যে কারণে বার্সার এমন পতন

দ্য অ্যাথলেটিক

১১ ডিসেম্বর ২০২১

যে কারণে বার্সার এমন পতন

এই ছবিটাই এখনকার বার্সেলোনা। ছবি: গেটি ইমেজেস

এক দশক আগে বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ক্লাব বার্সেলোনা নামতে নামতে এখন পতনের প্রায় শেষ বিন্দুতে। কেন, কিভাবে এমন স্বপ্নের একটি দল ধ্বংস হয়ে গেল? কারণ ‍খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, বার্সেলোনার অস্ত্র দিয়েই বার্সেলোনাকে ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষ দলগুলো। দ্য অ্যাথলেটিক-এর লেখার ভাষান্তরিত রূপ।

মাঝখানে একটা দশক; তর্কযোগ্যভাবে আধুনিক ফুটবলে এক সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবটি এখন ইউরোপের দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতায় লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। গত বুধবার রাতে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় বায়ার্ন মিউনিখের কাছে তিন গোলের পরাজয় হতাশার তো বটেই, তার চেয়েও বেশি হাহাকারের। এই দলটার বিপক্ষেই গত বছর ৮-২ গোলে হেরেছিল কাতালানরা। সেরা খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিয়ে এবং খুব বেশি আক্রমণাত্নক না খেলেও যে অনায়াসে তিন গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে নিল বায়ার্ন, তাতেই দুই দলের মধ্যে ব্যবধানটা পরিষ্কার।

আর নিশ্চিত পতন জেনেও অসম লড়াইয়ে লজ্জা নিবারণের অসহায়ত্বই যেন এই বার্সেলোনার শেষ সম্বল। ক্ষয়িষ্ণু দলটা ক্ষয় ক্ষয় হতে হতে এখন অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। এক দশক আগের আধিপত্য আর জৌলুস হারিয়েছে অনেক আগেই। এই বার্সার গল্পটা এখন খেয়ালি রাজার হেলায় সব হারিয়ে ছিন্ন ভিখারিতে পরিণত হওয়ার  করুণ আর্তনাদ।

একটু সামনে তাকানো যাক। বার্সেলোনা সমর্থকেরা যদি চলমান চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্বের দিকে চোখ রাখেন, তাহলে এই ভেবে আফসোস করবেন যে, মাঠ মাতাচ্ছেন যে কুশীলবরা, তাদের অনেকের গায়েই এক সময় ব্লাউগ্রানার জার্সি শোভা পেত। তাদের আফসোস হতে পারে এই ভেবেও যে, ক্লাব কর্মকর্তাদের ভুল পরিকল্পনা আর খামখেয়ালিপনায় এই তারকাদের ধরে রাখা যায়নি। বরং অচল পয়সা বলে যাদের বাতিল করে দিয়েছিল ক্লাব, তাঁরাই এখন বিদ্রুপের হাসি হাসছে।    

ম্যানচেস্টার সিটি আর প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের দিকেই তাকান। এটা সত্যি যে, বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেও তারা এখনো সর্বোচ্চ শিরোপার ছোঁয়া পায়নি। কিন্তু আপনি ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটা ক্লাবের নাম বলেন, এদের নাম আসবেই। সর্বশেষ দুইবার ইউসিএলের ফাইনালে খেলেছে এই দুটি ক্লাব। হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই শেষ বাধাটা পার হয়ে প্রার্থিত শিরোপাটা জিতবে। আর সেটা হলে অবশ্যই তাতে মুখ্য ভূমিকা থাকবে বার্সেলোনার সাবেক কোচ/খেলোয়াড়দের অথবা বার্সার খেলোয়াড়ি ধারণা/আদর্শের। 

বার্সার সেই সোনালি সময়: ২০১২ সালে পেপ গার্দিওলা ও লিওনেল মেসি। ছবি: গেটি ইমেজেস

বার্সেলোনার পতনের গল্পের সূচনাটা আপনি চাইলে শুরু করতে পারেন ২০০৮ সাল থেকে, যখন কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বার্সেলোনা ছেড়ে যান ক্লাবের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট  ফেরান সোরিয়ানো। বছর দুই পর ক্লাব ছাড়েন তখনকার ডিরেক্টর অব ফুটবল টিক্সি বেগিরিস্তায়েন। ২০১২ সালে সোরিয়ানো আর বেগিরিস্তায়েন একসাথে যোগ দিয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। সোরিয়ানো হলেন সিটির সিইও, আর বেগিরিস্তায়েন যোগ দিলেন ডিরেক্টর অব ফুটবল পদে। বার্সা ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই দুই সংগঠক সিটিতে একই দায়িত্ব পেয়ে দলটাকে সাজাতে চাইলেন অনেকটা বার্সেলোনায় তারা যে নীতিতে কাজ করতেন, সেই নীতিতেই। কারণ সেটাই ছিল বার্সেলোনার সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার মূল সূত্র। তখন সিটির বলার মতো সাফল্য বলতে ছিল একটা এফএ কাপ এবং মানচিনির অধীনে জেতা একটা প্রিমিয়ার লিগ। দায়িত্ব নিয়ে সোরিয়ানো ও বেগিরিস্তায়েন বার্সেলোনা থেকে ধীরে ধীরে আরও বেশ কয়েকজন স্টাফকে সিটিতে নিয়োগ দিলেন। অবকাঠামোগত ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে গুছিয়ে সময় ও সুযোগ বুঝে ডাগ আউটের দায়িত্ব দিলেন পেপ গার্দিওলার হাতে। শুরুর বছরটা মনমতো না হলেও পরের বছর থেকে পেপের অধীনে সিটিজেনরা যে ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলা শুরু করে, তা দেখে সবাই পেপের আমলের বার্সার কথাই বলছিল।   

২০১৭-১৮ মৌসুমে রেকর্ড ১০০ পয়েন্ট ও ১০৬ গোল করে প্রিমিয়ার লিগ জিতে পেপের সিটি তো প্রিমিয়ার লিগের মানটাকেই নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। ধরি ধরি করেও ধরতে না পারা চ্যাম্পিয়নস লিগটা জিতলে হয়তো সোনায় সোহাগা হবে। কিন্তু গত এক দশকে বার্সেলোনা আর ম্যান সিটির বিপরীত যাত্রার কারণটা সহজেই বোঝা যায়। প্রথমে বার্সার মেধাবী কর্মকর্তারা ক্লাব ছেড়ে সিটিতে চলে গেল। তাঁরা নিয়ে গেল কোচিং স্টাফদের। এখন বার্সার নিজস্ব ধরনের খেলাটাও আর ক্যাম্প ন্যুতে দেখা যায় না। সেটা এখন মঞ্চস্থ হয় ইতিহাদ স্টেডিয়ামে।    

পিএসজি অবশ্য এদিক দিয়ে একটু দেরিই করে গেলেছে! কাতারি কর্তৃপক্ষ যখন প্যারিসের ক্লাবটি কিনে নিল, তখন বার্সার কর্মকর্তা আর কোচেরা ইতোমধ্যে নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। তাই তারা হাত বাড়াল বার্সার বাকি থাকা সম্পদটুকুর দিকে: সেরা সব খেলোয়াড়।  

পিএসজিতে এমবাপ্পে, মেসি ও নেইমার। বার্সার সেরা দুই খেলোয়াড়কে ছিনিয়ে আনার মাধ্যমে জন্ম যে ত্রয়ীর। ছবি: গেটি ইমেজেস

কাতারি মালিকরা শুরু থেকেই তারকাসমৃদ্ধ দল গড়ে নজর কাড়ার চেষ্টা করেছিল। পেট্রো ডলারের বদৌলতে ইব্রাহিমোভিচ, বেকহাম, কাভানি, ডি মারিয়াদের সাইন করিয়ে ইউরোপের এলিট সারিতে নাম লেখানোর চেষ্টায় তাদের কমতি ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাইনিংটা তারা করে নেইমারকে দলে ভিড়িয়ে। ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সাইনিংটা আবার সেই ৬-১ ‘ট্র্যাজেডি’র কয়েক মাস পরেই। রিয়াল মাদ্রিদের বিবিসি (বেল-বেনজেমা-ক্রিস্টিয়ানো)’র মোক্ষম জবাব যে এমএসএন (মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার)-এর মাধ্যমে কাতালানরা ফিরিয়ে দিচ্ছিল, সেই ত্রয়ী ভেঙে দেওয়াটা ছিল আধুনিক ফুটবলে পেট্রো-ডলারের ক্ষমতার প্রদর্শনী। বহু চেষ্টা করেও নেইমারের মন বদলাতে পারেনি বার্সা কর্তৃপক্ষ।       

প্রথমত নেইমারকে কেড়ে নিয়ে পিএসজি মেসি-পরবর্তী বার্সার নিউক্লিয়াস কে হবে, সেই পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিল। দ্বিতীয়ত নেইমারকে বিক্রির টাকা দিয়ে কী করা হবে, সেটা নিয়ে দেখা দিলো আরেক সমস্যা। যেন লটারি জিতে গিয়েছে এমনভাবে যত্রতত্র, অপরিকল্পনাহীন অর্থ ব্যয়ে কয়েক বছর পর দেখা গেল বিনিয়োগ তো দূরের কথা, দলের সেরা খেলোয়াড়দের ধরে রাখার মতো অর্থও বার্সার কোষাগারে নেই। বরং আকন্ঠ দেনার দায়ে ক্লাব প্রায় ডুবুডুবু।   

প্যারিসে যেদিন মেসি সপরিবারে পা রাখলেন, সেদিন প্যারিসের রাজপথের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল, কোন যুদ্ধজয়ী সেনাপতি যেন বীরমাল্য গলায় দিয়ে রাজধানীতে ফিরছেন। গত এক দশকে ট্রান্সফার মার্কেটে বার্সেলোনা এবং পিএসজি’র দড়ি টানাটানির ইতিহাস যদি আপনি মনে রাখেন, তাহলে মেসির সাইনিংকে তুলনা করতে পারেন যুদ্ধ জয়ের পর পরাজিত প্রতিপক্ষের কাছ থেকে লুন্ঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন হিসেবে।   

এটাই আজকের ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা: লুন্ঠিত, উলঙ্গ এবং মথিত। এক দশক আগে সৃজনশীল আর আনন্দদায়ী ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ক্লাবটি নিজেদের অপরিণামদর্শিতা আর অপেশাদারিত্বে সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব। স্বপ্নের টিকিটাকা, ক্যাবিনেটে রাখা ট্রফিগুলো, স্বাধীনতার প্রতীক কাতালান পতাকা আর ক্যাম্প ন্যুর ঘাসগুলোর এখন নিজেদের অভিসম্পাত করা ছাড়া আর কি-ইবা করার আছে?

* দ্য অ্যাথলেটিক থেকে সামান্য সংক্ষেপিত অনুবাদ আজহারুল ইসলাম।   

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×