মোহাম্মদ রফিক

লড়াই যাঁর অন্য নাম

উৎপল শুভ্র

৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

লড়াই যাঁর অন্য নাম

মোহাম্মদ রফিক

মোহাম্মদ রফিকের জীবনী স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় মনে করার কারণ একটাই—মোহাম্মদ রফিক শুধুই একজন ক্রিকেটারের নাম নয়। হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে মানুষের বিজয়ী হওয়ার গল্প। অনন্ত প্রেরণাদায়ী এক গল্প। রফিকের গল্প আপনাকে জানাবে, প্রতিভার সঙ্গে ঐকান্তিক পরিশ্রম যোগ হলে একজন মানুষ শূন্য থেকেও কত বড় হতে পারে!

প্রথম প্রকাশ: ৯ মার্চ ২০০৮। প্রথম আলো।

অনেক দিন আগে কী একটা অনুষ্ঠানে কথায় কথায় বলেছিলাম, মোহাম্মদ রফিকের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বিদায়পর্ব দেখতে দেখতে কথাটা আবারও মনে পড়ল এবং তা থেকে সরে আসার কোনো কারণ দেখলাম না।

কেন এমন বলছি? একজন ক্রিকেটারের জীবনকাহিনী কেন পাঠ্যপুস্তকে থাকবে? বাংলাদেশের পক্ষে দুই ধরনের ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি উইকেট (পরে এই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন সাকিব), সেটি তো আর কারণ হতে পারে না। টেস্টে ১০০ উইকেট, ওয়ানডেতে ১২৫ বাংলাদেশের পক্ষে সেরা হতে পারে, কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসের মহাসাগরে তা সামান্য বুদ্বুদ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘রোল মডেল’ বলতে যা বোঝায়, মোহাম্মদ রফিক সেটিও নন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, খেলোয়াড়ি জীবন শুরুর দিনটি থেকে শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়ে থাকা একই রকম অনুজ্জ্বল পারিপার্শ্বিকতা অনেক সীমাবদ্ধতাকে রফিকের সঙ্গী করে রেখেছে। ক্রিকেটার রফিক, মানুষ রফিক—দুটি মিলিয়ে যা, সেটিকে অনুকরণীয় আদর্শ চরিত্র বলতে অনেকেরই তাই দ্বিধা থাকবে।

তারপরও রফিকের জীবনী স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় মনে করার কারণ একটাই—মোহাম্মদ রফিক শুধুই একজন ক্রিকেটারের নাম নয়। হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে মানুষের বিজয়ী হওয়ার গল্প। অনন্ত প্রেরণাদায়ী এক গল্প। রফিকের গল্প আপনাকে জানাবে, প্রতিভার সঙ্গে ঐকান্তিক পরিশ্রম যোগ হলে একজন মানুষ শূন্য থেকেও কত বড় হতে পারে! পাঠ্যপুস্তকে তো এসবই থাকা উচিত, যা শিশু-কিশোরদের জানিয়ে দেবে, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়।

বিদায়ী টেস্টের শুরুতে স্মারক উপহার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট, ২০০৮। ছবি: এএফপি

‘পরিশ্রম’ শব্দটা লিখলাম বটে, কিন্তু ‘সাধনা’ কথাটাই বরং এখানে বেশি যুক্তিযুক্ত। ক্রিকেটটা রফিকের কাছে নিছকই একটা খেলা ছিল না, তা ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান, তাঁর রুটিরুজি, তাঁর সাধনা। তা ছিল বলেই চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সেও রফিক যখন চলে যাচ্ছেন, তাঁর বিকল্পের কথা ভেবে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। ‘এখনই কেন যাবে’—উচ্চারিত হচ্ছে যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য পরম পাওয়া এ প্রশ্নটাও।

কেরানীগঞ্জের যে তরুণ ব্যাট-বলের টানে একদিন নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ছুটে আসত, চারপাশে বাহারি ব্যাট আর কিটব্যাগ কাঁধে একই বয়সের ঝলমলে তরুণদের দেখে কখনো কখনো হয়তোবা একটু সংকুচিতও হয়ে পড়ত, তাঁর পুরো জীবনটাই লড়াইয়ের গল্প। শুধু লড়াই নয়, লড়াই করে জেতার গল্প।

ছিলেন গড়পড়তা মানের এক বাঁহাতি পেসার। একদিন বিমানের নেটে শখের স্পিন বোলিং দেখে ’৯২ বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানি অলরাউন্ডার ওয়াসিম হায়দার বললেন, ‘আরে, তুমি তো দেখি স্পিনই ভালো করো!’ সেই থেকে মোহাম্মদ রফিক বাঁহাতি স্পিনার এবং বছর না ঘুরতেই জাতীয় দলে। এবার বোধহয় মোহাম্মদ রফিকের লড়াই ফুরোল!

কোথায়, এর পরও তো প্রতি পদেই লড়াই। অভিষেক টেস্টে খেলার পরই বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন। সেটি শুধরাতে সময় লাগেনি, কিন্তু গায়ে লেগে যাওয়া ‘ওয়ানডে স্পেশালিস্ট’-এর তকমাটা মুছে ফেলতে দীর্ঘ অপেক্ষা। বাংলাদেশের প্রথম ১৮ টেস্টের মাত্র দুটিতে খেলেছেন। ১৯তম টেস্টে যখন তৃতীয়বারের মতো সুযোগ পেলেন, সেটি ছিল বড় এক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় কী করলেন? দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র ইনিংসে ৭৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ! মুখে কিছু বলতে হলো না, বল হাতেই বলে দিলেন যা বলার—‘আমি ওয়ানডে বোলার! এবার আমাকে টেস্ট দল থেকে বাদ দে, দেখি!’

ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে শততম উইকেট। ছবি: এএফপিক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে চিনেছে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর, এর আগেও তো রফিকের লড়াইয়ের রঙে রঙিন বাংলাদেশের ক্রিকেট। আইসিসি ট্রফির কদিন আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেল, পেইনকিলার নিয়ে খেলে রফিক আইসিসি ট্রফির সেরা অলরাউন্ডার। হল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচে হারলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্নের সমাধি হয়ে যায়, সেটিতে আকরাম খানের মহাকাব্যিক ওই ইনিংস মুছে দিয়েছে বাকি সব। অথচ স্লগ ওভারে রফিকের দুর্দান্ত এক স্পেলেরও বড় ভূমিকা ওই জয়ে।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ ম্যাচেই প্রথম স্পেলটা করেছেন ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সময়, শেষ স্পেলটা স্লগ ওভারে। উইকেট দরকার—রফিককে ডাকো। রান আটকানো দরকার—রফিককে ডাকো। সব অধিনায়কেরই বড় এক সহায় তিনি।

এসব শুধুই ক্রিকেটীয় দক্ষতার গল্প। কিন্তু রফিকের আসল লড়াইটা তো ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে ছিল না। ডেভ হোয়াটমোর এসেই সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলাদেশের ওয়ানডে দল হবে তারুণ্যে ঝলমল। প্রথম টার্গেট রফিক। ২০০৩ সালে পাকিস্তান সফরে একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রফিকের বয়স কত?’

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বয়সে শুভঙ্করের ফাঁকিটা জানি বলে ‘অফিসিয়াল’ বয়সকে একটু বাড়িয়ে বললাম, ‘তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে।’

হোয়াটমোর অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে বললেন, ‘দিস্ বাগার মাস্ট বি ফোরটি!’

রফিকের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ‘অবিচুয়ারি’ লিখে ফেলতে পারি, জানিয়ে দিয়েছিলেন তাও। পরে শুনেছি, ব্যাপারটাকে চূড়ান্ত করতে রফিককে রুমেও ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। দোভাষী হিসেবে ছিলেন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ। হোয়াটমোরের কথার বঙ্গানুবাদ করে যখন তিনি বললেন, ‘কোচ বলছে, এখন থেকে তুই আর ওয়ানডে খেলবি না। শুধু টেস্ট খেলবি।’ রফিক কী উত্তর দিয়েছিলেন জানেন? শুরুতে ছাপার অযোগ্য একটা গালি ছিল, ‘...পোরে জিজ্ঞেস কর্, ওয়ানডে খেলতে হইলে আমার কী করন লাগব?’

যা করতে হতো, তা এমনভাবেই করেছিলেন যে, হোয়াটমোর চলে যাওয়ার পরও ওয়ানডে দল থেকে রফিককে বাদ দেওয়া যায়নি। উইকেট-রান এসব তো পরের ব্যাপার, এই যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে জেতা, এটাই মোহাম্মদ রফিক।

২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গায়ানায় স্মরণীয় সেই জয়ের পথে  লড়াই করতে করতেই জীবন কেটেছে বলে কি না, ছায়াকেও প্রতিপক্ষ ভেবেছেন কখনো কখনো। হারারেতে হাবিবুল বাশারের সঙ্গে যে কাণ্ড করে দেশে ফিরতে হয়েছিল, এটিও হয়তো ওই নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই। প্রবল প্রতাপশালী ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে পর্যন্ত প্রকাশ্যে লেগে যেতে দুবার ভাবেননি। সহ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে গোলমালও কম হয়নি। যেকোনো সফরে বাংলাদেশ দলে একটা কৌতুকই চালু ছিল—মোহাম্মদ রফিকের আবার একটা কাণ্ড ঘটানোর সময় বোধহয় এসে গেল!
আবার এই রফিকই মুলতানে এগিয়ে যাওয়া নন-স্ট্রাইকার উমর গুলকে রান আউট না করে বলেন, ‘এভাবে জিতলে দেশের বদনাম হতো।’ এই রফিকই একজন স্পিনারের আজন্ম-লালিত স্বপ্ন চতুর্থ-পঞ্চম দিনের উইকেটে বল করতে না পারার আক্ষেপ ভুলে বলেন, ‘কোনো দুঃখ নেই। বাংলাদেশ এখনো নতুন। একদিন ঠিকই বাংলাদেশের টেস্টে চার ইনিংস খেলা হবে।’ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন রফিককে? হাবিবুলকে অকথ্য গালাগালি করতে করতে মারতে যাওয়া লোকটিও রফিক, আবার উমর গুলকে আউট না করে ক্রিকেটীয় চেতনার উত্তুঙ্গ চূড়া ছোঁয়া লোকটিও তো রফিকই।

রফিককে নিয়ে সাংবাদিক মহলে অনেক রসিকতা চালু। তাঁকে ইন্টারভিউ করতে গেলে রসিয়ে রসিয়ে বলার মতো কিছু না কিছু পাওয়া যেতই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা উদাহরণ দিই। সেন্ট লুসিয়া টেস্টে ৯ নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করে ফেললেন। এরপর তাঁর সঙ্গে যে কথাবার্তা, তাতে আমি এমনই চমত্কৃত হয়েছিলাম যে, নিয়ম ভেঙে রফিকের ভাষাতেই তা তুলে দিয়েছিলাম পত্রিকায়। যতবার পড়ি, ততবারই মজা পাই—

প্রশ্ন: বলুন, কেমন লাগছে?

রফিক: (হাসতে হাসতে) আমার বলার কিছু নাই।

প্রশ্ন: টেস্ট সেঞ্চুরির স্বপ্ন কি দেখেছিলেন কখনো?

রফিক: সত্যি কথা বললে আমি নিজেই অবাক হইছি। সবাইরে কইছিও, আমি নিজেই অবাক টেস্ট সেঞ্চুরি মাইরা দিছি।

প্রশ্ন: এমন ফাস্ট বোলিংয়েও এত ভালো খেললেন কীভাবে?

রফিক: এইটা আমি কী বলব! লাইফে একটা হয়ে গেছে।

প্রশ্ন: সেঞ্চুরি করার পর প্রথম কার কথা মনে হয়েছে?

রফিক: কারও কথাই মনে হয় নাই। আমি নিজেই অবাক হইয়া গেছি যে, সেঞ্চুরি মারছি!

`আমি নিজেই তো অবাক, সেঞ্চুরি মাইরা দিছি`! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট লুসিয়া টেস্ট, ২০০৪। ছবি: গেটি ইমেজেসওই সফরের শুরুতেই জিজ্ঞেস করলাম, টেস্টে তো লারাকে প্রথম বল করবেন। প্ল্যান কী? রফিকের জবাবে নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী এক তথ্য, ‘লারা ওর ব্যাটিং করবে, আমি আমার বোলিং করব।’ তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, রফিক খেলাটা বুঝতেন না। না বুঝলে কীভাবে দিনের পর দিন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিয়েছেন! বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার আগে কোনো একজন বোলার নিয়ে হোমওয়ার্ক করতে হলেও তা রফিককে নিয়েই করেছে সব দল। তার পরও রফিক-রহস্যের পুরো সমাধান করতে পারেনি কেউই। বাইরে থেকে দেখলে রফিকের বোলিং এক রহস্যই। স্পিন বোলিং প্রসঙ্গে খুব ব্যবহৃত ‘মায়াজাল’ শব্দটা রফিকের বোলিংয়ের সঙ্গে একেবারেই যায় না। ফ্লাইটের কারুকাজ নেই, বড় টার্ন নেই—রফিকের বোলিং কখনোই ক্রিকেট রোমান্টিকের মন রাঙানোর নয়। তারপরও শুধু জায়গায় বল ফেলে যাওয়ার বাইরেও রফিকের বোলিংয়ে কিছু একটা আছে, যার প্রমাণ বলতে গেলে শুধু প্রথম ইনিংসে বোলিং করেই এক শ উইকেট!

সাদা চোখে তা চোখে পড়ে না বলেই মোহাম্মদ রফিককে একসময় টেস্ট ক্রিকেটের দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছিল। রফিক যতই ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’ হাজির করুন, বিদায়বেলার আবেগে সবাই সেটিকে যতই মহিমান্বিত করার চেষ্টা করুন না কেন, আসলে রফিকের টেস্ট দলে অপাঙেক্তয় হয়ে থাকার পেছনে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ নেই, তা ছিল রফিককে বোঝার অক্ষমতা থেকে এক ‘ঐতিহাসিক’ ক্রিকেটীয় ভুল। এনামুল হক না মোহাম্মদ রফিক—প্রশ্ন ছিল এটা। বাংলাদেশের ক্রিকেট মহলের বেশির ভাগেরই বিশ্বাস ছিল, এনামুলের বলে বৈচিত্র্য বেশি, বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে তিনিই বেশি কার্যকরী।

রফিকেরই তো দোষ! আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল ওই বোলিংয়েই যে এত কিছু লুকিয়ে, সেটি বোঝার সাধ্য কারই বা ছিল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×