শরিফুল নিজেকে `একটা কিছু` ভাবে এবং এমন ভাবাটা খুব জরুরি

নাজমূল আবেদীন ফাহিম

১৭ আগস্ট ২০২১

শরিফুল নিজেকে `একটা কিছু` ভাবে এবং এমন ভাবাটা খুব জরুরি

শরিফুলের মধ্যে একজন ভালো ফাস্ট বোলারের সম্ভাবনাই দেখতে পাই। যদিও অতীতে এমন সম্ভাবনা জাগানো অনেক ফাস্ট বোলারই হারিয়ে গেছে। আশা করছি, ওর ক্ষেত্রে সেটা হবে না। ও নিজে নিজের প্রতি যত্নবান হবে। ওর আশেপাশে যারা আছে, তারাও ওর দিকে খেয়াল রাখবে।

শরিফুল ইসলামকে দেখলে প্রথমেই আমার যে কথাটা মনে হয়, তা হলো, এই ছেলেটা নিজেকে কিছু একটা ভাবে। নিজেকে কিছু একটা মনে করা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য পেতে এটা কিন্তু খুব জরুরি। শরিফুল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সিঁড়ি ধরে উঠে এসেছে, বিশ্বকাপ জিতেছে, যে কারণে ওর মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বোধটা আছে যে, হি ইজ ভেরি স্পেশাল। ও বিশ্বের সেরা।

শারীরিকভাবে ও আলাদা করে নজর কাড়ে এমনিতেই। উচ্চতা ভালো, শরীরের কাঠামো ভালো। সময়ের সাথে সাথে শরীরটা আরও শক্তপোক্ত হবে বলেই আশা করা যায়। তবে পেস বোলার হতে গেলে শুধু শক্ত শরীরই তো নয়, মানসিক শক্তিও দরকার। এখন পর্যন্ত যা দেখেছি, তাতে শরিফুলের সেটিও ভালোই আছে।

বয়সের কারণেই হয়তো মাঠে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে দেখা যায় ওকে। তবে অনেক সময় হয় কি, বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গোলমাল হয়ে যায়। কখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কখন নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে…বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও এটা শিখবে বলেই আশা করা যায়। 

অবশ্য অ্যাগ্রেসিভনেস থাকলেও সমস্যা নেই। ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য এটা প্রয়োজনীয় একটা দিকও। এই আক্রমণাত্মক মানসিকতার কারণেই হয়তো ও সব সময়ই উইকেট নিতে ঝাঁপায়। একজন ব্যাটসম্যান ওর ওপর চেপে বসবে, এটা ও মানতেই পারে না। তাই আক্রমণের এই গুণটা ওর ভেতরে থাকলে ও বোধ হয় সেভাবেই নিজেকে ডেভেলপ করবে। এই বৈশিষ্ট্যটা ওর থাকতেই পারে।

আর ওর যে স্কিল, বৈচিত্র‍্য, নিয়ন্ত্রণ..সব কিছুই বয়সের তুলনায় বেশ পরিণত। স্কিলকে কাজে লাগিয়ে সব সময়ই উইকেট নিতে চায় ও। যার প্রমাণ আমরা অস্ট্রেলিয়া সিরিজে পেয়েছি। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে পজিটিভ থাকা, আক্রমণাত্মক থাকা সহজ নয় কিন্তু। এমন একটা দলের বিপক্ষে ও ভাবতেই পারত, 'ডিফেন্সিভ বোলিং করব, রান দেব না'। ও সেটা করে নাই। বারবার উইকেটের জন্য ঝাঁপিয়েছে। এই যে মানসিকতা, এটা ওর বোলিংয়ের খুব ভালো একটা দিক। 

এখানেই থামতে চাইছে না ও, বরং শিখতে চাইছে। বোলিংয়ে যোগ করতে চাইছে নতুন নতুন অস্ত্র। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের চতুর্থ বা পঞ্চম ম্যাচের আগে ওকে বলতে শুনলাম, 'মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে কাটার শিখতে চাই।' এই যে শিখতে চাওয়ার মানসিকতা, শেখার আগ্রহ...এটাই ওকে বোলার হিসেবে আরও পরিণত করবে।

আর বর্তমানে ওর পেস ১৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখছি আমরা। সময়ের সাথে সাথে ওর শরীরটা যখন পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠবে, আমি নিশ্চিত, ওর পেসটা আরেকটু বাড়বে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গতিটাই তো সব নয়; গ্লেন ম্যাকগ্রা, শন পোলক, চামিন্ডা ভাসের মতো বোলাররা ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে বল করেও সাফল্য পেয়েছেন। পেস না থাকলেও সাফল্য পেয়েছেন তাদের স্মার্টনেসের কারণে, তাদের স্কিলের কারণে, মাথা খাটিয়ে বল করতে পারার গুণের কারণে। তাই গতি নিয়ে শরিফুলের চিন্তা করার একদমই কারণ নেই। এখন বলে যে গতি আছে, সেটাকেই ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারলেই ও সাফল্য পেতে পারে।

ওর মধ্যে একজন ভালো ফাস্ট বোলারের সম্ভাবনাই দেখতে পাই। যদিও অতীতে আমরা অনেক ফাস্ট বোলারের মাঝেই সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা হারিয়ে গেছে। আশা করছি, ওর ক্ষেত্রে সেটা হবে না। ও নিজে নিজের প্রতি যত্নবান হবে। ওর আশেপাশে যারা আছে, তারাও ওর দিকে খেয়াল রাখবে।

এই যত্ন রাখা কিংবা খেয়াল রাখাটা আমাদের দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। পেস বোলিং এমনিতেই অনেক ডিমান্ডিং একটা কাজ, অনেক বেশি এফোর্ট দাবি করে। নিজেকে খুব বেশি নিংড়ে দিতে গেলে যেই ধকলটা শরীরের ওপর দিয়ে যায়, সেটা সহ্য করার ক্ষমতা থাকা পেসারদের জন্য খুব জরুরি। এই সহ্য করার ক্ষমতা তখনই হবে, যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে এই চর্চাটা কারও থাকবে। অনেক সময় হয় কি, শারীরিকভাবে পেস বোলিংটা যেহেতু অনেক কষ্টের কাজ, প্র‍্যাকটিসে সেই পরিমাণ কষ্টটা আমরা করতে চাই না। দেখা গেল, ১০০ ভাগের জায়গায় আমরা হয়তো ৯০ শতাংশ এফোর্ট দিচ্ছি। তখন আমার শরীর কিন্তু ওই ৯০ ভাগেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাই, যেখানেই খেলি, সেটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হোক আর ডোমেস্টিক ক্রিকেট, সব সময়ই নিজের সেরাটা দিতে হবে। পেশাদারত্বের এই মনোভাবটা খুব জরুরি।

এই পেশাদারত্বের চর্চা করতে গেলেই আরেকটা ব্যাপার সামনে চলে আসে। আমি কেবলমাত্র তখনই সব সময় ১০০ ভাগ দিতে পারব, যখন আমি মাঠের বাইরেও নিজের যত্ন নেব। অফ দ্য ফিল্ড প্রস্তুতি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা--পেস বোলারদের জন্য এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব মাঠের বাইরের প্রস্তুতির অভাবের কারণে অতীতে কিন্তু অনেক বোলারকেই আমরা হারিয়েছি। সামান্য চোটে, সূক্ষ্ম চিড় থেকেই হয়তো কেউ বড় বড় চোটে পড়ে গিয়েছে, লম্বা সময়ের জন্য রাডারের বাইরে চলে গিয়েছে। নিজের স্কিলটাকে হারিয়ে ফেলেছে। কারও কারও ক্যারিয়ার এ কারণেই শেষ হয়ে গেছে।

এখানে তাই বোর্ডকে, যে ক্লাবের হয়ে শরিফুল খেলছে, ওই ঘরোয়া লিগের দল...সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রাই ফিজিওর চোখে চোখে থাকে, তবে শরিফুল লিস্ট 'এ' ক্রিকেট খেলুক বা ঘরোয়া অন্য কোনো ক্রিকেট, ওর ওপর ফিজিওর চোখ রাখতেই হবে। আর সামনে যেহেতু আমাদের অনেক খেলা, ওর ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হয়ে উঠবে। ওর শরীরটা এখনো গড়ে ওঠেনি পুরোপুরি, তাই ও কতটুকু নিতে পারে, এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজাটাও খুব জরুরি।

বোর্ডের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আলাদা করে একটা উদাহরণও মনে পড়ছে। ২০১১ সালে একটা টেস্ট খেলানোর পর প্যাট কামিন্সকে প্রায় বছর ছয়েক কোনো টেস্ট খেলায়নি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, কেবল তাঁর চোটপ্রবণতার কারণে। মাঝের এই সময়টায় তাঁকে টেস্টের জন্য তৈরির লক্ষ্যে সাই-ফাই গ্র‍্যাভিটি ডিফাইয়িং ট্রেডমিল ভাড়া করেছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ওই  বিনিয়োগের ফল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট পাচ্ছে এখন।

আশা করি, শরিফুলকে নিয়েও সব পক্ষই এমন সচেতনতা দেখাবে। তাহলেই আমাদের একজন আদর্শ পেস বোলার পাওয়ার স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×