অলিম্পিকে এসে নিজের সেরা টাইমিং করলেন জুয়েল

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

অলিম্পিকে এসে নিজের সেরা টাইমিং করলেন জুয়েল

অন্তত একদিনের জন্য হলেও আলেকজান্ডার পোপভ, পিটার ফন হুগেনব্যান্ডের পাশে বসেছিলেন বাংলাদেশের জুয়েল আহমেদ! `কীর্তি` গড়ে নয় অবশ্যই, ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলের প্রথম হিটে বাদ পড়েছিলেন তিনজনই। জুয়েলের বাদ পড়া, ৮৩ জনের মাঝে ৬৩তম হওয়া অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। গিয়েছিলেনই তো নিজের সেরা টাইমিং গড়ার লক্ষ্য নিয়ে!

প্রথম প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

আলেকজান্ডার পোপভ, পিটার ফন হুগেনব্যান্ড, জুয়েল আহমেদ...পোপভ-হুগেনব্যান্ডের পাশে জুয়েলের নামটি বেমানান লাগছে? লাগলেও সেটি কেটে দেবেন না, অন্তত কালকের দিনটিতে এই তিনজন যে একই দলে! তিনজনই ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারের প্রথম হিটে বাদ।

দিনের প্রথম হিটটিতেই ছিলেন জুয়েল। শেষ দুটিতে পোপভ আর হুগেনব্যান্ড। সাঁতার শেষ করে মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছেন, পোপভ-হুগেনব্যান্ড তখনো পুলেই নামেননি। স্প্রিন্ট সাঁতারের এই দুই মহারথীও যে তাঁর দলেই থাকবেন, সেটি তখনো জানেন না জুয়েল। মুখে প্রায় স্থায়ী হয়ে থাকা তৃপ্তির হাসিটার সঙ্গে পোপভ-হুগেনব্যান্ডকে দলে পাওয়াটাকে মেলানো তাই ঠিক হবে না। জুয়েল হাসছিলেন, কারণ যে লক্ষ্য নিয়ে এথেন্সে এসেছিলেন, তা পূরণ হয়েছে। 

তাঁর হিটে বিখ্যাত কেউ ছিল না, শুরুতেই বাকি পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে এগিয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষে এসে একটু গোলমাল হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় হতে হয়েছে জুয়েলকে। প্রথম-দ্বিতীয় নিয়ে জুয়েলের মাথাব্যথা ছিল না, তিনি তাকিয়ে ছিলেন ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের দিকে। সেখানে নিজের নামের পাশে ২৫.৪৭ সেকেন্ড। আহ্, কী আনন্দ! এর চেয়ে কম সময়ে তো নয়ই, এই সময়েও এর আগে কোনো দিন ৫০ মিটার সাঁতরাতে পারেননি তিনি। হিটে ৮৩ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ৬৩তম, তাতে কি, অলিম্পিকে এসে নিজের সেরা টাইমিং করার তৃপ্তিটা তো আর তাতে মুছে যাচ্ছে না।

অলিম্পিকে অংশ নিতে পারবেন, একসময়কার কল্পনাতীত সেই ঘটনাটি সত্যি হচ্ছে যেদিন জানলেন, এই একটা লক্ষ্যই স্থির করে নিয়েছিলেন জুয়েল, ‘অলিম্পিকে যে কিছু পাব না, এটা তো জানতামই। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল— নিজের সেরা টাইমিং করব আর এই অভিজ্ঞতাটা আগামী বছর সাফ গেমসে কাজে লাগাব।’ লক্ষ্যের প্রথম অংশ পূরণ হয়ে গেছে। গত বছর বার্সেলোনায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে ২৫.৭৭ সেকেন্ড টাইমিং করেছিলেন, এতদিন এটাই ছিল জুয়েলের সেরা। এখন জুয়েল তাকিয়ে আছেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের দিকে। সাফ গেমস। 

এ বছরই ইসলামাবাদ সাফ গেমসে শুরুতে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত রুপা জিততে হয়েছে। ৫০ মিটারে শুরুটা খারাপ করেও তা পুষিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ফিনিশিংয়ে দুর্বলতার কারণে সেটি পদকে রুপা পায়নি। এই ফিনিশিংয়ে সমস্যাটাকে জুয়েল শুধু তার নিজেরই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলছেন না, এটিকে বলছেন বাংলাদেশের সব সাঁতারুরই সমস্যা। অলিম্পিকের আগে ট্রেনিংয়ের জন্য ব্যাংককে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানকার চীনা কোচ এই দুর্বলতা নিয়ে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। ভবিষ্যতে আরও সময় নিয়ে যেতে বলেছেন। 

জুয়েল নিজেও তা-ই চান। দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ পেলে সাফ তো বটেই, এশিয়ান গেমসেও একটা কিছু করে ফেলার আত্মবিশ্বাস আছে তাঁর। তবে সেই আত্মবিশ্বাসটা ফ্রিস্টাইলের চেয়ে বাটারফ্লাইয়েই বেশি, ‘আমি মূলত বাটারফ্লাই সাঁতারু। অলিম্পিকে ফ্রিস্টাইলে কোয়ালিফাই করেছি বলে ফ্রিস্টাইলই সাঁতরাতে হলো।’ ‘মূলত বাটারফ্লাই সাঁতারু’, এ কারণেই জুয়েল মাইকেল ফেলপসের খুব ভক্ত। ফেলপসকে এখন নির্দিষ্ট কোনো সাঁতারুর পরিচয়ে আটকে রাখা মুশকিল, তবে বাটারফ্লাই-ই তাঁর আসল ইভেন্ট। জুয়েলের মতো?

কথাটা শুনে জুয়েল হাসলেন, ‘আমাদের মতো? ওদের সঙ্গে যে আমাদের কত তফাত্, তা এখানে এসে আরও ভালো জানলাম। উচ্চতাই দেখেন না, যার সঙ্গে কথা বলি, ওপর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়। এখানেই তো ওরা অনেক এগিয়ে যায়।’

ওঁদের সঙ্গে অনেক তফাত্, তার পরও কালকের হিট শেষে পোপভ আর হুগেনব্যান্ড জুয়েলের দলেই! ’৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে ৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের ‘ডাবল’ জিতেছিলেন, ’৯৬ আটলান্টাতে প্রথম সাঁতারু হিসেবে তার পুনরাবৃত্তি করার পর স্প্রিন্ট সাঁতারে সর্বকালের সেরা বলেই মেনে নেওয়া হয়েছিল পোপভকে। চার বছর আগে সিডনি অলিম্পিকে হুগেনব্যান্ডের পেছনে শেষ করে ১০০ মিটারে রুপা আর ৫০ মিটারে পদকশূন্য থাকার পরই স্প্রিন্ট সাঁতারে ‘পোপভ যুগ’-এর অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। গত বছর বার্সেলোনায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আবারও ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জিতে তাদের ভুল প্রমাণ করেন পোপভ। কাল হিটে ১৮তম স্থান পেয়ে সেমিফাইনালে উঠতেই ব্যর্থ হওয়াটাকে অবশ্য ‘পোপভ যুগ’-এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিই বলতে হচ্ছে। আর মাস তিনেক পরই যে তার ৩৩তম জন্মদিন।

হিটে পোপভ ১৮তম, ১৭তম হুগেনব্যান্ড। গত এক যুগে স্প্রিন্ট সাঁতারে এই দুজনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে যাঁর নাম, সেই গ্যারি হলের মাঠ অনেকটাই ফাঁকা। হিটে সেরা সময় করেছেন, আজ সন্ধ্যায় ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ফাইনালেও হলই হট ফেবারিট। চার অলিম্পিকে এই প্রথম বিশ্বের দ্রুততম সাঁতারু হওয়ার লড়াইটা বাইরে বসে দেখতে হচ্ছে আলেকজান্ডার পোপভকে।  

পোপভের চেয়ে অনেক খুশিমনে তা দেখতে পারবেন জুয়েল আহমেদ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×