আল-শাহরিয়ার রোকন যখন সেই দুঃস্বপ্নের দর্শক

২০০৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

উৎপল শুভ্র

২৩ মে ২০২১

আল-শাহরিয়ার রোকন যখন সেই দুঃস্বপ্নের দর্শক

হান্নান সরকার ও মোহাম্মদ আশরাফুলের পর এহসানুল হক সিজানও আউট! ম্যাচের প্রথম তিন বলেই উইকেট নিয়ে ভাসের হ্যাটট্রিক ও উদযাপন দেখছেন নন স্ট্রাইকার আল-শাহরিয়ার রোকন

নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে আপনি যদি দেখেন, ম্যাচের প্রথম তিন বলেই আপনার তিন সতীর্থ আউট হয়ে হ্যাটট্রিক উপহার দিয়ে দিয়েছেন বোলারকে; এক বল বিরতি দিয়ে আবার আউট আরেকজন, কেমন হবে সেই অনুভূতি? বলে বোঝানো কঠিন। তারপরও ২০০৩ বিশ্বকাপে নন স্ট্রাইকার হিসেবে চামিন্ডা ভাসের ওই ওভারটি দেখা বাংলাদেশের ওপেনার আল-শাহরিয়ার রোকন দুদিন পর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন উৎপল শুভ্রকে।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। প্রথম আলো।

ডারবান থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর পিটার মারিজবার্গের ক্রিকেট মাঠটির নাম ‘দ্য ওভাল’। সেই ওভালের চারপাশেই গাছ। এর মধ্যে কিছু গাছ অন্য রকম। সেগুলো এই মাঠে স্মরণীয় কিছু কীর্তির স্মারক। গত শুক্রবার সেখানে আর একটি গাছ বোনা হলো। বুুনলেন চামিন্ডা ভাস। 

১৯৫৭ সালে সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান ডেনিস কম্পটনকে দিয়ে শুরু হয়েছিল এই গাছ বোনার প্রথা। এরপর তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শিবনারায়ণ চন্দরপল, জ্যাক ক্যালিস ও ম্যালকম মার্শালের মতো অনেকে। এই মাঠে কোনো বোলার ৫ উইকেট পেলেই এই তালিকায় ঢুকে যান। ভাস পেয়েছেন ৬টি। তা না পেলেও হতো। ম্যাচের প্রথম ওভারটির পরই তার একটি গাছ বোনার অধিকার অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক। প্রথম ৫ বলে ৪ উইকেট!

চামিন্ডা ভাস জানাচ্ছেন, জীবনে কোনোদিন নিজ হাতে গাছ লাগাননি তিনি। কে জানে, হয়তো অপেক্ষা করছিলেন এমন একটা ক্ষণের জন্যই।

ভাসের জন্য যা স্বপ্নের ওভার, সেটাই বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্ন। কানাডার বিপক্ষে পরাজয়ই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চামিন্ডা ভাসের ওই ওভার। দুটো মিলে যা হয়েছে, তা এক কথাতেই জানিয়ে দিচ্ছেন আল-শাহরিয়ার, ‘বাংলাদেশ টিম এর চেয়ে বেশি চাপে ছিল না কোনোদিন।’

‘জীবনে অনেক বড় বড় বোলারকে খেলেছি। কিন্তু এত নার্ভাস কখনো হইনি। ৫ বলে ৪ উইকেট, এটাও কি সম্ভব! আমার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথম বলটি যখন খেলি, রীতিমতো হাত কাঁপছিল আমার। আমার ক্যারিয়ারেই কখনো এমন হয়নি’

চাপ কাকে বলে, সেটি সেদিন ভালোমতোই বুঝেছেন আল-শাহরিয়ার। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে হয়েছে ভাসের ধ্বংসযজ্ঞ। ‘জীবনে অনেক বড় বড় বোলারকে খেলেছি। কিন্তু এত নার্ভাস কখনো হইনি। ৫ বলে ৪ উইকেট, এটাও কি সম্ভব! আমার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথম বলটি যখন খেলি, রীতিমতো হাত কাঁপছিল আমার। আমার ক্যারিয়ারেই কখনো এমন হয়নি’— ওই ঘটনার দুদিন পর, গতকাল সকালে স্যান্ডটন সান হোটেলের লবিতে এ কথা বলার সময়ও আল-শাহরিয়ারের চোখেমুখে অবিশ্বাস।

রেকর্ড বুকে ঢুকে যাওয়া ভাসের ওই ওভারটি সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর মুখেই শুনুুন সেই অভিজ্ঞতার কথা, ‘‘প্রথম বলেই হান্নান যে শটটি খেলল, বিশ্বাস করুন ওকে কোনোদিন এমন শট খেলতে দেখিনি আমি। ওর সঙ্গে পরে কথা হয়েছে, ম্যাচের প্রথম বলেই কেন ও রকম চালিয়ে দিল, তা নিজেও নাকি বুঝতে পারছে না।’

‘আশরাফুল আসতেই ওকে বললাম, ভাস বল ভেতরে ঢোকায়। তুই আস্তে সোজা খেল। ও তা-ই খেলল, কিন্তু বলটা একটু থেমে যাওয়াতে অমন ক্যাচ উঠে গেল। আশরাফুলকে আউট করার পরই ভাস আমাকে বলল, ওর পিঠে ব্যথা, ও এই ম্যাচে খেলতেই চায়নি। আমি আর কী বলব, বললাম, তোমার দল হয়তো তোমাকে খুব প্রয়োজনীয় মনে করেছে।  সিজানকে (এহসানুল) হ্যাটট্রিকের আশায় ফিল্ডাররা ঘিরে ধরেছে, ওকে তাই বললাম, কোনো প্রেসার নিস না। তোর মতো খেল্। কিন্তু বললেই তো আর হবে না। ওই প্রেসারই ওর কাল হলো। আর বলটাও ভেতরে ঢোকার পর হঠাৎ বেরিয়ে গেল। এক বল পরই সানোয়ারও গেল। তবে সানোয়ারের ডিসিশনটা আম্পায়ার খুব খারাপ দিয়েছেন।”

আল-শাহরিয়ার যা দেখেছেন, তা তো শুনলেন। তা ওই হ্যাটট্রিকের শিকার তিন ব্যাটসম্যান কী বলেন? হান্নান, আশরাফুল আর এহসানুলের মুখ দেখেই বোঝা গেল, এ ব্যাপারে কথা বলতে না হলেই কৃতজ্ঞ থাকবেন তাঁরা। অনেক পীড়াপীড়িতে যা বললেন, তা আল-শাহরিয়ারের বর্ণনার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। পুরো ব্যাপারটা অবাস্তব আর অপ্রাকৃত মনে হচ্ছে বলেই হয়তো হান্নান হাসতে পারলেন, মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি জানি না, কেন অমন একটা শট খেললাম। স্লগ ওভারেও আমি এমন শট খেলি না।’

হান্নানের কথা বিশ্বাস করতে হচ্ছে। কারণ অলক কাপালি জানাচ্ছেন, নেটেও হান্নানকে তিনি এমন শট খেলতে দেখেননি।

আশরাফুলের মধ্যে যে একটা টগবগে ভাব থাকে, সেটা উধাও। প্রথম ম্যাচে বাইরে বসে থাকার পর যে সুযোগটা পেয়েছিলেন, সেটা এভাবে নষ্ট হলো— এটাই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই তাঁর ইতিহাস গড়া ওই সেঞ্চুরি, বোলাররা সবাই চেনা, ভালো করার ব্যাপারে বাড়তি একটা আত্মবিশ্বাস তাই ছিলই। করুণ মুখে বললেন, ‘বলটা হঠাৎ যেন একটু থেমে গেল! শটটা চেক করতে গিয়েও পারলাম না।’

তাঁকে দিয়েই ব্যাপারটা সম্পন্ন হয়েছে বলেই কি না, হ্যাটট্রিকের তিন শিকারের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বস্ত দেখাল এহসানুলকে। মুখে কথাই ফুটছে না, অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘বলটা ভেতরে ঢুকছে ভেবে খেলেছিলাম। ঢুকছিলও তা-ই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বেরিয়ে গেল।’

বেরিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় স্লিপে নয়, ঢুকে গেল সরাসরি ইতিহাসে। আর সেই ইতিহাসই বাড়তি বোঝা হয়ে চেপে বসেছে বাংলাদেশ দলের কাঁধে।

আরও পড়ুন:

পিটার মারিজবার্গে সেই ভাস-দুঃস্বপ্ন

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×