সেন্ট লুসিয়া টেস্ট ২০০৪

`আমি নিজেই তো অবাক, সেঞ্চুরি মাইরা দিছি!`

উৎপল শুভ্র

২২ আগস্ট ২০২১

`আমি নিজেই তো অবাক, সেঞ্চুরি মাইরা দিছি!`

মোহাম্মদ রফিক: টেস্ট সেঞ্চুরি করে নিজেই অবাক

তাঁর ঝোড়ো ব্যাটিং সামর্থ্যের কথা জানা ছিল সবারই, কিন্তু তাই বলে টেস্ট সেঞ্চুরি? সেই অবাক করা কাণ্ডটাই ঘটেছিল সেন্ট লুসিয়ায়। সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি মজাটা হলো রফিকের প্রতিক্রিয়ায়। অবিশ্বাসের অনুভূতি চোখে-মুখে ছড়িয়ে বলেছিলেন, `আমি নিজেই অবাক হইয়া গেছি, সেঞ্চুরি মাইরা দিছি।`

মোহাম্মদ রফিক হাসছিলেন। এটা বলার মতো কিছু হতো না, যদি ওই হাসি শুধুই আনন্দের হাসি হতো। যে রফিককে সবাই ২০-২৫ রানের ব্যাটসম্যান হিসেবেই জানে, সেই রফিক টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন! সেটিও ৯ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে! তাঁর তো হাসারই কথা।

কিন্তু মোহাম্মদ রফিকের হাসিতে যতটা না আনন্দ, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময়। একটু আগে যা করেছেন, তাঁর নিজেরই যে তা বিশ্বাস হচ্ছে না! এই যে একটু আগে সারওয়ানের বলে চার মেরে ৯৯ থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যাওয়ার পর ব্যাট উঁচিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লেন, তাঁকে বরণ করতে পুরো বাংলাদেশ দল ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে নেমে এল— রফিকের মনে হচ্ছেএটি কোনো সুখস্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলেই যা সুখানুভূতির একটা রেশ ছাড়া আর কিছুই রেখে যাবে না।

গত পরশু সেঞ্চুরি করার মিনিট দশেক পর তাঁর সঙ্গে যে কথা হলো, তার কিছু অংশ এ রকম :

প্রশ্ন: বলুন, কেমন লাগছে?

রফিক: (হাসতে হাসতে) আমার বলার কিছু নাই।

প্রশ্ন: ক্রিকেট নিয়ে অনেক স্বপ্নই তো দেখেছেন। কিন্তু টেস্ট সেঞ্চুরির স্বপ্ন কি দেখেছিলেন কখনো?

রফিক: সত্যি কথা বললে আমি নিজেও অবাক হইছি। ফারুক ভাইরে (বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার ফারুক আহমেদ) কইছিও, আমি নিজেই অবাক যে টেস্ট সেঞ্চুরি মাইরা দিছি। আমি নিজেই অবাক।

প্রশ্ন: পেস বোলিংয়ে আপনার বেশ সমস্যা হতো আগে। আজ এমন ফাস্ট বোলিংয়েও এত ভালো খেললেন কীভাবে?

রফিক: এইটা আমি কী বলব। লাইফে একটা হইয়া গেছে।

প্রশ্ন: সেঞ্চুরি করার পর প্রথম কার কথা মনে হয়েছে?

রফিক: কারও কথাই মনে হয় নাই। আমি নিজেই অবাক হইয়া গেছি যে, সেঞ্চুরি মারছি।

যে টেস্ট সেঞ্চুরির কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেননি, সেই সেঞ্চুরি করার আনন্দে অভিভূত বলেই রফিকের কথাবার্তা এমন হয়ে গেছে ভাবলে ভুল করবেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সবারই জানা, মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কোনো আলোচনা করার চেয়ে কঠিন কাজ আর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। এই সফরের শুরুতে তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের একটা উদাহরণ দিই।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তো অনেক ভালো ভালো ব্যাটসম্যান, আপনি কী ভাবছেন?

রফিক উত্তর দিলেন, ‘আমি কিছুই ভাবছি না। মাঠে নামার পর দেখা যাবে।’

ব্রায়ান লারার বিপক্ষে টেস্টে প্রথম বোলিং করবেন, বিশেষ কোনো প্ল্যান আছে?

রফিক একটু ভাবলেন, ‘লারা ভালো ব্যাটসম্যান। তবে ও ওর ব্যাটিং করবে, আমি আমার বোলিং করব।’

মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে কথা বলা মানেই এমন সব দিগন্ত উন্মোচনকারী তথ্যের সন্ধান পাওয়া। তাই বলে এমন ভাবার কোনো কারণই নেই যে, মোহাম্মদ রফিক মাঠে নামেন আর কোনো কিছু না ভেবেই বোলিং করে যান। ওহো, এখন তো আর শুধু বোলিং বললে চলবে না, ব্যাটিংও বলতে হবে। ডেভ হোয়াটমোরের কণ্ঠটা যে এখনো কানে বাজছে, ‘রফিকের এত লম্বা সময় ব্যাটিং করার ক্ষমতা আছে, এটা আমি একদমই ভাবিনি। টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলেছে ও, যা আমিও করতে পারিনি!’

সেঞ্চুরির পরে সতীর্থর আলিঙ্গনে রফিক। ছবি: গেটি ইমেজেস

সেই শৈশব থেকে ক্রিকেটই রফিকের জীবন। জাতীয় দলে খেলছেন, সেটিও ৯ বছর হয়ে গেল। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা খেলাটা সম্পর্কে তাঁকে কম শেখায়নি। তবে কোনো পুঁথিগত জ্ঞান নয়, সবই তাঁর হাতে-কলমে শেখা। ক্রিকেটটাকে তিনি তাঁর মতো করেই ভাবেন এবং তত্ত্বভারাক্রান্ত নন বলে খুব সহজভাবেই ভাবেন। তারই একটি নমুনা সেন্ট লুসিয়া টেস্টের প্রথম দিন বিকেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় নতুন বল নেওয়ার পর মোহাম্মদ আশরাফুলকে গিয়ে বললেন, ‘নতুন বল নিয়ে দুশ্চিন্তা করিস না। এক সময় তুইও ওপেন করেছিস, আমিও করেছি। নতুন বল আমরা ঠিকই খেলতে পারব।’ এমন গভীর কোনো তত্ত্বকথা নয়। তবে ওই সময়ে রফিকের ওই সহজ-সরল কথাটা অনেকটাই নির্ভার করে দিয়েছিল আশরাফুলকে। 

’৯৭ সালে যে আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা, তাতে মোহাম্মদ রফিকের বোলিংয়ের মতো ব্যাটিংয়েরও বড় ভূমিকা ছিল। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেট ছিল তাঁর, বোনাস হয়ে এসেছিল ওপেন করতে নেমে তার করে দেওয়া ঝড়ো সূচনা। ‘বাংলাদেশের জয়াসুরিয়া’ নামেও তাঁকে ডাকতে শুরু করেছিলেন অনেকে। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের স্থপতিও রফিক, সেটি তাঁর বোলিং দিয়ে নয়, ব্যাটিং দিয়েই। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কখনো কখনো দেখা গেছে, তবে ব্যাটসম্যান রফিক যেন অনেকটা হারিয়েই গিয়েছিলেন।

সেই ব্যাটসম্যান রফিকের পুনর্জন্ম হলো সেন্ট লুসিয়ায়। পুর্নজন্মই, অতীত কীর্তির কথা মনে রেখে রফিকের কাছে ২০ বলে ৩০ রানের প্রত্যাশা থাকত সব সময়ই। তাই বলে টেস্ট সেঞ্চুরি? সেঞ্চুরি করে ফেরার পর রফিককে সবার আগে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। তিনিও মহা বিস্মিত, ‘রফিক ভালো ব্যাটিং করতে পারে, এটা জানতাম। কিন্তু ও যে টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলবে, এটা কখনোই ভাবিনি।’

ব্যাট দিয়েই সেন্ট লুসিয়া টেস্টের চেহারা বদলে দিয়েছেন, বোলার রফিকের কাছে দলের প্রত্যাশা আরও বেশি। বোশেজো স্টেডিয়ামের উইকেট সবাইকে বোকা বানানোর পর প্রথম দিনের খেলাশেষেই ডেভ হোয়াটমোর বলেছেন, এখানে মোহাম্মদ রফিকই হবেন বাংলাদেশের ট্রাম্পকার্ড। তা রফিক কী ভাবছেন? এই সেঞ্চুরির পর তো তার আরো উজ্জীবিত বোধ করার কথা। রফিককে করা হলো প্রশ্নটা। তাঁর উত্তর? ‘বোলিংটাই তো আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। তবে উইকেট পাওয়াটা তকদিরের ব্যাপার। আমি টাইট বোলিং কইরা যামু, ওরা মারলে মারুক।’

এই না হলে মোহাম্মদ রফিক!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×