অস্ট্রেলিয়া-জয়ের আসল মাহাত্ম্য

নাজমূল আবেদীন ফাহিম

১৪ আগস্ট ২০২১

অস্ট্রেলিয়া-জয়ের আসল মাহাত্ম্য

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষ, তবে সেই জয়ের রেশ কাটেনি এখনো। দেশের খ্যাতিমান কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমূল আবেদীন ফাহিম বিশ্লেষণ করতে চাইলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের মাহাত্ম্য। এই জয়ের পেছনে নাকি অস্ট্রেলিয়ার অবদানও আছে!

এর আগে অস্ট্রেলিয়া দল আমাদের এখানে সর্বশেষ এসেছিল ২০১৭ সালে। সেবার আমরা একটা টেস্ট জিতেছিলাম, তবে অস্ট্রেলিয়া সেটাকে কিছুটা আপসেট হিসেবেই নিয়েছিল। আমরাও সম্ভবত আশা করিনি, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেব। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা একটা ভালো ফাইট দেব, জিতবও...এমন একটা ধারণা কিন্তু সিরিজ শুরুর আগেও ছিল। কেননা, আমাদের দলটা এখন আগের তুলনায় কিছুটা গোছানো।

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এরকম একটা সিরিজ জয়ের পর ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সবচেয়ে যেটা ইন্টারেস্টিং লেগেছে, আমাদের আজ যে এই পর্যন্ত আসা, এর পেছনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কিন্তু বিশাল অবদান আছে। আমরা যখন টেস্ট স্ট্যাটাস বা ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেলাম, তারপরে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে গাইড করার ব্যাপারে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। আমরা যদি কোচিং লাইনে বা টেকনিক্যাল লাইনে দেখি, ওখান থেকে বেশ কয়েকজন কোচ আমাদের দেশে এসেছিল; টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর পরই হাই পারফরম্যান্স বা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে আমাদের দেশে আসা বেশির ভাগ কোচই অস্ট্রেলিয়ান ছিল। বলতে পারি রিচার্ড ম্যাকিন্স বা শন উইলিয়ামসের কথা। দুজনই দীর্ঘ একটা সময় ধরে আমাদের গেম ডেভেলপমেন্টের দায়িত্বে ছিল। আলী ডি উইন্টার নামে একজন কোচকে আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে পেয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে যিনি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের বোলিং কোচ হয়েছিলেন। তাদের পথ ধরে আরও অনেক অস্ট্রেলিয়ানই কিন্তু কোচ হিসেবে এ দেশে এসেছিলেন, আমাদের ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করেছেন।

আর আমাদের দেশীয় কোচ তৈরির জন্য তখন খুব শক্তিশালী একটা প্রোগ্রাম শুরু হয়েছিল। কোচ তৈরির জন্য সিএ যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, ঠিক সে আঙ্গিকেই কোচ তৈরি, কোচদের পরিচর্যা করার কাজগুলো হচ্ছিল। রস টার্নার নামের এক অস্ট্রেলিয়ানকেও এখানে কৃতিত্ব দিতে হবে। যিনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাগত দিকটায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করতেন। রস টার্নার আমাদের একাডেমির প্রধান হিসেবেও অনেক দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব মিলিয়ে চিন্তা করলে আমাদের ক্রিকেটের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অনেকটাই অস্ট্রেলিয়ার হাতে ছিল।

রস টার্নার। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ানও। ছবি: নিউইংটন

আমাদের ক্রিকেটের উন্নতিতে অস্ট্রেলিয়ার তাই বিশাল একটা ভূমিকা আছে। অবশ্য শুধু আমাদের নয়, অস্ট্রেলিয়া তাদের সাহায্যের হাত সবার দিকেই বাড়িয়েছে। একটা লম্বা সময় ধরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট নিচের দিকে যাচ্ছিল। তারপর অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন বিশেষজ্ঞ ডেকে পাঠানো হয়, তার ফর্মুলা মেনে কাজ করেই ক্রিকেটে নিজেদের ফিরে পায় ইংলিশরা।

এশিয়ার অন্য দেশগুলোকেও ওরা অনেক সাহায্য করেছে। ভারত এখন হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ ক্রিকেটে, তবে টেকনিক্যাল দিকগুলোতে ভারতও অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছে। এখন তাই ভারতীয়রা নিজেরাই নিজেদের পরিচালিত করতে পারে।

২০০০ সালের দিকে, অস্ট্রেলিয়ায় যে হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রামগুলো হতো, সেখানে আমাদের দেশ থেকেও তিনজন করে ক্রিকেটার পাঠানো হতো। একজন কোচও ওদের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেত। আর একদম প্রথম বছর যে প্রোগ্রামটা হয়েছিল, সেখানে একসঙ্গে ১৬ জন ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছিল। নিজেদের অর্থায়নেই হয়তো যেতে হতো আমাদের, তবে ওখানে গিয়ে আমাদের কোচ-খেলোয়াড়রা অনেক কিছু দেখেছে, অনেক কিছু শিখেছে। ওদেরকে অ্যাগ্রেসিভ ক্রিকেট খেলতে দেখে, পজিটিভ ক্রিকেট খেলতে দেখে আমাদের মাঝেও নিশ্চিত করেই এর কিছু প্রভাব পড়েছে। ওরা যে হার্ড ক্রিকেট খেলে, সকাল-সন্ধ্যা অনুশীলন করে...আমাদের কোচরাও সেটা আমাদের দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে। আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে যে 'ইন্টেন্ট'-এর চর্চা এখন দেখছি, সেটা সম্ভবত ওই চেষ্টারই ফল।

অস্ট্রেলিয়ার হাই পারফরম্যান্স টিমের প্রোগ্রামে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে গিয়েই বুঝেছি, আমাদের সঙ্গে ওদের ক্রিকেট-ভাবনার বেশ বড় পার্থক্য আছে। ক্রিকেটটা আসলে কিভাবে ভাবা উচিত, সেটাও শিখেছি। ক্রিকেটে যে অনেক বড় করে ভাবার একটা ব্যাপার, সেটা সেখানে যারা গেছে, তারা প্রত্যেকেই সম্ভবত উপলব্ধি করেছে। আগে আমরা ভালো ক্রিকেটার মানে বুঝতাম, ভালো ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং করলেই বুঝি ভালো ক্রিকেটার হওয়া যায়। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে গেলে যে মানুষ হিসেবে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ হওয়া দরকার, চাপের মুহূর্তে নিজেকে মেলে ধরার জন্য যে ভালো ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু যোগ্যতা দরকার...সেই শিক্ষাটা অস্ট্রেলিয়ানদের কাছ থেকেই পাওয়া। এবং, এই শিক্ষাগুলো অর্জনের জন্য বিস্তৃত একটা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

অস্ট্রেলিয়ার হাই পারফরম্যান্স দলের সঙ্গে বাংলাদেশের শাহাদাত হোসেন রাজীব, আফতাব আহমেদ, ধীমান ঘোষরা। সালটা সম্ভবত ২০০১। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর আমরা বুঝতে পেরেছি, একজন খেলোয়াড়কে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখানে তাই একজন খেলোয়াড়কে অনেক কিছু বুঝতে হয়, জানতে হয়, শিখতে হয়। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে যখন আমরা ট্রেনিং করাতাম, ক্রিকেটের বিস্তৃত ব্যাপারগুলোর অনুশীলন হতো না। কিন্তু ওদের শেখানোর কারণেই হোক কিংবা দেখে দেখে, আস্তে আস্তে আমরা সেসব বুঝতে পেরেছি। যেমন, ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেনিং যে চলতে পারে, আর শুধু একদিন নয়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যে একনাগাড়ে এভাবেই চলতে পারে, সেটা আমরা জানতামই না। কিন্তু ওদের দেখেই আমরা বুঝেছি, অনুশীলনগুলো এভাবেই হয়, এভাবেই চলছে, আর এভাবেই হওয়া উচিত। খেলোয়াড়দের জন্য অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাগুলো ওরা যেভাবে উন্নত করে, বিশ বছর আগে যেমন ছিল, এখন কেমন হয়েছে, সেগুলোও কিন্তু শেখার বিষয়।

বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে হারানোর পর হঠাৎ করেই আমার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এই অবদানগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। শুধু আমি নই, সেখানে যারা গেছে, দেখেছে, তাদের প্রত্যেকেরই সম্ভবত মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া শিক্ষাই যেন ওদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলাম আমরা।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অবদানগুলো আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করব। এই জয়টাও নিশ্চয়ই মনে থাকবে। তবে ওদের সাহায্য আর এই জয়টাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কিভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারি, সেটাই এখন ভাবতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার সমপর্যায়ের একটা দল হিসেবে, কিংবা ওদের ছাড়িয়ে যাওয়া একটা দল হিসেবে আমরা যদি দাঁড়াতে পারি, সেটা কিন্তু দারুণ একটা ব্যাপার হবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×