রহস্যটা রয়েই গেল

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

রহস্যটা রয়েই গেল

ওয়েম্বলির ফাইনালটা হওয়ার কথা ছিল ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য ঘুচিয়ে দেওয়ার মঞ্চ। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল কী করে অলিম্পিকের সোনা জেতে না একবারও! সেই রহস্য ঘোচা দূরে থাক, মেক্সিকোর কাছে হেরে গিয়ে তা হয়ে উঠেছিল আরও রহস্যময়।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো।

মেক্সিকানদের একটা জাতীয় দুঃখ আছে। সেই দুঃখের মেক্সিকান রূপ এমন—জুগামোস কোমো নুন্কা পারডিমাস কোমো সিয়েনত্রে। বাংলায় অর্থ—আমরা আগে কখনো যা খেলিনি, তার চেয়েও ভালো খেলেছি, কিন্তু আগের মতোই হেরেছি।

কথাটা বলা হয় মেক্সিকো জাতীয় ফুটবল দল সম্পর্কে। মেক্সিকান তরুণেরা মনে হচ্ছে, সেই দুঃখ ঘোচানোর পণ করেছে। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ জিতেছে মেক্সিকো। এর আগে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে হয়েছে তৃতীয়। গত পরশু প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই অলিম্পিক ফুটবলে সোনা জয় বুড়ো আঙুল দেখাল ওই প্রবাদকে। মেক্সিকো আগে যা খেলেনি, তার চেয়েও ভালো খেলল এবং জিতলও।

কিন্তু এই ফাইনালটার না ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য ঘুচিয়ে দেওয়ার কথা ছিল! হয়ে থাকার কথা ছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের একমাত্র অপ্রাপ্তি ঘোচানোর দিন। অথচ পরশু ওয়েম্বলির ফাইনাল সেই রহস্যটাকে করে তুলল আরও রহস্যময়। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অথচ অলিম্পিক ফুটবলে একবারও নয়!

ওয়েম্বলিতে ৮৬ হাজার দর্শকের প্রায় সবাই এসেছিল ব্রাজিলিয়ান জাদু দেখতেই। এখানে-ওখানে হলুদ হয়ে আছে গ্যালারি, একটু পরপরই কোরাসে ‘ব্রাজিল ব্রাজিল’ চিৎকার। কী দেখল তারা—ব্রাজিলিয়ান জাদু? ব্রাজিল যা খেলল, তাতে কারও মনে হতেই পারত, জাদুর একটা ব্যাপার বোধ হয় আছে। যে জাদুমন্ত্রবলে ব্রাজিলিয়ান তরুণেরা খেলতে ভুলে গেছে!

পারলেন না নেইমার। ছবি: গেটি ইমেজেস

ফাইনালের আগে পাঁচ ম্যাচেই জিতেছে ব্রাজিল, প্রতি ম্যাচেই তিন গোল। নেইমার-অস্কাররা কখনো কখনো মায়াঞ্জন বুলিয়ে দিয়েছেন মুগ্ধ দর্শকদের চোখে। অথচ ফাইনালের ব্রাজিলকে ছন্নছাড়া বললেও কম বলা হয়। রোমারিও-বেবেতো-রোনালদিনহোরা যা পারেনি, আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি! এই চিন্তাই কি লোহার মতো ভারী করে তুলল ব্রাজিলিয়ানদের পা? প্রত্যাশার চাপেই ভেঙে পড়লেন নেইমার?

ম্যাচ শেষে আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়লেন। পাশে মেক্সিকানদের বাঁধভাঙা উল্লাস চলছে আর ব্রাজিলিয়ানরা সব মাঠে বসে। নেইমার শুয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। এরপর অনেকক্ষণ বসে। ফাইনালটা না তাঁরই হওয়ার কথা ছিল! হলো তুলনায় অখ্যাত অরিব পেরালটার। দুই অর্ধে দুই গোল। একটা গোল ব্রাজিল শোধ করল বটে, তবে সেটি বাড়তি সময়ে। তিন মিনিটের ওই বাড়তি সময়েই সমতা আনার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। অস্কার সেটি নষ্ট না করলে খেলা অতিরিক্ত সময়ে যায়। গেলে সেটি অন্যায়ই হতো।

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে ফাইনালে হারার চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। সংবাদ সম্মেলনে বসে থাকা মানো মেনেজেসকে দেখে মনে হচ্ছিল, আসলে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। শুরুতেই বললেন, ‘আমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছেন আমার ভেতরে কী হচ্ছে। আমি খুব কষ্টে আছি।’ ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ অবশ্য মেনেজেসের কষ্টকে থোড়াই কেয়ার করল। চাকরি থাকবে কি না, দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন কি না—এই জাতীয় প্রশ্নই বেশি হলো। মেনেজেস একটুও উত্তেজিত না হয়ে উত্তর দিলেন। অলিম্পিকে ব্রাজিলের ব্যর্থতার একটা ব্যাখ্যাও দেওয়ার চেষ্টা করলেন একবার। ঠিক ব্যাখ্যা অবশ্য নয়, কারণটা মেনেজেসও জানেন না। শুধু জানেন, এতবার যখন ব্রাজিল ব্যর্থ হয়েছে, অনূর্ধ্ব-২৩ বয়সী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা কিছুর অভাব আছে।

স্বর্ণজয়ী মেক্সিকো দল `ল্যাপ অব অনার` দিয়ে বেড়াল ওয়েম্বলিজুড়ে। ছবি: গেটি ইমেজেস

জনরোষ থেকে রাফায়েলকে বাঁচানোর চেষ্টাও করলেন, ‘পরাজয়ের পর কাউকে বলির পাঁঠা বানানো ব্রাজিলের জাতীয় সংস্কৃতি। রাতারাতি তা হয়তো বদলানোরও নয়। তবে আমি বলব, এই পরাজয়ের দায় নির্দিষ্ট কারও নয়। ওই গোলটা খাওয়ার পর ফিরে আসার জন্য আমরা ৮৯ মিনিট সময় পেয়েছি।’ কী করেছেন রাফায়েল? ফাইনালের অমন মহানাটকীয় শুরুর মূলে তো তিনিই! ব্রাজিলিয়ান রাইট ব্যাক বল নিয়ে অহেতুক কারিকুরি করার চেষ্টা করে পেছনে এমন বাজে একটা পাস দিলেন, তা থেকেই গোল। ম্যাচের বয়স তখন আধা মিনিটও হয়নি!

ব্রাজিলিয়ান যে সংস্কৃতির কথা বললেন মেনেজেস, সেটির সবচেয়ে বড় শিকার বছর ১২ আগে মরে মুক্তি পেয়েছেন। ১৯৫০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের কাছে পরাজয়ের দায় আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয়েছে গোলকিপার বারবোসাকে। অপমানে অপমানে বলতে গেলে একঘরেই হয়ে ছিলেন। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলে অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর জেল, আর আমাকে সারা জীবন শাস্তি ভোগ করে যেতে হলো।’

এটা বিশ্বকাপ নয় বলে রাফায়েলের কপালে হয়তো এত দুঃখ নেই। কিন্তু মানো মেনেজেসের জন্য এই অলিম্পিক আরও বড় দুঃখের কারণ হয়ে যেতে পারে। অলিম্পিকের আগেই রোমারিও তোপ দেগেছিলেন, এখানে সাফল্য না পেলেই বিদায় নিতে হবে মেনেজেসকে। ফাইনালে পরাজয়ের পর আশা প্রকাশ করেছেন, মেনেজেসের অধীনে ব্রাজিলের শেষ ম্যাচ দেখে ফেলেছেন তিনি।

লন্ডন অলিম্পিকে বাজতে থাকা শেষের রাগিণীর নিশ্চয়ই অন্য অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলেন মানো মেনেজেস!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×