হিউজের চলে যাওয়ার দিনে রমন লাম্বাকে মনে পড়ে

উৎপল শুভ্র

৫ মে ২০২১

হিউজের চলে যাওয়ার দিনে রমন লাম্বাকে মনে পড়ে

সিডনিতে যখন সকাল হয়, বাংলাদেশে তখনো সূর্য উঠতে অনেক দেরি। হিসাব করে দেখলাম, লেখাটা যখন শুরু করছি, পাঁচ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতেই ফিলিপ হিউজ এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অজানা অচেনা সেই রহস্যালোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ২৬তম জন্মদিনের তিন দিন আগে।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০১৯। প্রথম আলো।

সিডনিতে যখন সকাল হয়, বাংলাদেশে তখনো সূর্য উঠতে অনেক দেরি। হিসাব করে দেখলাম, লেখাটা যখন শুরু করছি, পাঁচ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতেই ফিলিপ হিউজ এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অজানা অচেনা সেই রহস্যালোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ২৬তম জন্মদিনের তিন দিন আগে।

আগের দুটি দিন ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ২৫ নভেম্বর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সময় বাউন্সার লেগেছিল ঘাড়ের এক পাশে। টালমাটাল হিউজকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখে সবার মনে যে ভয়টা জেঁকে বসেছিল, সত্যি হয়েছিল সেটাই। ফিল হিউজের আর উঠে দাঁড়ানো হয়নি। ২৬ টেস্ট আর ২৫টি ওয়ানডেতেই থেমে যাওয়া আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার অর্জনের গল্পের বদলে তাই অনন্ত এক আক্ষেপের নাম—আরও কত কী-ই না হতে পারত!

ফিল হিউজের ওই মৃত্যু শুধু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটকেই নয়, কাঁপিয়ে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকেই। কোনো ব্যাটসম্যানের মাথায় বল লাগলেই আতঙ্কের শুরুও তখন থেকে। যেটির প্রভাব পড়েছে ক্রিকেটের আইনেও। হিউজের মৃত্যুতেই ‌’কনকাশন বদলি’র চল হয়েছে। হেলমেটে যোগ হয়েছে বাড়তি সুরক্ষা। এসব তো হিউজকে মনে করিয়ে দেয়ই, প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে সতীর্থরাও স্মরণ করেন হারিয়ে যাওয়া বন্ধু-ছোট ভাইকে।

ফিল হিউজকে ‌’অমর’ করে রাখার বন্দোবস্তও করে রাখা হয়েছে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। হিউজের মৃত্যুর কয়েক মাস পর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে গিয়ে প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম স্বাগতিক দলের ড্রেসিংরুমের সামনে। সিঁড়ির ঠিক ওপরে দরজার পাশে ফিল হিউজের স্মরণে ব্রোঞ্জের ফলকটা দেখতে। হিউজের আবক্ষ একটা মুখের ছবির নিচে উৎকীর্ণ তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। সেটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় দেখলাম, ওই ফলকটি দেখার ব্যগ্রতা শুধু আমার একার নয়, এসসিজি দর্শনার্থীদের একটা জটলামতোই হয়ে গেছে সেখানে।

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হিউজ-স্মরণ। ছবি: ফাইল ছবি

ওই ফলকের লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমার রমন লাম্বার কথা মনে পড়েছিল। যেমন মনে পড়ছে ফিল হিউজের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে এই লেখাটা লিখতে বসে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ফিল হিউজকে মনে রেখেছে, মনে রেখেছে বিশ্ব ক্রিকেটও। যত দিন এসসিজিতে ক্রিকেট খেলা হবে, সবাইকে হিউজের কথা মনে করিয়ে দেবে ওই ফলক। কিন্তু রমন লাম্বার স্মরণে এমন কিছু তো কোথাও নেই।

কিন্তু থাকা কি উচিত ছিল না! ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেট বলের আঘাতে মৃত্যুর কথা বললে ফিল হিউজের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। এরপরই তো চোখের সামনে ভেসে ওঠে রমন লাম্বার মুখ। সেটি কি লাম্বার মৃত্যু এই ঢাকায়, শুধু এ কারণে? আমার ক্ষেত্রে কি ভূমিকা রাখছে রমন লাম্বার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতিও? অনেকবার কথা হয়েছে, সাক্ষাৎকারও নিয়েছি কম নয়। তবে এসবই শুধু কারণ নয়। মৃতদের লো প্রোফাইল-হাই প্রোফাইল করে ভাগ করাটা একটু অরুচিকরই লাগে। তবে বোঝানোর স্বার্থে বলা যেতেই পারে, ক্রিকেট বলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে হাই প্রোফাইল তো ফিল হিউজ আর রমন লাম্বাই।

একটা বড় পার্থক্য আছে। হিউজকে শক্তিশেল আঘাত করেছিল ব্যাটিংয়ের সময়। বল মাথায় আঘাত করার সময় লাম্বা করছিলেন ফিল্ডিং। আমাদের অনেকেরই নিজের চোখে দেখা, তবে ক্রিকেটে আগ্রহী বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের তো আর তা নয়। স্মৃতিচারণা তাই করা যেতেই পারে। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। সেই সময়কার ঢাকা স্টেডিয়ামে। এখন যেটির নাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সেই সময়কার আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ এই দেশে কেমন উত্তাপ ছড়াত, আজকের কিশোর-তরুণদের কাছে তা অলীক গল্পগাথা মনে হবে। সেই ম্যাচে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিংয়ের সময় মেহরাব হোসেন অপির শট সরাসরি গিয়ে লাগে লাম্বার মাথায়। স্বভাবগতভাবেই ছিলেন ডাকাবুকো। ক্লোজ ইন পজিশনে বেশির ভাগ সময় হেলমেট ছাড়াই ফিল্ডিং করতেন। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে গিয়ে দাঁড়ানোর সময় ওভারের মাত্র তিনটি বলই বাকি আছে বলে আর হেলমেটের জন্য অপেক্ষা করেননি লাম্বা।

হিউজ আর লাম্বার দুর্ঘটনার আরেকটা বড় পার্থক্য হলো, হিউজ মাঠেই মুখ থুবড়ে পড়ায় সবার মনেই ‘কু’ ডেকেছিল। রমন লাম্বার ঘটনাটা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায়নি। তিনি হেঁটেই মাঠ ছেড়েছিলেন। ড্রেসিংরুমে ফেরার পর অস্বস্তির কথা তো বলেনই, বমিও করেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সে কারণেই। মৃত্যুকে দুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন হিউজ। লাম্বা পেরেছিলেন তিন দিন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তখনকার পিজি হাসপাতালে (আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) লাম্বার মৃত্যু পরবর্তী সেই দৃশ্যগুলো এখনো মাঝে মাঝে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অঝোরে কাঁদছেন লাম্বার আইরিশ স্ত্রী কিম ক্রদারস। হাসপাতালের বারান্দায় ক্রিকেটার, সাংবাদিক, সংগঠক সবার শোকার্ত মুখ। যাতে কিছুটা অবিশ্বাসও মিশে আছে। টগবগে একটা মানুষ এভাবে চলে যেতে পারে!

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ক্রিকেটের জনপ্রিয় মুখ ছিলেন রমন লাম্বা। তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবিটি ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে তোলা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে

কত কিছু বলা হয়েছিল তখন! ঢাকা স্টেডিয়ামে রমন লাম্বার একটা স্মারক থাকবে। একদিকের বোলিং প্রান্তের নাম হবে লাম্বার নামে। এর কিছুই হয়নি। কয়েক বছর পর তো ক্রিকেটই এই স্টেডিয়াম থেকে মিরপুরে চলে গেল। তারপরও যে স্টেডিয়ামে খেলার সময় মৃত্যু ডেকে নিয়ে গেল রমন লাম্বাকে, সেখানে তাঁর একটা স্মৃতিচিহ্ন কি রাখা যেত না?

এটি আরও বেশি মনে পড়েছিল ২০১২ সালে বেলফাস্টে গিয়ে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের একটা টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে সেখানে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। একটা ম্যাচের আগে অনুশীলন নর্থডাউন ক্রিকেট ক্লাব মাঠে। সেখানে গিয়ে দেখি, ছবিতে ছবিতে সাজানো ক্লাব ঘরের দেয়ালে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন রমন লাম্বা। অন্য সব ছবিগুলোতে ক্যাপশন আছে। এই ছবিটার নিচে কিছু লেখা নেই। ক্লাব সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম এই ক্লাবের সঙ্গে লাম্বার ইতিহাস। ১৯৮৪ সালে প্রথম খেলতে গিয়েছিলেন এই ক্লাবে। খেলেছেন আরও কয়েক বছর। ব্যাটে রানের বন্যা বইয়ে দেওয়ার সঙ্গে আরেকটা কাজও করেছিলেন। পেশাদারির শিক্ষা দিয়েছিলেন আইরিশ ক্রিকেটারদের। নর্থডাউন ক্লাব লাম্বাকে এখনো তাই ভোলেনি। অথচ যে ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমে মৃত্যু হলো লাম্বার, সেই আবাহনী রমন লাম্বাকে মনে রাখেনি। রাখলে তো ক্লাবে তাঁর ‌একটা ছবি বা কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকত।

আইরিশ ক্রিকেটে রমন লাম্বার যে অবদান, বাংলাদেশের ক্রিকেটেও কি তার চেয়ে খুব একটা কম? ১৯৯১ সালে লাম্বা আবাহনীতে প্রথম খেলতে আসার আগেই অর্জুনা রানাতুঙ্গা ঢাকা লিগে খেলে গেছেন। এরপর তো খেলতে এসেছেন আরও কত রথী-মহারথীই। তবে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটকে জাগিয়ে তোলার কৃতিত্বটা লাম্বারই প্রাপ্য। দর্শনে-চলনে-বলনে নায়কের মতো, ব্যাটিংয়েও সেটির ছাপ আর তাঁর কাছে রান করাটা যেন ছিল নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই সহজাত কোনো ব্যাপার। তাঁর ব্যাটিংয়ের টানে দর্শক ছুটে আসত মাঠে। লাম্বা সেটির প্রতিদান দিতে পারেননি, এমন খুব কমই হয়েছে।

মৃত্যু মানুষকে এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে রাগ-ক্ষোভ-অভিমান বলে কিছুই থাকে না। নইলে ফিল হিউজের মৃত্যুবার্ষিকীতে রমন লাম্বা হয়তো অভিমান করে বলতেন, তোমরা এত সহজে ভুলে গেলে আমাকে! আমার মৃত্যুবার্ষিকী কখন আসে, কখন যায়, কেউ কি তার খবর রাখো?

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×