মিরপুরের সেই ওয়েডের কল্পনাতেও কি ছিল দুবাইয়ের এই রাত!

উৎপল শুভ্র

১২ নভেম্বর ২০২১

মিরপুরের সেই ওয়েডের কল্পনাতেও কি ছিল দুবাইয়ের এই রাত!

পাকিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া ওয়েড আর স্টয়নিসের মাঝখানে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর আফ্রিদি

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার তলানি ছোঁয়ার সেই দিনটিতে মিরপুরে দাঁড়িয়ে ম্যাথু ওয়েড কি কল্পনাও করেছিলেন, তিন মাস পর দুবাইয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল তাঁকে এমন নায়ক বানিয়ে দেবে!

ফখর জামান না শাদাব খান?

একটু মনে করে দেখুন তো, অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ত্রয়োদশতম ওভার থেকে প্রশ্ন কি এটাই ছিল না! বিশ্বকাপে আগের চার ইনিংসে মাত্র ৫৪ রান যাঁর সেমিফাইনালে খেলা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল, সেই বাঁহাতি ৩২ বলে অপরাজিত ৫৫। শেষ ১০ ওভারে ১০৬ রান তুলে পাকিস্তানের ১৭৭ রানে যাওয়ার বাহন তো ফখর জামানের ওই ইনিংসই।

অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের মাঝপথ পেরোতে না পেরোতেই ম্যাচ-সেরার ট্রফিটা হাতে নিতে ফখর জামানের এক প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে গেল। চার ওভারের চারটিতেই উইকেট। যাঁদের ফিরিয়েছেন, সেই নামগুলোও কী! মিচেল মার্শ, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। শেষ ওভারে ১১ রান দেওয়ার পরও ৪ উইকেট তুলতে খরচ মাত্র ২৬ রান। চতুর্থ উইকেটটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে বানিয়ে দিয়েছেন ৫ উইকেটে ৯৬। জিতিয়েও কি দেননি?

তাহলে ফখর জামান না শাদাব খান? ব্যাটিংটাকে বড় করে দেখবেন না বোলিং...তা একটা প্রশ্ন বটে। না, প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ নির্বাচনের কাজটা সহজ হবে না। 

ম্যাচ শেষ হওয়ার আধঘণ্টা পরই যা লেখার সময় মনে হচ্ছে, এসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা না পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করে! সম্ভাবনা তো আছেই, কারণ আপনি তো পড়ছেন আরও পরে। যখন আপনার জানা হয়ে গেছে, অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান সেমিফাইনালের ম্যাচ-সেরার ট্রফিটা এই দুজনের কেউই পাননি। তা উঠেছে ম্যাথু ওয়েডের হাতে। হয়তো দেখেছেন/শুনেছেন সেই ট্রফি হাতে অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপারের প্রতিক্রিয়াও।

ফখর জামান ও শাদাব খানকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ম্যাচের নায়ক ম্যাথু ওয়েড

অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের ফুল লেংথের বলগুলোকে স্লটে পেতে ফখর জামান যেমন পেছাতে পেছাতে ক্রিজের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন, আমিও তেমনি একটু পিছিয়ে যাচ্ছি ম্যাচের অবস্থাটা মনে করিয়ে দিতে। এক নিমিষে যেভাবে ম্যাচটা শেষ করে দিয়েছেন ম্যাথু ওয়েড, তাতে আগের অনেক কিছুই যে প্রায় ঝাপসা হয়ে যাওয়ার জোগাড়!   

শেষ দুই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ২২ রান। শুধু বাবর জামান কেন, যেকোনো অধিনায়কই তুরুপের তাসটা খেলবেন ১৯তম ওভারেই। যাতে শেষ ওভারের চাপটা পুরোপুরিই ব্যাটিং দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। বল হাতে তাই শাহিন শাহ আফ্রিদি। ইনিংসের তৃতীয় বলেই যিনি তুলে নিয়েছেন অ্যারন ফিঞ্চকে, পরের বলে মিচেল মার্শকেও পারেননি শুধুই ‘আম্পায়ারস্ কল’-এর সুক্ষ্মতম কারণে। ভারতকে ধসিয়ে দেওয়া ওই ওপেনিং স্পেলের স্মৃতি জাগিয়ে প্রথম তিন ওভারে দিয়েছেন মাত্র ১৩ রান। আফ্রিদির এই ওভারই তাহলে পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য স্থির করে দেবে। তা-ই দিয়েছে। তবে যেভাবে, কারোরই তা কল্পনাতেও ছিল বলে মনে হয় না। এমনকি ম্যাথু ওয়েডেরও নয় বলেই দাবি করতে চাই।

প্রথম তিন বলে মাত্র ২ রান। যার এক রানও ব্যাট থেকে নয়। একটা লেগ বাই, একটা ওয়াইড। ওয়াইডের কারণেই তৃতীয় বলটা দ্বিতীয়বার করতে হলো আফ্রিদিকে। ম্যাচের সবচেয়ে তাৎপর্যময় মুহূর্তটাও দেখা দেবে ওই সময়ই, যখন ডিপ মিড উইকেটে হাসান আলী ওয়েডের ক্যাচটা ফেলে দেবেন। এই টুর্নামেন্টের শুরু থেকে যেভাবে খেলছিল পাকিস্তান, তাতে কেউ না কেউ অবশ্যই বহুলচর্চিত ওই উপমাটা দেবেন। শুধুই একটা ক্যাচ নয়, হাসান আলী আসলে বিশ্বকাপটাই ফেলে দিয়েছেন হাত থেকে। 

সেই দুঃখে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ বলতে গেলে পেলেনই না আফ্রিদি। পাবেন কিভাবে, তাঁকে তো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে ছক্কার তোড় সামলাতে। একটা ছক্কার জের কাটতে না কাটতেই তো আরেকটা। পরপর তিন বলে ওয়েডের তিন ছক্কায় ম্যাচই শেষ, যার প্রথম ও শেষটি অবিশ্বাস্য দুই স্কুপ শটে। 

শাহিন শাহ আফ্রিদি যখন বিশ্বের সবচেয়ে দুঃখী মানুষ

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচ, সেটিতেই কিনা ৪০তম ওভারটা অব্যবহৃতই থাকল! বলতেই পারেন, এ আর নতুন কি! আগের দিনও কি তা-ই হয়নি? দুই সেমিফাইনালের শেষটাতে অদ্ভুত মিল। নিউজিল্যান্ড যেমন ১৯তম ওভারেই ম্যাচ শেষ করে দিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়াও তা-ই। পার্থক্য বলতে শেষ ২ ওভারে নিউজিল্যান্ডের লাগত ২০ রান, অস্ট্রেলিয়ার ২২। কারণ বোধ হয় এটাই যে, ম্যাচের শেষ ৫ ওভারের সমীকরণেও এই ২ রানের পার্থক্যটা ছিল। নিউজিল্যান্ডের ৬০ রান লাগত, অস্ট্রেলিয়ার ৬২। জয়-পরাজয়ের ব্যবধানেও তো দুটি সেমিফাইনাল যেন একে অন্যের প্রতিচ্ছবি। মিল এখানেও যে, অনাগত দিনে স্কোরকার্ড দেখে কারো বোঝারই সাধ্য থাকবে না, এক ওভার বাকি রেখেই জিতে যাওয়া দলটি প্রায় পুরো ম্যাচেই কেমন প্রতিপক্ষের পেছন পেছন হেঁটেছে। 

তাসমান সাগরের এপার-ওপারের দুই দেশকে ফাইনালে দেখে অবধারিতভাবেই ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা মনে পড়বে। এই মনে পড়াটা বিশ্বজনীন। শুধুই বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক্সক্লুসিভ অন্য একটা স্মৃতি। দুই ফাইনালিস্টের বিপক্ষেই না এই কিছুদিন আগে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ!

সেই নিউজিল্যান্ড আর এই নিউজিল্যান্ড একেবারেই আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলেও অনেক পরিবর্তন। তবে আরও কয়েকজনের মতো তিনি তো কমন থাকছেন দুই অস্ট্রেলিয়া দলেই। টানা তিন ছক্কায় ম্যাচ জিতিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়া দুবাইয়ের ম্যাথু ওয়েডকে দেখতে দেখতে চোখে ভেসে উঠছিল ম্যাথু ওয়েডেরই অন্য আরেকটা মুখ। মিরপুরের ম্যাথু ওয়েডের মুখ। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের পর ম্যাচ হারছে, আর বেচারা ওয়েড পুরস্কার বিতরণীতে এসে মুখ কালো করে একই কথা বলে যাচ্ছেন। আসতেই হচ্ছে, কারণ তিনি যে ওই অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক। শেষ ম্যাচে এসে তা বলতেও যেন কষ্ট। টানা তিন পরাজয়ের পর আগের ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছে বটে, কিন্তু এদিন যে অলআউট হয়ে বসেছে ৬২ রানে।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার তলানি ছোঁয়ার সেই দিনটিতে মিরপুরে দাঁড়িয়ে ম্যাথু ওয়েড কি কল্পনাও করেছিলেন, তিন মাস পর দুবাইয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল তাঁকে এমন নায়ক বানিয়ে দেবে

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×