আজাজ প্যাটেলের গল্পের কাছে কোথায় লেকার-কুম্বলে!

উৎপল শুভ্র

৪ ডিসেম্বর ২০২১

আজাজ প্যাটেলের গল্পের কাছে কোথায় লেকার-কুম্বলে!

আজাজ প্যাটেল: স্বপ্নও মনে হয় নাগাল পায়নি এর!

জিম লেকারের কীর্তির ৪৩ বছর পর তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। কুম্বলের কোটলা-বীরত্বের ২২ বছর পর সংখ্যাটা তিনে নিয়ে গেলেন আজাজ প্যাটেল। টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসের ১০ উইকেটই নেওয়া এই তিন কীর্তিমানের মধ্যে আজাজ প্যাটেলের গল্পটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।

আট বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে মুম্বাই ছেড়ে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমানো বালকের জন্য ২৫ বছর পর সেই মুম্বাইয়ে টেস্ট খেলতে নামাটাই তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার। টেস্টের প্রথম দিন ৪ উইকেট নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় এই ‘স্বপ্ন’ কথাটা এসেছে। আজাজ প্যাটেল তখন কিভাবে কল্পনা করবেন, দ্বিতীয় দিনের খেলার অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই তাঁকে অনুভূতি প্রকাশক নতুন কোনো শব্দ খুঁজতে হবে। এবং সম্ভবত তা খুঁজে পাবেন না। কারণ স্বপ্ন তো কিছুটা হলেও বাস্তবতার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে।

স্বপ্ন যতই বল্গাহীন ছুটে বেড়াক, মানুষই সেই স্বপ্নে একটা লক্ষ্মণরেখা এঁকে দেয়। নইলে যে স্বপ্ন আর কল্পনার সীমারেখা ধুয়েমুছে যায়। আজাজ প্যাটেলের ক্ষেত্রে কি তা-ই গেল না? শৈশবের আট বছর কাটিয়ে যাওয়া জন্মস্থানে টেস্ট খেলতে নেমে এমন একটা কীর্তি, টেস্ট ক্রিকেট যা এর আগে দুবারের বেশি দেখেনি, এটা যদি সেই লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে যাওয়া না হয়, তাহলে আর কোনটাকে তা বলবেন? 

টেস্ট ক্রিকেট এর আগে দুবার দেখেছে বলছিলাম, প্রথম দেখেছিল জিম লেকারের কল্যাণে। ১৯৫৬ সালে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইংল্যান্ডের অফ স্পিনার অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের ১০টি উইকেট নিয়ে নিয়েছিলেন একাই। পরবর্তী ৪৩ বছর একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে থাকার পর যে কীর্তিতে জিম লেকারের সঙ্গী ভারতীয় লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলে। ১৯৯৯ সালে দিল্লি টেস্টে যাঁর অল-টেনের শিকার পাকিস্তান। সেটিও  দ্বিতীয় ইনিংস। কুম্বলের দশম উইকেটে ইনিংস ও ম্যাচ দুটিই একসঙ্গে শেষ। লেকারের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। পার্থক্য বলতে অস্ট্রেলিয়া নেমেছিল ফলো অন করতে। 

ম্যানচেস্টার, ১৯৫৬: অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের ১০ উইকেট নিয়ে বেরিয়ে আসছেন জিম লেকার

লেকারের কীর্তির ৪৩ বছর পর কুম্বলে। কুম্বলের কীর্তির ২২ বছর পর আজাজ প্যাটেল। তিনজনের মধ্যে যাঁর গল্পটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। তা শুধু প্রথম ইনিংসে বলে নয়। ’নতুন দেশ’-এর হয়ে জন্মভূমির বিপক্ষে জন্মস্থানে বলেও না। বিস্ময়ের আরও কত উপাদানই না ছড়িয়ে আজাজ প্যাটেলের গল্পে! ইনিংসের ১০ উইকেটই নিয়ে নেওয়ার বিস্ময় উপহার দেওয়ার আগেই জিম লেকার ও অনিল কুম্বলে প্রতিষ্ঠিত বোলার। এর আগের ২৭ টেস্টে লেকারের ১০৬ উইকেট নেওয়া হয়ে গেছে। কোটলায় অল-টেন বীরত্বের আগে কুম্বলের সংগ্রহশালা তো আরও সমৃদ্ধ। ৫০ টেস্টে ২২০ উইকেট নিয়ে ভারতের অবিসংবাদী এক নম্বর স্পিনার। যেখানে আজাজ প্যাটেলের এটি মাত্র ১১তম টেস্ট। টেস্ট অভিষেকেই ৭ উইকেট নেওয়ার পরও প্রথম ১০ টেস্টে যাঁর মাত্র ২৯ উইকেট। সাড়ে ১০ টেস্ট ম্যাচ পরই যে সংখ্যাটা ৩৯-এ উন্নীত।

দিল্লি, ১৯৯৯: অনিল কুম্বলের অল-টেনের আরেকটি উইকেট

প্রায় রূপকথাসম আজাজ প্যাটেলের গল্পের আসল চমক অবশ্যই এটা নয়। যেটির শুরু সেই শুরু থেকেই। পরিবার পরিজনের বিশাল বহরের সঙ্গে যখন ডিনার করছিলেন, তখনই গাভিন লারসেনের ফোনটা এসেছিল। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক সুখবর দিতে ফোন করেছেন। আজাজ প্যাটেল ডাক পেয়েছেন নিউজিল্যান্ড দলে। এর কদিন পরই আবুধাবিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আজাজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব। প্রথম ম্যাচেই তাঁর হাতে নতুন বল। সাদা বলে স্পিনারের বোলিং ওপেন করার যে ইতিহাসের সূচনা আজাজ প্যাটেলের কোচ দীপক প্যাটেলের হাতে। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেই চমক অনেক দিন আগেই ক্রিকেটের নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত। আজাজ প্যাটেলের প্রথম ওভার করা তাই ঘটা করে বলার মতো কিছু নয়। ঘটা করে যা বলা উচিত, ততদিনে আজাজ প্যাটেলের ৩০তম জন্মদিন পালন করা হয়ে গেছে। 

ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন পেস বোলার হিসেবে। দ্রুতই বুঝতে পারেন, তাঁর সাড়ে পাঁচ ফুটি শরীর পেস বোলিংয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। এ কারণেই স্পিনে আশ্রয়। নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পুরস্কার গাভিন লারসেনের ওই ফোন। ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়। তিন বছরের মাথায় মুম্বাই টেস্টে যে গল্প ক্লাইম্যাক্স ছুঁলো। নিউজিল্যান্ডেও কখনো বাবা-মা মাঠে এসে তাঁর খেলা দেখেননি। আর মুম্বাই টেস্টে প্রথমবারের মতো তাঁরা গ্যালারিতে। টেস্টের বিভিন্ন দিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আত্মীয় পরিজনদের আরও অনেকেরই আসার কথা। যাঁরা পরের দিনগুলোতে আসবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন, তাঁদের এখন আফসোস হতেই পারে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকার কী সুযোগটাই না মিস হয়ে গেল!

মুম্বাই, ২০২১: উদযাপনের মধ্যমণি শুধুই একজন...আজাজ প্যাটেল

যে কীর্তিতে লেকার-কুম্বলের সঙ্গী হয়েছেন আজাজ প্যাটেল, তা শুধু ছোঁয়াই সম্ভব, পেরিয়ে যাওয়া নয়। ইনিংসে ১০ উইকেটের বেশি তো আর নেওয়া সম্ভব না। জিম লেকারের আসল রেকর্ডও তাই এটি নয়। আসল রেকর্ড, যে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ১০ উইকেট, সেই টেস্টেরই প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। ম্যাচে ১৯ উইকেটের এই রেকর্ড ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতোই অবিনশ্বর বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে শুধুই কথা কথা হিসেবে বলি, অনিল কুম্বলের কিন্তু তা ছোঁয়ার বা ভাঙার সুযোগই ছিল না, কারণ তাঁর ১০ উইকেটও দ্বিতীয় ইনিংসে (প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট)। আজাজ প্যাটেলের যে সুযোগ আছে। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস তো এখনো বাকি।

একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে?

তা হয়তো হচ্ছে।

আজাজ প্যাটেলের গল্পটা কি তা-ই নয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×