উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

তারপরও নোমান আলীই সাকিবের চেয়ে সুখী

রিফাত বিন জামাল

৯ ডিসেম্বর ২০২১

তারপরও নোমান আলীই সাকিবের চেয়ে সুখী

সাকিব আল হাসান

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজে সাকিব আল হাসানের ব্যক্তিগত অর্জন ঢাকা পড়ে গেছে দলীয় ব্যর্থতায়। পাকিস্তানি স্পিনার নোমান আলীর ঘটনা বিপরীত। দলীয় সাফল্যের আনন্দে তিনি হয়তো ভুলে গেছেন পুরো সিরিজে একটাও উইকেট না পাওয়ার যন্ত্রণা।

প্রথম তিন দিনে বৃষ্টি আলোর স্বল্পতায় নেই প্রায় আড়াই দিনেরই খেলা। তারপরও ম্যাড়মেড়ে টেস্টের বদলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্তই টিকে থাকল উত্তেজনা। পরাজয়ের যন্ত্রণায় না পড়লে বাংলাদেশ হয়তো তা উপভোগ করতে পারত। ম্যাচের সমীকরণে যেখানে বলতে গেলে ড্রয়ের বাইরে অন্য কিছুর জায়গা ছিলই না, সেখানেই ম্যাচটা বাংলাদেশের হেরে যাওয়া। দুঃখ-হতাশার শেষে বাংলাদেশ এখন রীতিমতো ক্ষুব্ধ না হয়ে তাই পারে না। কিন্ত দুঃখের মাঝেও নাকি সুখ বিলানোর কঠিন কাজ করে যেতে হয়। তারপরও সাকিবের আরেকটি রেকর্ডও আপনার ক্ষতে ঠিক প্রলেপের কাজটা কতটুকু করবে, তা নিয়ে থেকে যায় যথেষ্টই সন্দেহ!

টেস্টে ৪০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবলের রেকর্ডের তালিকায় ঢুকেছে সাকিব আল হাসানের নাম। তাঁর আগে যে কীর্তি ছিল মাত্র পাঁচজনের। ২০০ উইকেটের দেখা সাকিব পেয়ে গিয়েছিলেন ৫৪তম ম্যাচেই, তবে অপেক্ষা ছিল চার হাজার রানের। সাকিবের মতো এ অপেক্ষায় পড়তে হয়েছিল এই ডাবল ক্লাবের আরও তিন সদস্যকেও।

ছয়জনের মধ্যে সবচেয়ে কম, ৪১ ম্যাচে দুই শ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম, এরপর চার হাজার রানের মাইলফলক  ৬৯তম ম্যাচে গিয়ে। আরেক কিংবদন্তি অলরাউন্ডার কপিল দেবের দুই শ উইকেট নিতে ৫০ ম্যাচ লাগলেও চার হাজার রান কর‍তে লেগে গিয়েছিল ৯৭ ম্যাচ। 

মিরপুরে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৩ রান করার পথেই টেস্টে চার হাজার রান হয়েছে সাকিবের। সঙ্গে ডাবল-ও। ছবি: এএফপি

কিউই স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ৬৩তম ম্যাচে দুই শ উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন। তবে চার হাজার রান করতে তাঁর লেগে গিয়েছিল ১০১টি ম্যাচ। এর চেয়ে একটি বেশি, অর্থাৎ ১০২ ম্যাচ প্রয়োজন পড়েছিল জ্যাক ক্যালিসের দুই শ উইকেট নিতে। কিন্ত টেস্ট ক্যারিয়ারে চার হাজার রান স্পর্শ করে ফেলেছিলেন তিনি ৬১তম ম্যাচেই।

অলরাউন্ড সত্তার পরিচয় দেওয়া এই ডাবলে যাঁরা আছেন, তাদের মধ্যে চার হাজার রান করতে সবচেয়ে কম ৪৬টি ম্যাচ নিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি অলরাউন্ডার গ্যারি সোবার্স। এই তালিকায় থাকা কারো নামের সঙ্গেই আসলে কিংবদন্তি উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। আর নিজেকে ইতোমধ্যেই কিংবদন্তিদের কাতারে নেওয়া সাকিব আরেকটি অলরাউন্ড কীর্তির ঘরে নিজের পা দিয়েই রাখলেন স্রেফ। 

সেই কীর্তিঘরে তাঁর চেয়ে কম ম্যাচ খেলে ঢুকতে পারেননি আর কেউই। সাদা পোষাকে ৫৯তম বার নেমেই সাকিব করে ফেলেছেন এই কীর্তি। যে দুটি অর্জনের মিলিত রূপ এই ডাবল, দেখা যাচ্ছে, সেই দুটির একটি পেতে কারো কম ম্যাচ লাগলে অন্যটিতে লেগেছে বেশি। প্রথমটির পর দ্বিতীয়টির দেখা পেতে সবচেয়ে কম অপেক্ষা করতে হয়েছে সাকিবকেই। 

৫৪তম ম্যাচে দুই শ উইকেট পেয়ে যাওয়ার পর ৫৯তম ম্যাচেই সাকিব করে ফেলেছেন চার হাজার রান। যার মানে মাত্র পাঁচ ম্যাচের মধ্যেই তাঁর এই দুই অর্জন। ছয়জনের ছোট্ট এই ক্লাবে যা সবচেয়ে কম৷ যার অন্য আরেকটি অর্থও দাঁড় করানো যায়, যা আদতে ব্যাটে-বলে সমান পারদর্শী সত্যিকারের অলরাউন্ডার সাকিবকেই বোঝায়। চার হাজার রান ও দুই শ উইকেটের এই ডাবলের ক্লাবে দুইশ উইকেট নিতে সাকিবের লেগেছিল তৃতীয় সর্বনিম্ন ম্যাচ, এবং রানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অর্থাৎ চার হাজার রান করতে বাকিদের মধ্যে চারজনের লেগেছিল তাঁর থেকে বেশি ম্যাচ, উইকেটের ক্ষেত্রে তিনজনেরই। 

সাকিবের ব্যক্তিগত অর্জন ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সত্যি এই ছবিটিই। ছবি: বিসিবি

এই অসাধারণ অর্জনের পরও সাকিবের আনন্দে আত্মহারা না হতে পারার কারণটা আপনার অজানা নয়! দুই ইনিংস মিলিয়েই বাংলাদেশ পাকিস্তানের তিন শ রান ছাড়িয়ে যেতে পারেনি বলে জুটেছে ইনিংস ও ৮ রানের হার। প্রথম ইনিংসে তো বাংলাদেশ অলআউট হয়ে গেছে মাত্রই ৮৭ রানে। অবশ্য ৮৭ রানের কমেও বাংলাদেশের অলআউট হওয়ার ঘটনাও এর আগে ঘটে গেছে তিনবার। তবে ঘরের মাটিতে এর চেয়ে কম রানে বাংলাদেশ অলআউট হয়নি কখনোই। এর আগেও একবার ৮৭ রানে সবকটি উইকেট খুইয়েছিল বাংলাদেশ, সেটি ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে এই নিয়ে ১১তম বার টেস্টে বাংলাদেশের দুই অঙ্কের রান।  

এবং নোমান আলী
সাজিদ খান যেখানে মিরপুরে উইকেটের পর উইকেট তুলে নিয়েছেন, পাকিস্তানের আরেক স্পিনার নোমান আলীকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। দুই টেস্ট মিলিয়ে বোলিং করেছেন ৬৭ ওভার। এর আগে বাংলাদেশে এসে ভিনদেশি  কেউ কোনো সিরিজে দুই ম্যাচ খেলে উইকেটশূন্য থেকেছেন সর্বোচ্চ ১৬ ওভার বোলিং করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাইল মায়ার্সের থেকে ৫১ ওভার বেশি বল করেও নোমান আলীর একই দশা! 

তবে নোমানের ৬৭ ওভারের চেয়েও বেশি বল করেও উইকেটবিহীন সিরিজ শেষ করার নজিরও আছে। কোনো টেস্ট সিরিজে দুই ম্যাচ মিলিয়ে নোমানের চেয়েও বেশি ওভার বল করে উইকেটের দেখা পাননি পাঁচজন। সম্প্রতিই ভারত সফরে এসে ৬৯ ওভার বল করে সমারভিলে নিউজিল্যান্ড ফিরেছেন খালি হাতে। তাঁর মতোই আরেক কিউই বোলার ম্যাথু হার্ট ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক সিরিজে ৭১ ওভার নিস্ফলা বল করে গেছেন! ভিন্ন ভিন্ন সিরিজে ভারতের হরভজন সিং, আরশাদ আইয়ুব, ইংল্যান্ডের রবার্ট ক্রফট কিংবা হপউড-নোমান, সমারভিলে কিংবা হার্টের চেয়েও বেশিবার হাত ঘুরিয়ে কাঙখিত সেই উইকেটের দেখা পাননি। নোমান তাই একা নন! 

এই সিরিজেও একা নন তিনি। তাঁর মতোই বাঁহাতি আরেক স্পিনার সাকিবও যে ১৯ ওভার বল করেও কোন উইকেট পাননি। যা দেখে একটু অবাক হলেও হতে পারেন আপনি! তবে ১৯ কিংবা তাঁর বেশি ওভার বল করে এর আগেও পাঁচটি ম্যাচে উইকেটশূন্য থেকেছেন সাকিব। অবশ্য পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে সাকিবের ব্যাট হেসেছে ঠিকই! 

নোমান আলী। ছবি: পিসিবি

অসামান্য এক অর্জনের সেই ম্যাচশেষে সাকিবের অনুভূতি কী ছিল? নোমানকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই, তবে পাকিস্তান ব্যাগভর্তি করেই ফিরেছে ঘরে। কেমন ছিল নওমানের অনুভূতি? দল ও ব্যাক্তিগত, দুটি দিক দিয়ে চিন্তা করলে দুজনের অনুভূতি সম্পুর্ণ বিপরীত হওয়ার কথা। এখানেও দলেরই প্রাধান্য বিস্তার করার কথা, দলের খুশিতেই যে নিজের খুশি!

আচ্ছা, বাংলাদেশকে ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করলে বাংলাদেশের অনুভূতিটা এখন কেমন? ভুল আর ভুলে ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ। মানুষের তো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে সঠিক পথে এগোনোর জন্যে উঠে দাঁড়ানো৷ কিন্ত সবাই কি আর ভুল শুধরানোর চেষ্টা করে! বাংলাদেশ কি করবে? এবং বাংলাদেশ বলতে যারা মাঠে খেলে, তাঁরাই শুধু নন!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×