পিটার মারিজবার্গে সেই ভাস-দুঃস্বপ্ন

২০০৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

উৎপল শুভ্র

২৩ মে ২০২১

পিটার মারিজবার্গে সেই ভাস-দুঃস্বপ্ন

ম্যাচের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক! এই আনন্দ বাঁধ মানে নাকি! ২০০৩ বিশ্বকাপে পিটার মারিজবার্গে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই ম্যাচে চামিন্ডা ভাস

ম্যাচের তিন বলেই উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিক করে ফেলছেন এক বোলার। মাঝখানে এক বল, তারপর আবার উইকেট! অবিশ্বাস্য এই ঘটনার সাক্ষী দক্ষিণ আফ্রিকার পিটার মারিজবার্গ। ২০০৩ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বাঁহাতি পেসার চামিন্ডা ভাসের এই কীর্তির ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। প্রথম ওভার শেষে ৪ উইকেটে ৫ রানের স্কোর যে দলের, তাদের ১২৪ পর্যন্ত যাওয়াই তো ছিল অনেক!

প্রথম প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। প্রথম আলো।

বাংলাদেশ: ৩১.১ ওভারে ১২৪। শ্রীলঙ্কা: ২১.১ ওভারে ১২৬/০। ফল: শ্রীলঙ্কা ১০ উইকেটে জয়ী।

প্রথম ওভার শেষে স্কোর ৪ উইকেটে ৫। সেখান থেকে একটি দল কত দূর যেতে পারে?

শুরুটা মনে রাখলে ১২৪-কে আপনার খুব খারাপ স্কোর বলে মনে হবে না। বাংলাদেশ তো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বনিম্ন রানের রেকর্ডও গড়ে ফেলতে পারত! চামিন্ডা ভাস তো দু বছর আগে জিম্বাবুয়ের সেই  ৩৭ রানের রেকর্ডটিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। 

কলম্বোর সেই ম্যাচেও হ্যাটট্রিক করেছিলেন ভাস, ১৯ রানে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। কিন্তু সেই ম্যাচেও তো এমন শুরু করতে পারেননি। ৩৭-এর কম কিছু তো তাই একেবারে অসম্ভব ছিল না।

৩১.১ ওভারে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চের আগেই ১৩ ওভার ব্যাটিং করে ফেলল শ্রীলঙ্কা, তাতেই ৭৬ রান। ২১.১ ওভারে যখন খেলা শেষ, তখন লাঞ্চের পর মাত্র আধঘণ্টা গেছে। ডারবানে কানাডা-দুঃস্বপ্নের পর শ্রীলঙ্কার কাছে ১০ উইকেটে হার— বাংলাদেশের বিশ্বকাপটা এর চেয়ে খারাপভাবে শুরু হতে পারত না।

পারত! ভাসের প্রথম ওভারটির পর মনে হচ্ছিল, ডারবানে যে লজ্জায় ডুবেছে বাংলাদেশ, সেটি আরও বড় আকার নিয়ে জড়িয়ে ধরবে পিটার মারিজবার্গে। এই ম্যাচের আগে ‘বি’ গ্রুপের বড় চার দলের প্রত্যেকের একটি করে জয়। সুপার সিক্সে ওঠার জন্য রানরেট যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখনই। বাংলাদেশ-কানাডার মতো দলগুলোর বিপক্ষে ম্যাচ তাই হয়ে উঠেছে সেই রানরেট বাড়ানোর মোক্ষম সুযোগ। জয়াসুরিয়া নিজে বুদ্ধের অহিংস নীতির অনুসারী, অহিংস নীতির আরেক প্রচারক মহাত্মা গান্ধীর বিশাল একটি মূর্তি আছে পিটার মারিজবার্গে, কিন্তু কালকের ম্যাচে এসব মাথায় নিয়ে নামেননি শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক। টসে জিতে জয়াসুরিয়া ফিল্ডিং নিয়েছিলেন বাংলাদেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েই। 

এ পর্যন্ত সমস্যা নেই। বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা যে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, সমস্যা হলো সেটাই। কদিন আগে কানাডার বিপক্ষে ম্যাচটি থেকে কিছু শিখেছেন বলে মনে হলো না ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং দেখে। প্রথম বলেই হান্নান সরকার যেভাবে ব্যাট চালালেন, এমন শট খেলার জন্য দল থেকে বাদ দেওয়াটাও কম শাস্তি হয়ে যায়।

আল-শাহরিয়ারের কথাই ধরুন। অনেক দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক প্রহেলিকা হয়ে থাকার পর গত কিছুদিন ধরে তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে শুরু করেছিলেন। এই বিশ্বকাপে তার কাছ থেকে তাই প্রত্যাশা ছিল অনেক। অথচ অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ওই ভয়াবহ বিপর্যয় দেখার পরও, দল যখন ৪ উইকেটে ২৫, তখন যে শটটি খেললেন তিনি, তাতে একটা জিনিসই প্রমাণ হয়, আল-শাহরিয়ারের রোগ সারার নয়। ভাসকে ওভার দ্য টপ মারতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ। ব্যাটসম্যানদের এমন শট খেলতে দেখার পর অধিনায়ক বলতেই পারেন, ‘আমি ঠিক করেছি, দেশে ফিরে ওদের সবাইকে সংবাদ সম্মেলনে বসাব। ওরাই বলবে ওরা কী করেছে, কেন করেছে। ওদের হয়ে এক কথা আমি আর কত বলব?’

এহসানুল হক সিজানকে আউট করে ম্যাচের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক করে ফেললেন চামিন্ডা ভাস

গত এক বছরে বাংলাদেশের ব্যাটিং যে একটা ব্যাপারেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে, তা হলো টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা সবাই ড্রেসিংরুমে ফেরার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করবেন আর এরপর অলক কাপালির সঙ্গে মিলে অধিনায়ক ইনিংসটাকে একটু ভদ্রস্থ করে তোলার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করবেন। সেই দৃশ্য পুনরায় অভিনীত হলো কালও এবং তা হলো বলেই বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১২৪।

যতই দিন যাচ্ছে, অলক কাপালি প্রমাণ করে দিচ্ছেন, তিনি আসলেই বাকিদের চেয়ে আলাদা। কাল অনেক সম্ভাবনা জাগানো তার ইনিংসটি শেষ হয়েছে অবশ্য খুব বাজেভাবে। টাইমিংয়ের গণ্ডগোলে মিড অফে তুলে দিলেন দিলহারা ফার্নান্দোর বল। খালেদ মাসুদের সঙ্গে তার ষষ্ঠ উইকেট জুটিটি তাই থেমে গেল ৪৫ রানেই। অথচ এর আগে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বোলিংকে একেবারেই নির্বিষ বলে মনে করাচ্ছিল তার ব্যাটিং। ফার্নান্দোর এক ওভারেই অফ সাইডে দুর্দান্ত দুটো বাউন্ডারি মেরেছেন, ফার্নান্ডোকেই হুক করে ছক্কা মেরেছেন মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। 

ভাস একের পর এক উইকেট নিচ্ছেন আর মুরালিধরন চুপচাপ বসে থাকবেন, তা তো আর হয় না। খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিক আর তাপস বৈশ্যকে তাই তাড়াতাড়িই তুলে নিলেন এই অফ সিঙ্নার। ৯৮ রানে নবম উইকেট পড়ার পর মাশরাফির ২৩ বলে ২৮ রানই বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে ১২৪ পর্যন্ত। চারটি চারের সঙ্গে মুরালিকে স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে বিশাল একটি ছক্কাও মেরেছেন মাশরাফি।

বোলিংয়েও শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু ১২৪ রানের পুঁজি নিয়ে জয়াসুরিয়া-আতাপাত্তুর বিপক্ষে বিশ্বের সেরা বোলারদেরই যেখানে হাতের তালু ঘেমে যায়, সেখানে মাশরাফি আর কী করবেন?

করার ছিল যাদের, সেই ব্যাটসম্যানরা যে ব্যর্থতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন!

আরও পড়ুুন:

আল-শাহরিয়ার রোকন যখন সেই দুঃস্বপ্নের দর্শক

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×