তবু লন্ডন একটা মডেল

লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

তবু লন্ডন একটা মডেল

ছবি: গেটি ইমেজেস

স্থাপনার চমকদারিতে বেইজিংয়ের সঙ্গে লন্ডনের কোনো তুলনাই চলে না। এ-জাতীয় কোনো লক্ষ্যও আয়োজকদের ছিল না। লক্ষ্য যেটি ছিল, তা অর্জিত হয়েছিল বলে সেবাস্টিয়ান কো বরং মহা খুশি। তা লক্ষ্যটা কী ছিল? ‘সবুজ’ অলিম্পিকের লক্ষ্য। অলিম্পিক স্থাপনাগুলোকে অলিম্পিক শেষে শ্বেতহস্তীতে পরিণত হতে না দেওয়ার লক্ষ্য।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো

বার্ডস নেস্টের মতো নজরকাড়া কিছু এখানে নেই। বার্ডস নেস্টকে টেক্কা দেওয়া অবশ্য সহজ কম্ম নয়। অলিম্পিক ইতিহাসেই বেইজিং অলিম্পিক স্টেডিয়ামের মতো এমন আলোচিত আর কোনো স্থাপনা আছে কি না সন্দেহ। অলিম্পিক শুরুর আগেই আর কোনো অলিম্পিক স্টেডিয়াম বিশ্বজুড়ে এমন পরিচিতও হয়ে ওঠেনি। পত্রপত্রিকায় এত ছবি যে ছাপা হয়নি আর কোনো অলিম্পিক স্টেডিয়ামের।

সেই তুলনায় লন্ডন ২০১২ অলিম্পিক স্টেডিয়ামটি আহামরি কিছু নয়। বেইজিংয়ের অ্যাকুয়াটিক সেন্টারটিও ছিল দেখার মতো। লন্ডন এখানেও পিছিয়ে। অলিম্পিক পার্কে সাদা ঢেউখেলানো দেয়ালের বাস্কেটবল স্টেডিয়ামটা একটু দৃষ্টি কাড়ে। আর সাইক্লিংয়ের ভেলোড্রামটা। এর বাইরে বেশির ভাগ স্টেডিয়ামে মুখ ব্যাদান করে আছে ইস্পাতের কঙ্কাল।

না, স্থাপনার চমকদারিতে বেইজিংয়ের সঙ্গে লন্ডনের কোনো তুলনাই চলে না। তবে এ কথা শুনে লন্ডন অলিম্পিকের আয়োজকেরা মন খারাপ করবেন বলে মনে হয় না। তাঁদের যে এ-জাতীয় কোনো লক্ষ্যই ছিল না। লক্ষ্য যেটি ছিল, তা অর্জিত হয়েছে বলে সেবাস্টিয়ান কো বরং মহা খুশি। তা লক্ষ্যটা কী ছিল? ‘সবুজ’ অলিম্পিকের লক্ষ্য। অলিম্পিক স্থাপনাগুলোকে অলিম্পিক শেষে শ্বেতহস্তীতে পরিণত হতে না দেওয়ার লক্ষ্য।

লন্ডন অলিম্পিকের প্রাণপুরুষ সেবাস্টিয়ান কো আশির দশকে মাঝারি পাল্লার দৌড়ে ছিলেন বিশ্বের সেরা। ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে ১৫০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতে পরের অলিম্পিকে তা ধরে রাখার অনন্য কীর্তিটাও করেন। লন্ডনের অলিম্পিক বিড কমিটির প্রধান ছিলেন, সেটিতে সফল হওয়ার পর থেকেই অলিম্পিকের সাংগঠনিক কমিটির প্রধান। কাল সকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে যখন অলিম্পিক পার্ক ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তাঁকে মনে হচ্ছিল বিশ্বের সবচেয়ে পরিতৃপ্ত মানুষ। সাত বছর ধরে যে দিনটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, সেটি যে এখন দুয়ারে। 

অলিম্পিক পার্ক পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারলে ক্যামেরন আরও ভালো বুঝতে পারতেন, কী অসাধ্যই না সাধন করেছে কোয়ের দলবল। পূর্ব লন্ডনের যে জায়গাটায় অলিম্পিক পার্ক, সাত বছর আগেও এটি ছিল বিশাল এক ভাগাড়। গত পরশু আয়োজকদের পক্ষ থেকে একটা গাইডেড ট্যুরের অংশ হয়ে অলিম্পিক পার্কটা ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। নোংরা, নিচু, দূষিত, দুর্গন্ধময় এই জায়গাটা যেভাবে আজকের চেহারা পেয়েছে, তা শুনতে শুনতে মনে হলো, এ তো অ্যান্ডারসনের রূপকথায় কুৎসিত হংসশাবকের রাজহাঁসে পরিণত হওয়ার গল্প।

অলিম্পিকের জন্য এই জায়গাটা চূড়ান্ত করার পর এখানকার দূষিত মাটি তুলে পরিশুদ্ধ করে আবারও বসানো হয়েছে এখানে। মাটির পরিমাণটা একেকখানে একেক রকম পাচ্ছি। তবে সবচেয়ে কম অঙ্কটা যেটা পাচ্ছি, সেটিও বিশ লাখ টন! গাইডের কথা সত্যি হলে, আগে নাকি লোকে রাতের বেলা এই এলাকার কাছাকাছি আসতে ভয় পেত। বর্জ্যের আধার বলে এটি ছিল কুকুরের রাজ্য। মাটি খুঁড়ে তোলার সময় নাকি চারটি নরকঙ্কালও পাওয়া গেছে।

পরিত্যক্ত ভাগাড় থেকে অলিম্পিক পার্ক! ছবি: গেটি ইমেজেস

শুধু মাটিই নয়, গাছ-টাছ যা ছিল, সেসব তুলে নিয়ে পরে আবারও লাগানো হয়েছে এখানে। নতুন করে তো লাগানো হয়েছেই। অলিম্পিক পার্কটা বানানোর সময় শুধু ক্রীড়া স্থাপনার কথাই ভাবা হয়নি, গড়ে তোলা হয়েছে সবুজের সাম্রাজ্য। সেসবের মধ্য দিয়ে পায়ে চলার পথ। অলিম্পিক শেষে স্থানীয় জনগণ যেন পিকনিক-টিকনিকের জন্য ব্যবহার করতে পারে, গড়ে তোলা হয়েছে এমন সবুজ প্রান্তর। সেসবের পাশে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। অলিম্পিকের সময় ফুটবে—এমন হিসাব করেই এসব লাগানো। ১০০ জন মালী আছেন এই ফুলবাগান আর সবুজের পরিচর্যা করতে। অলিম্পিকের পরও সব থাকবে। তখন এটির নাম হবে কুইন এলিজাবেথ পার্ক।

সেই পার্কের মাঝখানে থাকবে নদী, যেটি পুনর্জন্ম পেয়েছে অলিম্পিকের সৌজন্যে। ময়লা-আবর্জনা আর দূষিত রাসায়নিকে ছোট্ট যে নদীটা নর্দমার রূপ নিয়েছিল, সেটিতে এখন টলটলে পানি। ইল মাছ দেখা গেল, ভোঁদড়ও নাকি দেখা যায় প্রায়ই। সেই নদীর ওপর ৩০টি সেতু বানানো হয়েছে। তবে ১৭টিই অস্থায়ী। লন্ডন অলিম্পিক পার্কের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই এই স্থায়ী আর অস্থায়ীর ধাঁধা। গাইড এত ঘন ঘন এই একটা কিছু দেখিয়ে বলছেন, ‘এটা পারমানেন্ট’, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের কিছু দেখিয়ে ‘ওটা টেম্পোরারি’—অলিম্পিকের পর কোনটা থাকবে আর কোনটা থাকবে না, মনে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। 

কিছু থাকবে অলিম্পিকের চিহ্ন ধরে রাখতে। কিছু বা ভবিষ্যতে স্থানীয় জনগণের ব্যবহারের জন্য। হকি স্টেডিয়ামটা যেমন থাকবেই না। সব খুলে-টুলে ব্যবহার করা হবে অন্য কোনোখানে। স্টেডিয়ামগুলোর বেশির ভাগেরই ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে অস্থায়ীভাবে। অলিম্পিক স্টেডিয়ামেই যেমন স্থায়ী আসনসংখ্যা ২৫ হাজার। সেটিকেই অলিম্পিকের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ৮০ হাজারে। ওই যে স্টেডিয়ামের বাইরে ইস্পাতের মুখ ব্যাদান করে রাখার কথা বলছিলাম, সেটি এই অস্থায়ী স্থাপনা আর সাময়িক আসন বাড়ানোর কারণেই। এতে কোনো বার্ডস নেস্ট হয়তো তৈরি হলো না, কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা আর পরিবেশ সচেতনতার এই যুগে অলিম্পিক আয়োজনের একটা নতুন ‘মডেল’ বোধ হয় দাঁড়িয়ে গেল।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×