আমার নাদির ভাই...

শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

আমার নাদির ভাই...

নাদির শাহ এমনই বর্ণময় এক চরিত্র ছিলেন যে, সবারই তাঁকে নিয়ে কোনো না কোনো গল্প আছে। নাদির শাহর মতোই আন্তর্জাতিক আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকতের একটু বেশিই আছে। খেলোয়াড়ি জীবনে পরিচয় হয়েছিল, এরপর এক সঙ্গে আম্পায়ারিং করেছেন অনেক ম্যাচে। আম্পায়ারিং জীবনেও নাদির শাহর খেয়ালি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যাবে মন ছুঁয়ে যাওয়া এই স্মৃতিচারণায়।

১৯৮৮-৮৯-এর কথা। আমি সেবার সূর্যতরুণের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে এসেছি, রকিবুল ভাই (রকিবুল হাসান) আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। সেই সূর্যতরুণ দলটা খুব ভালো ছিল। বেশ কয়েকজন ভালো মানের ক্রিকেটার ছিল দলটায়; স্থানীয়দের মধ্যে সাদ ভাই (তানজীব আহসান সাদ), ইশতিয়াক ভাই (ইশতিয়াক আহমেদ), মোর্শেদ ভাই ছিলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে আনা হয়েছিল ব্রেন্ডন কুরুপ্পুকে।

তখন আমরা সাত মসজিদ রোডের ঈদগাহ মাঠে প্র‍্যাকটিস করতাম। সেখানেই নাদির ভাইয়ের (প্রয়াত নাদির শাহ) সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তিনি তখন বন্দুকের মতো ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে আবাহনী মাঠে যান। যাওয়ার পথে আমাদের মাঠে পা দেন কখনো-সখনো, মোর্শেদ ভাই-সাদ ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডাও দেন। একদিন সকালবেলা দেখি, ওই তিনজনের মধ্যে হাতাহাতি অবস্থা। যার সূত্রপাত সাদ ভাইয়ের 'নাদির কেন গোসল করে বের হয় নাই' জাতীয় একটা প্রশ্ন থেকে। সেটাই নাদির ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম স্মৃতি।

নাদির ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্য বেড়েছে এরও প্রায় ১১ বছর পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন আমি মাস্টার্স করে বেরিয়েছি কেবল; চাকরি-বাকরি কিছু করি না, ক্রিকেট খেলার কারণে কোচিং করাতাম ধানমন্ডির চার নম্বর মাঠে। তো সেখানেই বাঘ মামার (রফিকুল আলম) সঙ্গে নাদির ভাই আড্ডা দিতে আসতেন। সেখান থেকেই ভালোভাবে চেনা-জানার শুরু।

একটা কথা গর্ব করেই বলতে পারি, নাদির ভাইয়ের সঙ্গে কারও সম্পর্কই আমার চেয়ে বেশি অন্তরঙ্গ ছিল না। অসুস্থ হওয়ার আগে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকত। পাকিস্তান-চীন-নরেন্দ্র মোদি-আমেরিকার সুপারপাওয়ার-মালয়েশিয়ার বিমান-অস্ট্রেলিয়ার জাতি বিদ্বেষ….মানে কোন আলাপ আমার সঙ্গে করেননি তিনি! ধানমন্ডির চার নম্বর মাঠের যে আড্ডার কথা বললাম, ওই আড্ডাটা এখন ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হয়েছে; তবে গত চার-পাঁচ বছরে সেখানে গিয়ে নাদির ভাইকে যখন আমি পাইনি, অনেকবারই আমি চলে এসেছি।আম্পায়ার নাদির শাহর সঙ্গে শরফুদ্দৌলা ইবন শহীদ সৈকত। ছবি: লেখক

আমাকে নিয়ে উনি বেশ মজাও করতেন। ক্ষমতার প্রতি তাঁর একটু আকর্ষণ ছিল। বড় কোথাও দাওয়াত খেতে গেলে হয়তো বা ছবি পাঠিয়ে বলতেন, 'আমার কত খাতির দেখো। তোমাকে তো কেউ ইনভাইট করল না!' আমেরিকা, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতি তাঁর আলাদা দুর্বলতা ছিল। কিন্তু আমি কখনো আমেরিকা যাইনি বলে আমাকে মাঝেমধ্যেই খোঁচা মারতেন। বলতেন, 'কখনো তো আমেরিকাই যাও নাই! তার মানে তোমার পড়াশোনার কিছুই সম্পূর্ণ হয় নাই।' এই আফসোসটা আমার তাই থাকবেই, নাদির ভাইয়ের জীবদ্দশায় আমি আমেরিকা গিয়ে তাঁকে দেখাতে পারিনি।

আম্পায়ার নাদির শাহর কথায় আসি। ২০০৬ সালে আমি ক্রিকেট বোর্ডে আম্পায়ারদের ম্যানেজারের দায়িত্ব পাই। নাদির ভাই আগে থেকেই আইসিসির টিভি আম্পায়ারস্ প্যানেলে ছিলেন, তবে আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মাহবুবুর রহমানের জায়গায় নাদির ভাইকে আইসিসির অল-ফিল্ড আম্পায়ারস্ প্যানেলে তুলে আনা হয়। খবরটা নাদির ভাইকে আমিই দিয়েছিলাম।

আম্পায়ার নাদির শাহর সঙ্গেও আমার অনেক স্মৃতি আছে। এমনিতে যত মজাই নিক, আম্পায়ার হিসেবে আমার প্রতি তাঁর আলাদা একটা রেসপেক্ট ছিল। কারণ, আম্পায়ারিং তো শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার না, আরও অনেক নিয়ম-নীতি জড়িত থাকে এর সঙ্গে। নাদির ভাই কখনো ওইসব 'রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস' দেখতেন না। বলতেন, 'তুমি দেখে যাও, আমি দেখতে পারব না। ভুল হলে আমাকে বলবে।'

আমিও তাঁর সঙ্গে আম্পায়ারিং করতে পছন্দ করতাম। কারণ আম্পায়ার হিসেবে উনি একটা 'কমফোর্ট জোন' তৈরি করে দিতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা যদি বলি, আমাদের অনেকেরই বল গোনায় ঝামেলা হয়, মনঃসংযোগের ঘাটতিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও অনেক আম্পায়ারের দুয়েকটা বল বাদ-টাদ পড়ে যায়। কিন্তু নাদির ভাই যতই ক্যাজুয়াল হন না কেন, বল কখনো মিস করেননি। আর মাঠে খেলোয়াড়দের ওপর যে ওনার নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেটাও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ।

তবে মানুষ হিসেবে উনি যেমন খামখেয়ালি ছিলেন, আম্পায়ারিং করতে গিয়েও মাঝেমধ্যে তার দুয়েকটা ছাপ রাখতেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর উদাহরণটাই বলি। এমনিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার একদিন আগে সব আম্পায়ারকে হোটেলে এসে উঠতে হতো। কিন্তু ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ম্যাচের আগের দিন নাদির ভাই জানালেন, 'আমার সর্দি লেগেছে। তুমি (অ্যান্ডি) পাইক্রফটকে বলে দাও, আমি হোটেলে যাব না, কিন্তু ম্যাচ পরিচালনা করব।' পাইক্রফটকে আমরা সবাই মোটামুটি মেজাজি লোক হিসেবেই জানি। কিন্তু আমি তখনো যেহেতু আম্পায়ারস্ ম্যানেজার, আমাকে গিয়েই জানাতে হলো, 'ওনার বাসা তো কাছেই, তাই উনি একা একা চলে আসবেন কাল।'কী একটা কাণ্ডই না করেছিলেন সেদিন! ছবি: এএফপিপাইক্রফট মেনে নিলেন। সব ঠিক। কিন্তু পরদিন ম্যাচ শুরু হয়ে যাচ্ছে, টস পর্যন্ত হয়ে গেছে, অথচ নাদির ভাই কোথাও নেই। আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমি একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের কথা বলছি! পাইক্রফট আমাকে বললেন, 'সৈকত, তৈরি হয়ে নাও।' আমি তৈরি হচ্ছি, তখন হুড়মুড় করে নাদির ভাই ঢুকলেন। তাঁকে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ দেওয়া হলো।

কিন্তু তখন দেখা গেল, উনি আম্পায়ারের জন্য নির্ধারিত শার্ট আনেন নেই। অন্য আম্পায়ারের কাছেও এক্সট্রা শার্ট নেই। ধানমন্ডিতে তাঁর বাসায় যাওয়ারও সময় নাই তখন। আমি তাই মিরপুরের আশেপাশে যেসব আম্পায়ার থাকেন, তাদের ফোন করতে শুরু করলাম, 'ভাই, কেউ একটা লাল শার্ট দেন। উনাকে মাঠে নামাই।' তো জুয়েল ভাই মিরপুর সাড়ে এগারো থেকে জানালেন, লোকাল পিকনিক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের পিকনিকে একটা লাল রঙের টি-শার্ট দেওয়া হয়েছিল, তাঁর কাছে সেটা আছে। আমি সেটা আনানোর ব্যবস্থা করলাম, এরপর উনি মাঠে নামলেন। গুগল করলেই সেই লাল টি-শার্ট পরা ছবিটা পাওয়া যায়: মাথায় বাদামি রঙের টুপি পরা নাদির শাহ তাঁর চিরচেনা ভঙিতে আঙুল তুলে ব্যাটসম্যানকে আউট ঘোষণা করছেন। তাঁর পরনে লালরঙা যে জামাটা, সেখানে আইসিসি বা স্পন্সর ফ্লাই এমিরেটসের কোনো লোগো নেই।

ব্যক্তি জীবনেও নাদির ভাই এমনই উদাসী ছিলেন। কোনো নিয়ম-কানুন মানতেন না। খাওয়া-দাওয়ার খেয়াল ছিল না। সেটারই সম্ভবত মূল্য দিলেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়ে।

এমনিতে সবাইকেই তো চলে যেতে হবে। নাদির ভাই যদিও বলতেন, উনি প্রতিদিনই আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন, তবে আমরা বুঝতে পারছিলাম, ওনার সময় শেষ হয়ে আসছে। মারা যাওয়ার চার-পাঁচ দিন আগেও তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'সৈকত, আমি ক্রমশ সুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আর চার-পাঁচ দিন হয়তো বা হসপিটালে থাকব।'

কিন্তু তিনি আর পৃথিবীতেই থাকলেন না। এত স্মৃতি জমা হয়েছে মানুষটার সাথে, তাঁকে খুব সহজে ভুলতেও পারব না। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে; এরপরও ধানমন্ডি চার নম্বরে যাব, কিন্তু কেউ আর বলবে না, 'সৈকত, বাসায় চলে আসো।'

শ্রুতিলিখন: রিজওয়ান রেহমান সাদিদ

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×