এ দিনটি কীভাবে ভুলবেন ক্লুজনার!

উৎপল শুভ্র

১৭ জুন ২০২১

এ দিনটি কীভাবে ভুলবেন ক্লুজনার!

এজবাস্টন সেমিফাইনালের শেষ দৃশ্য। ম্যাচ `টাই` হওয়ার পরও অস্ট্রেলিয়ার বিজয়োল্লাস। ছবি: গেটি ইমেজেস

শেষ ওভারে ৯ রান লাগে। প্রথম দুই বলেই চার মেরে স্কোর ‘টাই’ করে দিয়েছেন। চার বলে ১ রান দরকার, দক্ষিণ আফ্রিকা তো জিতেই গেছে। ওই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই যা করে আসছেন, সেটিই তাহলে আবার করলেন ক্লুজনার! কে তখন কল্পনা করেছিল, এই ম্যাচ ক্লুজনারের জন্য বাকি জীবনের আক্ষেপ হয়ে যাবে! এজবাস্টনের ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের সেই অবিস্মরণীয় `টাই ম্যাচ ও এর আগে-পরের গল্প।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২০। প্রথম আলো।

এ দিনটি এলেই কি ল্যান্স ক্লুজনারের মনে পড়ে যায় এজবাস্টন! চোখে ভাসে, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দৃশ্য! তিনি দৌড় শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে তাঁর দিকে উল্টো দাঁড়িয়ে অ্যালান ডোনাল্ড। একসময় পাশেই ক্লুজনারকে দেখতে পেয়ে ডোনাল্ডও দৌড় লাগালেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ড্রেসিংরুমের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকিয়ে ক্লুজনার দেখলেন হলুদ উল্লাস। পাথরের মতো ভারি পা দুটি টানতে টানতে ফিরে এলেন অস্ট্রেলিয়াকে অভিনন্দন জানাতে।

ক্লুজনারের মনে না থাকলেও নির্ঘাত কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেন। এই দিনটি এলেই যে সেই ম্যাচের কথা সবার মনে পড়ে যায়। তা বার্ষিকী পালন করার মতোই এক ম্যাচ। তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে, কেউ কেউ আবার ওয়ানডের সীমানাটা তুলে দিয়ে বলেন, সব ধরনের ক্রিকেটেই সর্বকালের সেরা ম্যাচ না কেন? সেই ম্যাচের ট্র্যাজিক হিরো ল্যান্স ক্লুজনার। শুধু সেই ম্যাচের কেন, ১৯৯৯ বিশ্বকাপেরই!

শেষ ওভারে ৯ রান লাগে। প্রথম দুই বলেই চার মেরে স্কোর ‘টাই’ করে দিয়েছেন। চার বলে ১ রান দরকার, দক্ষিণ আফ্রিকা তো জিতেই গেছে। ওই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই যা করে আসছেন, সেটিই তাহলে আবার করলেন ক্লুজনার! কে তখন কল্পনা করেছিল, এই ম্যাচ ক্লুজনারের জন্য বাকি জীবনের আক্ষেপ হয়ে যাবে!

শেষ ওভারের ওই নাটকীয়তা এত দিনে সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু মহাকাব্যিক ওই সেমিফাইনালের আগে-পরেও তো কত নাটক! আগেরটা আগে বলে নিই। সবার আগে ক্লুজনারের কীর্তিগাথা। ওই বিশ্বকাপে প্রথম আউট হওয়ার আগেই ২১৪ রান করে ফেলেছিলেন। রানটা এখানে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি রান করার ধরনটা। ম্যাচের পর ম্যাচ আপাত-অসম্ভব অবস্থা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিতিয়ে এসেছেন। আস্কিং রেট কত, বোলার কে—কিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৪ বলে ১২ রান করে অপরাজিত। পরের চার ম্যাচে ৪৫ বলে ৫২, ৪০ বলে ৪৮, ৫৮ বলে ৫২, ৪১ বলে ৪৬। সব কটিতেই অপরাজিত এবং পাঁচটির তিনটিতেই আকাশছোঁয়া আস্কিং রেটকে হেলায় জয় করে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছেন। তিন দিন আগে হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ২১ বলে ৩৬ করেছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঠিক এর আগের ম্যাচটিতেই শুধু সেই বিশ্বকাপে ক্লুজনারের একমাত্র এক অঙ্কের রান (৪)।

অ্যালান ডোনাল্ড মাঝ-ক্রিজে। ছবি: অলস্পোর্ট

মন ভেঙে দেওয়া সেই সেমিফাইনালেও ১৬ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকাটা যেন প্রতীকী। ম্যাচ ‘টাই’ হয়েছে, কিন্তু ল্যান্স ক্লুজনার ঠিকই জিতেছেন। ম্যাচের পর ম্যাচ ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে আড়ালে পড়ে গেছে তাঁর বোলিং পারফরম্যান্স। অথচ সেই বিশ্বকাপে ২৮১ রানের সঙ্গে ১৭টি উইকেটও আছে। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টও তাই ল্যান্স ক্লুজনার। যে স্বীকৃতি তাঁকে আগেই দিয়ে ফেলেছিলেন ক্রিকেটের এক মহানায়ক। লর্ডসের প্রেসবক্সের পেছনে দাঁড়িয়ে লারা-টেন্ডুলকার নিয়ে কথা বলতে বলতে ভিভ রিচার্ডস বলেছিলেন, ‘ল্যান্স ক্লুজনারই আমার ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। ও ম্যাচ জেতাচ্ছে। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ জেনে অবাক হবেন, ভিভ যখন এ কথা বলছেন, বিশ্বকাপের সুপার সিক্স তখন মাত্র শুরু হয়েছে।

সেমিফাইনাল শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন দুই অধিনায়ক। ম্যান অব দ্য ম্যাচ শেন ওয়ার্নও। এমন নাটকীয় সমাপ্তির পরও ক্লুজনার ঠিকই আলোচনায়। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট তখনো ঘোষণা করা হয়নি। সেটির অপেক্ষায় না থেকে হানসি ক্রনিয়ে বলে দিলেন, ‘আমার কাছে ক্লুজনারই ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট।’ স্টিভ ওয়াহ ক্লুজনারের প্রতি সমবেদনা জানালেন। শেন ওয়ার্ন বিস্ময়াভূত কণ্ঠে বললেন, ‘ও যে কীভাবে এমন মারে! এমন একজন দলে থাকলে কখনোই আগে হেরে বসতে হয় না।’

ক্লুজনার কীভাবে এমন মারেন, সেটি ব্যাখ্যা করা কঠিন। সহজাত ক্ষমতার পুরো ব্যাখ্যা হয় না। তবে এই সহজাত ক্ষমতার সঙ্গে যে অনেক সাধনাও যোগ হয়েছে, সেটি নিজের চোখেই দেখেছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুপার সিক্সে ওই ম্যাচের আগের দিন হেডিংলিতে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অনুশীলন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মাঠে রয়ে গেছেন ল্যান্স ক্লুজনার আর কোচ বব উলমার। উলমার কোমর উচ্চতায় একটার পর একটা বল ছুড়ে দিচ্ছেন, আর ক্লুজনার সেগুলোকে পত্রপাঠ উড়িয়ে দিচ্ছেন। দু-একটা হারিয়ে যাচ্ছে গ্যালারিতেও। ব্যাটের অবস্থান দেখে ক্লুজনারকে যত না ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান মনে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে বেসবলের হিটার। ব্যাটটা যেন ভীমের গদা।

ক্লুজনারকে তাঁর সামনে দেখে ডোনাল্ড যখন দৌড় শুরু করলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছবি: টুইটার

ম্যাচশেষের সংবাদ সম্মেলনের কথা বলছিলাম। যেটি ম্যাচের চেয়ে মোটেই কম আকর্ষণীয় ছিল না। দুই অধিনায়ক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশের এমন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যে ‘টাই’ টেস্টের সেই ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। স্টিভ ওয়াহ যেন রিচি বেনো, হানসি ক্রনিয়ে ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ক্রনিয়ে বেদনাহত কণ্ঠে বলছেন, ‘এভাবে বিদায় নেওয়াটা খুব কষ্টের। তবে অস্ট্রেলিয়া আবার বুঝিয়ে দিল, কেন ওরা অস্ট্রেলিয়া।’

সেমিফাইনালের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে ক্রমাগত কথার তির ছুড়ে গেছেন স্টিভ ওয়াহ। খোঁচা দিয়েছেন তাঁদের মানসিক দুর্বলতা নিয়ে। একটু আগেই হাতের মুঠো থেকে জয় ফেলে দিয়ে তাঁর সেই দাবিকেই সত্যি বলে প্রমাণ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। স্টিভ ওয়াহর জন্য খুব স্বাভাবিক হতো, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া। সেটি না করে তিনি বলছেন, ‘সত্যিই দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ভাগ্য। দুই বছর ধরে ওরাই ওয়ানডের সেরা দল। এই বিশ্বকাপেও খেলেছে তেমনই। অথচ এভাবে বিদায় নিতে হলো ওদের। হানসির জন্য সত্যি খুব খারাপ লাগছে।’

ক্যারিয়ারজুড়েই খেলার মনস্তাত্ত্বিক অংশটাকে খেলোয়াড়ি দক্ষতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছেন। ম্যাচের আগে-পরের সংবাদ সম্মেলনকে নিয়েছেন সেই সুবিধাকাজে লাগানোর মঞ্চ হিসেবে। আর এদিন স্টিভ ওয়াহ সব ছলাকলা ভুলে প্রতিপক্ষের দুঃখে দুঃখী। অবলীলায় যিনি বলছেন, ‘আজকের ম্যাচে জয়টা প্রাপ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। এই ম্যাচে কমপক্ষে তিন-চারবার মনে হয়েছে, আমরা হারতে যাচ্ছি। যেখানে ৯ উইকেট পড়ার আগে কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকা হারতে পারে বলে মনে হয়নি।’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এটা স্টিভ ওয়াহই তো, নাকি তাঁর রূপ ধরে অন্য কেউ! চমকের তখনো বাকি ছিল। সেটি সম্পূর্ণ হলো, যখন স্টিভ ওয়াহ বললেন, ম্যাচ ‘টাই’ হওয়া মানে যে অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে উঠে যাচ্ছে, এটা নাকি তিনি আগে জানতেন না। এটা কী বলছেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক! তাহলে অ্যালান ডোনাল্ড রানআউট হওয়ার পরই যে মাঠে ‘জয়োল্লাসে’ মেতে উঠলেন তাঁরা, সেটির কী ব্যাখ্যা? সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ, ‘সুপার সিক্সে ওদের বিপক্ষে জিতেছি। রান রেটেও এগিয়ে আছি জানতাম, তাই অনুমান করেছিলাম, একটা না একটা উপায়ে আমরাই সেমিফাইনালে উঠে যাব।’

ছবিটাই বলে দিচ্ছে সব। এজবাস্টনের সেই সেমিফাইনাল শেষে সংবাদ সম্মেলন শুরুর ঠিক আগে স্টিভ ওয়াহ ও হানসি ক্রনিয়ে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এই সেমিফাইনাল ‘টাই’ হলে কী হবে, অনেক সাংবাদিকও সেটি জানতেন না। এর আগে বিশ্বকাপেই কোনো ম্যাচই যেখানে টাইয়ে শেষ হয়নি, সেমিফাইনালের আগে সেই সমীকরণ কেন মাথায় নেবেন কেউ! স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমি নিজেও তা পরিষ্কার জানতাম না। যেভাবে জেনেছিলাম, তা এই ম্যাচের একটা প্রতীকী চিত্র হয়ে আছে আমার কাছে। এজবাস্টনের মূল প্রেসবক্সে জায়গা পাইনি সেদিন। পাননি আরও অনেক সাংবাদিকই।

তাঁদের সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছে গ্যালারির ‘ওভারফ্লো জোনে’। আমার পাশের চেয়ারে যিনি বসেছেন, তাঁর নাম জিওফ্রি ডিন। এর আগেও কোনো ম্যাচে দেখা হয়ে থাকবে। মুখটা তাই পরিচিত। বুকে ঝোলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখে জেনেছি, ইংল্যান্ডের ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ কাজ করেন। ডোনাল্ড রানআউট হয়ে যাওয়ার পর বাকি গ্যালারির সঙ্গে আমরাও দাঁড়িয়ে গেছি। সবাই যেন একটা ঘোরের মধ্যে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাও যেন কারও বিশ্বাস হচ্ছে না।

এরই মধ্যে জিওফ্রি ডিনের চিৎকার শোনাচ্ছে হাহাকারের মতো, ‘সাউথ আফ্রিকা আউট! ও মাই গড, সাউথ আফ্রিকা আউট!’ কীভাবে আউট, তা জানতে চাওয়ায় সুপার সিক্স শেষে রান রেটে অস্ট্রেলিয়ার এগিয়ে থাকার কথা বললেন জিওফ্রি ডিন। বলতে বলতেই কাঁদতে শুরু করলেন। আমি তো বিস্ময়ে হতবাক। প্রথমত, একজন সাংবাদিকের আবেগের এমন প্রকাশ একেবারেই অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, জিওফ্রি ডিন তো ইংলিশ। দক্ষিণ আফ্রিকার দুঃখে তিনি কাঁদতে যাবেন কেন? প্রশ্নটা করতেই জিওফ্রি ডিন ভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম আ সাউথ আফ্রিকান।’

তাহলে তো কাঁদাটাই স্বাভাবিক। এজবাস্টনের ওই সেমিফাইনাল শেষে কাঁদেননি, এমন কোনো দক্ষিণ আফ্রিকানের দেখা পেলে আমাকে জানাবেন প্লিজ!

আরও পড়ুন:
ল্যান্স ক্লুজনার: আশ্চর্য এক অভিষেক

 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×