষের অধিকার ও সমতা নিশ্চিত করা যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই শিখে আমি বড় হয়েছি যে, সবার অধিকার আছে এবং এটা গুরুত্বপূর্ণ।

যেভাবে আমাকে বলা হয়েছে যে, 'আমাকে কী করতে হবে', তাতে আমার কাছ থেকে অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলে মেনে হয়েছে। পরে বোর্ডের সঙ্গে গতকাল বেশ আবেগঘন আলাপ হলো, এখন আমি তাদের উদ্দেশ্যটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি। এটা যদি আগে হলেই বেশি ভালো হতো। তাতে ম্যাচ ডে-তে যা হয়েছে, সেটা এড়ানো যেত।কুইন্টন ডি কক `টেকিং দি নি`-তে অংশ নেননি আগেও

এটা আমি জানি যে, আমাকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। আগে আমাদের এটা বলা হয়েছিল, যার যেটা ভালো লাগে, সে সেটা করতে পারবে। আমি আমার ভাবনা, পরিবার ও দেশের জন্য খেলার গর্ব আমার নিজের মধ্যে রেখেছি।

আমার রোজকার জীবনে যখন আমি এর মূল্য বুঝি, তখন এটা কেন কোনো শরীরী ভাষায় প্রমাণ করতে হবে, সেটা আমার বুঝে আসে না। কোনো আলোচনা ছাড়া আপনি যখন ঠিক করে দেন যে, কী করতে হবে, তখন আমার কাছে সেটা সবকিছু কেড়ে নেওয়ার মতো লাগে। আমি যদি বর্ণবাদী হতাম, তাহলে নিজেকে লুকিয়ে খুব সহজেই হাঁটু গেড়ে বসতে পারতাম। সেটা বোধ হয় আদর্শ পৃথিবী গড়তে কোনো কাজেই আসত না।

যারা আমার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে এবং আমার সঙ্গে খেলেছে, তারা জানে আমি কী ধরনের মানুষ। নির্বোধ, মূর্খ, স্বার্থপর, অপরিপক্ক…. আমাকে ক্রিকেটার হিসেবে নানা কিছু বলা হয়েছে। এতে আমার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু না জেনে-শুনেই আমাকে বর্ণবাদী বানিয়ে দেওয়াতে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি। এটা আমার পরিবারকেও আঘাত করেছে, কষ্ট দিয়েছে আমার গর্ভবতী স্ত্রীকেও।

আমি বর্ণবাদী নই। আমার হৃদয়ের গভীর থেকে তা জানি। আর আমাকে যারা চেনে, তারাও তা জানে বলে অনুমান করি। এটা জানি যে, আমি ভালো কথা বলতে পারি না। তবে আমি চেষ্টা করেছি, ব্যাপারটা আমাকে কতটা দুঃখিত করেছে তা বোঝাতে।

মিথ্যে বলব না। একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে যেভাবে আমাদের বলা হলো যে, কী করতে হবে--তা আমাকে আহত করেছিল। এ-ও জানি যে, ধাক্কা খাওয়া মানুষ আমি শুধু একাই নই। আমাদের ক্যাম্প হয়। সেশন হয়। আমাদের জুম মিটিং হয়। আমরা জানি কী করতে হবে। এবং তা সম্মিলিতভাবেই।

আমি আমার টিমমেটদের ভালোবাসি। আর দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলার চেয়ে আর কিছুই আমার অগ্রাধিকার পায় না। এটা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ঠিক করে ফেলতে পারলে তা সবার জন্য ভালো হতো বলে মনে করি। তাহলে আমরা সবাই আমাদের কাজের দিকে মন দিতে পারতাম, আমাদের দেশের জন্য ক্রিকেট ম্যাচ জেতায় মনোযোগী হতে পারতাম। সব সময়ই আমরা বিশ্বকাপে গেলে কোনো না কোনো নাটক হয়। এটা ঠিক না।

আমি শুধু আমার টিমমেটদের ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদের সহায়তার জন্য। বিশেষ করে অধিনায়ক টেম্বাকে (বাভুমা)। লোকে হয়তো বোঝে না, কিন্তু আসলে সে অসাধারণ এক নেতা। যদি সে, দল ও দক্ষিণ আফ্রিকা আমাকে দলে রাখে, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। দেশের হয়ে খেলার চেয়ে বেশি ভালো তো কোনো কিছুতেই লাগেনি।'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×