রোনালদোকে সামলাতে সোলশারকে কী দীক্ষা দিয়েছেন ফার্গুসন?

দ্য অ্যাথলেটিক

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

রোনালদোকে সামলাতে সোলশারকে কী দীক্ষা দিয়েছেন ফার্গুসন?

সোলশারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হতে যাচ্ছে, এই ছত্রিশের রোনালদো যে সব ম্যাচ খেলতে পারবেন না, সেটা বোঝানো। সোলশারের সামনে প্রশ্ন আছে আরও, যাঁর খেলা উৎকর্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তাঁর খেলায় কিভাবে আরও উন্নতি আনা যাবে? পাঁচবারের ব্যালন ডি`অর জয়ীকে তিনি কিভাবে গিয়ে বলবেন, "এই জিনিসটা তো আরেকটু ভালো করতে পারতে`? তবে সোলশারকে নিশ্চয়ই কিছু টোটকা শিখিয়ে দিয়েছেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।

ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসছেন, আর রোনালদো তা গোপন করেই দিব্যি চড়ে বেড়াচ্ছেন...এমন দাবি সম্ভবত তাঁর অন্ধ ভক্তও করবেন না। এসি মিলান ম্যাচের উদাহরণটা সাম্প্রতিক বলে মনে থাকারই কথা। ওই ম্যাচের ৫৫তম মিনিটে মরিজিও সারি তুলে নিয়েছিলেন তাঁকে। আর মাঠ থেকে উঠে বেঞ্চে গিয়ে বসার বদলে রোনালদো টানেল ধরে হনহন করে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে। সেখানে গোসল-টোসল সেরে স্টেডিয়াম ছেড়েছিলেন ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার আগেই।

সারির সঙ্গে তাঁর ভাব ছিল না বলেই এমন করেছিলেন রোনালদো ভাবাটাও ভুল। ম্যানচেস্টারে তাঁর প্রথম দফার শেষ দিনগুলোতেও তো এমন কিছু কাণ্ড করেছিলেন রোনালদো। নিজের মনটা ততদিনে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে সঁপে দিয়েছেন তিনি, নিজেকে তাই পাঁচ তারা কারাগারে বন্দীই মনে করতেন। একবার তো বলেছিলেনও, 'মনে হচ্ছে, আমি যেন ক্রীতদাস'।

রোনালদোর এই বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁকে মিডিয়ার সামনে এক হাত নিয়েছিলেন অ্যালেক্স ফার্গুসনও। ২০০৭-০৮ মৌসুমের শেষ ম্যানচেস্টার ডার্বিতে ঘণ্টা পেরোনোর আগেই মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল রোনালদোকে। বেরিয়ে যেতে যেতে রোনালদো রাগে গজরাচ্ছিলেন রীতিমতো। রোনালদো ম্যানচেস্টারে আর সপ্তাহখানেকই আছেন, এটা ততদিনে প্রকাশ্য দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। ফার্গুসনও ব্যাপারটা জানতেন বলেই বোধ হয় রোনালদোকে সংবাদমাধ্যমে ভর্ৎসনার সাহস করেছিলেন, 'তোমার মতো করেই তো আর সব কিছু হবে না।'

ফার্গুসনের এই উদাহরণটা বাদ দিলে রোনালদোকে এক হাত নেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর এমনিতেও, ম্যানেজারের কাছ থেকে তির্যক মন্তব্য শোনার কাজ রোনালদো খুব একটা করেন নাকি! কার্লো আনচেলোত্তির প্রথম দফায় রিয়াল মাদ্রিদের সহকারী কোচের দায়িত্বে ছিলেন পল ক্লেমেন্ত। তিনি জানাচ্ছেন, আনচেলোত্তি কখনোই রোনালদোর সঙ্গে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কোনো কথা বলেননি।

এর আগে চেলসি এবং প্যারিস সেন্ট-জার্মেইয়ের সঙ্গে ছিলেন বলে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে সামলানোর অভিজ্ঞতা ক্লেমেন্তের ছিল। তাই মাদ্রিদে এসে রোনালদোকে কিভাবে সামলাতে হবে, তা নিয়ে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি খুব একটা।

উল্টো রোনালদোর সঙ্গে তাঁর বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু কোচিংই নয়; রোনালদোকে আরও ভালো করে জানা, তাঁর থেকে সেরাটা বের করে আনার উপায় বোঝা, মানে সেরাটা বের করার তরিকা খোঁজা…সব কাজই বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছিলেন ক্লেমেন্ত।

একদম ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো ব্যক্তি রোনালদোকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝরে পড়ে ক্লেমেন্তের কণ্ঠে, 'শীর্ষ পর্যায়ে অনেক ফুটবলারকেই তো দেখলাম, ভীষণ সংকীর্ণমনা কয়েকজনকেও দেখেছি। তাঁদের কাছে "আমি"-ই শেষ কথা। তাঁরা সব সময়ই নিজেদের নিয়ে, কী করছে, কিভাবে খেলছে, অনুশীলন করছে, কেমন পারফরম্যান্স দেখাচ্ছে….এসব নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। কিন্তু রোনালদো সেরকম নয়। ও যেন পাশের বাড়ির ছেলেটা। যার পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জীবন, পরিবার, ব্যবসা, পৃথিবী… মানে সব কিছু নিয়েই গল্প করা যায়।'

কিন্তু অনুশীলনে তো গল্প করার জন্য এলে হবে না, ম্যাচের জন্য প্রস্তুতিও নিতে হবে। প্রশ্ন যদি হয়, রোনালদোকে অনুশীলন করাতে কেমন লাগে, তবে উত্তরটা কেমন হবে? তাঁকে নিয়ে বাজারে একটা ধারণা চালু আছে যে, অনুপ্রেরণার জন্য রোনালদোর কোনো ম্যানেজারের দরকার পড়ে না। নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। ক্লেমেন্ত জানাচ্ছেন, কথাটা মিথ্যে নয়। 'অনবদ্য সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ক্রিস্টিয়ানো সবার ওপরেই আছে। ওর মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাজ করে শান্তি। ওরা ঠিকঠাক অনুশীলন করতে চায়। নিজেরাই সব কিছুকে নিয়মের মধ্যে এনে উপভোগ্য বানাতে চায়। পেশাদার হতে চায়। ট্রেনিংয়ের আগে নিজেরাই জিম-টিম করে তৈরি হতে চায়৷ অনুশীলন শেষে ভিডিও সেশনগুলোতেও ওদেরকেই সবার আগে দেখা যায়। পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় যাকে বলে।'

অনুশীলনগুলো কতটা নিবেদন নিয়ে করেন, তা বোঝাতেই যেন ভিডিও সেশনের কথাটা তুলেছিলেন ক্লেমেন্ত। বিস্তারিত শুনলেই যা বুঝতে পারবেন, 'যখন আপনি একটা টিম মিটিংয়ে যাবেন, কিছু তরুণ খেলোয়াড়কে দেখবেন সবার শেষে এসে উপস্থিত হচ্ছে। বলছি না, ওরা দেরিতে আসে, কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে আসে আরকি। এসে একদম পেছনের সারিতে গিয়ে বসে। যেন হাজিরা দেওয়ার জন্যে হাজির হয়েছে। এটা আমি অনেক বড় ক্লাবেও দেখেছি। বোঝাই যায়, ওরা অর্থের জন্য ক্লাবটায় সই করেছে। কিন্তু সামনের আসনগুলো প্রতিদিনই মিটিং শুরু হওয়ার পাঁচ কিংবা দশ মিনিট আগে ভর্তি হয়ে যায়। রিয়াল মাদ্রিদে প্রতিদিনই আমি যেমন দেখতাম: সেখানটায় রোনালদো, (ইকার) ক্যাসিয়াস, (সার্জিও) রামোস, পেপে এসে বসেছে।'রোনালদোর সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই গলায় গলায় ভাব রাখতে হবে। ছবি: গেটি ইমেজেস

রোনালদোর নিবেদন নিয়ে এরপরও কারও মনে প্রশ্ন রয়ে যেতে পারে ভেবেই সম্ভবত ক্লেমেন্ত ওই গল্পটা বলছেন, 'একবার অনুশীলনে আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গেল ও, ইংরেজি ব্যাকরণ নিয়ে ওর কী যেন একটা প্রশ্ন আছে। নিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, "পল, ইংরেজির এই গ্রুপ ভার্ব ব্যাপারটা কী?" যেটা সম্পর্কে আমার বিন্দুবিসর্গ কোনো ধারণাও নেই, আমি ওকেও সেটা বললাম। ও জবাব দিল, "তুমি না ইংরেজ! তুমি জানো না মানে কী?" আর কী বলব! ইংরেজ হলেও আমরা কি এভাবে ইংরেজি শিখি?'

এখানে আত্মনিবেদনের ব্যাপারটা কোথায়, ধরতে পারেননি তো? তাহলে ক্লেমেন্তের শেষ লাইনটা শুনুন, 'ততদিনে মাদ্রিদে ওর তিন-চার বছর কেটে গিয়েছে। এবং, আমি বুঝতে পারলাম, ও তখনও ইংরেজি শিখছে!'

***

এমন একজন খেলোয়াড়কে দলে পেয়ে ওলে গানার সোলশারের এখন আকাশেই ওড়ার কথা। রোনালদোকে কেন্দ্রীয় চরিত্রটা বুঝিয়ে দিয়ে তা তিনি খুব সম্ভবত উড়ছেনও। কিন্তু বাস্তবতার পাঠগুলোও কি সোলশার পড়ে নিয়েছেন গা ভাসানোর আগে?

সোলশারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হতে যাচ্ছে, এই ছত্রিশের রোনালদো যে সব ম্যাচ খেলতে পারবেন না, সেটা বোঝানো। সোলশারের সামনে প্রশ্ন আছে আরও, যাঁর খেলা উৎকর্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তাঁর খেলায় কিভাবে আরও উন্নতি আনা যাবে? পাঁচবারের ব্যালন ডি'অর জয়ীকে তিনি কিভাবে গিয়ে বলবেন, "এই জিনিসটা তো আরেকটু ভালো করতে পারতে''?

চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে রোনালদোর ব্যক্তিগত জীবনেও। চাইলেও এটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না যে, 'ব্যক্তি' রোনালদো কিছু সমস্যায় ভুগছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর নামে ২০০৯ সালের একটা ধর্ষণ মামলা চলছে। যদিও রোনালদো বারবারই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, এমনকি পুলিশও তাদের তদন্ত থামিয়ে দিয়েছে। তবুও যেকোনো সময়ই চিন্তার পাহাড় তো মাথায় এসে জমা হতেই পারে। খেলোয়াড় রোনালদোকে কিভাবে ব্যক্তি রোনালদো থেকে আলাদা করবেন, সোলশারকে ভাবতে হবে সেটা নিয়েও।

সোলশারের কাজটা সহজ করতে কিছু পরামর্শ বাতলে দিচ্ছেন ক্লেমেন্তই, 'অনেক কিছুই আছে, যেটা আপনি তাঁকে শেখাতে শেখাতে যাবেন না। বরং আপনি একটা পরিবেশ, একটা কাঠামো তৈরি করে দেবেন তাকে। অবশ্যই শৃঙ্খলার ওপর আপনি জোর দেবেন, তবে বিকশিত হওয়ার জন্য সঠিক পরিবেশটাই বেশি প্রয়োজন তার।'

যে কাজটা কার্লো আনচেলোত্তি খুব ভালো পারতেন বলেই মত ক্লেমেন্তের। 'কার্লো বলতে গেলে মাঝামাঝি ছিল, দু'পক্ষেই শ্রদ্ধা প্রত্যাশা করত। যেন বোঝাত: "দেখো, আমিও মানুষ, তুমিও। আমিও খেলেছি, তুমি এখন খেলছ। তাই আমি যেমন তোমার কাজটাকে সম্মান করি, তোমাকেও সেটা করতে হবে।'

ক্রিস্টিয়ানোর ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর অনেক সাবেক কোচই মত দিয়েছেন, ওল্ড ট্রাফোর্ডে তাঁর উপস্থিতি মার্কাস রাশফোর্ড কিংবা ম্যাসন গ্রিনউডের জন্য তো বটেই, ইউনাইটেডের কোচ-মেডিকেল স্টাফদের জন্যেও 'স্নাতকোত্তর ডিগ্রি' পর্যায়ের শিক্ষা হয়ে যাবে। ক্লেমেন্তও সেই অনেক কোচের দলেই, 'অনুশীলন মাঠের রোনালদো নিজেকে একেবারে উজাড় করে দেয়। প্রতিদিনের বিরক্তিকর কাজগুলো সে এত দারুণভাবে করে! পুরো যন্ত্র যেন…'

অনুশীলনে এমন 'যন্ত্রের' উপস্থিতি বাকিদের জন্য মানদন্ড আরও উঁচুতে তুলে নেবে বলেই ধারণা বেশির ভাগের। কেননা, ভালোবাসার প্রতিদান যেমন কেবলই ভালোবাসা, তেমনি নিজেকে নিংড়ে দেওয়া রোনালদোও তো সতীর্থদের কাছ থেকে একই রকম পরিশ্রম আশা করবেন। তাঁরই সাবেক এক কোচ তাই বলছেন, 'ওর আচরণ সংক্রামক। কেউ নিজেদের পারফরম্যান্স পড়তে দিতে পারবে না, একটু "আজ ভালো লাগছে না, থাক" বলে জিরোতে পারবে না। সবাইকেই নিজেদের লেভেলটা ওপরে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকবে। কোচ হিসেবেও আপনি যদি তাকে কোনো ক্লিপ দেখান, তবে সেটা একদম পরিষ্কার, বাহুল্যবর্জিত হতে হবে। যদি তা না হয়, আপনার মুখের ওপরই ও বলে দেবে, "কী অখাদ্য বানিয়েছ!'"

ইউনাইটেডের দীর্ঘদিনের সহকারী কোচ মাইক ফেলানও কথা বলছেন একই সুরেই, 'কখনো কখনো ট্রেনিংটা ওর পছন্দ হতো না। কারণ, অনুশীলনটা ওকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো না। সে অনুশীলন সেশনটা উপভোগ করেছে নাকি করেনি, সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জানাত। এটাই ওর ধরন। আমরাও অবশ্য এই ধরনটাকে পছন্দই করতাম।'

রোনালদোকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন, পরে কোচিং ক্যারিয়ারের হাঁটি-হাঁটি-পা-পা সময়েও রোনালদো ওল্ড ট্রাফোর্ডেই ছিলেন; তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে সোলশারের তাই চমকে যাওয়ার কথা নয়। আর রোনালদোকে কিভাবে সামলাতে হয়, সে দীক্ষাও ফার্গুসন নিশ্চয়ই তাঁকে দিয়েছেন। এই যে অবসরে যাওয়ার আট বছর পরও রোনালদোকে ম্যানচেস্টার সিটিতে যাওয়া থেকে ফার্গি আটকাতে পারলেন, সেটা তো রোনালদোর ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেই। ওই অধিকারটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, ইউনাইটেডের সাবেক ফুটবলার ফিল নেভিল ফাঁস করে দিয়েছেন সেই রহস্যও, 'ফার্গুসন রোনালদোর সঙ্গে কথা বলছেন, এমন ছবিগুলো অ্যালবাম থেকে বের করুন। দেখবেন, সব সময়ই রোনালদোর গলা জড়িয়ে গলা বলছেন ফার্গি।'

নিজেও যেহেতু খেলোয়াড়ের কাঁধে হাত রেখে খেলোয়াড়টির মনের ভেতর ঢুকে যেতে চান, সোলশার তাই রোনালদোর মন জিতে নিতে পারবেন বলেই স্বপ্ন দেখতে পারেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকেরা।

আর একবার রোনালদোর মন জিতে পারলে কী হয়, সেটা তো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভালোই জানা!

*'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: রিজওয়ান রেহমান সাদিদ

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×