দুই ইনিংস, তিন ওভার, তিন দিন...এক হ্যাটট্রিক!

উৎপল শুভ্র

২৩ নভেম্বর ২০২১

দুই ইনিংস, তিন ওভার, তিন দিন...এক হ্যাটট্রিক!

মার্ভ হিউজ

ব্রিসবেনে আগের টেস্টেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই ইনিংস মিলিয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ। হিউজের হ্যাটট্রিকও তা-ই। তবে তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন অন্য একটা জায়গায়। তাঁর এই হ্যাটট্রিক শুধু দুই ইনিংস মিলিয়েই নয়, তা তিন ওভারে তিন উইকেট নিয়ে। `তিন` দিয়ে আরও মেলাতে চাইলে এই হ্যাটট্রিক সম্পন্ন হয়েছে তিন দিনে। টেস্ট ক্রিকেটের মন্থরতম হ্যাটট্রিক!

১৯৮৮ সালের এই দিনেরই ঘটনা। তখন খুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। পড়াশোনার বাইরে নিত্যসঙ্গী রেডিও। কখনো বা পড়াশোনার সময়ও। হঠাৎই দুই-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে খেলা তখন দেখার জিনিস নয়, তা শুনতে হয়। শুনে মনশ্চক্ষে তা দেখতে হয়। রেডিও ধারাভাষ্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র। হলের রুমে বিছানায় শুয়ে রুমমেটদের বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে সেটিই শুনছি। পার্থে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা তখন শেষ হওয়ার পথে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলেই গর্ডন গ্রিনিজকে এলবিডব্লিউ করে দিলেন মার্ভ হিউজ। ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট বাড়তি একটু উত্তেজনা তো ছড়ায়ই। ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠেও তা ছড়াল। তবে এই উইকেটের বৃহত্তর তাৎপর্যটা তাৎক্ষণিকভাবে তারাও বুঝতে পারেননি। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন যা বুঝতে পেরে বললেন, 'আরে, হিউজ তো হ্যাটট্রিক করে ফেলেছেন।'

মাঠে মার্ভ হিউজকে ঘিরে অজিদের উদযাপনটাও ইনিংসের প্রথম বলে উইকেটের, হ্যাটট্রিকের নয়। হ্যাটট্রিক হয়েছে বুঝলে তবেই না তার উদযাপন হবে। বোলার বোঝেননি, তার সতীর্থরাও না, কমেন্টটররাও পরে বুঝলেন- তাহলে কেমন সে হ্যাটট্রিক?

মার্ভ হিউজের হ্যাটট্রিকের বিশেষত্বটা এখানেই। টেস্ট ক্রিকেটে যেটির আর কোনো তুলনা নেই। ব্রিসবেনে আগের টেস্টেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই ইনিংস মিলিয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ। হিউজের হ্যাটট্রিকও যে তা-ই, সেটি তো বুঝতেই পারছেন। হিউজ আলাদা হয়ে যাচ্ছেন অন্য একটা জায়গায়। তার এই হ্যাটট্রিক শুধু দুই ইনিংস মিলিয়েই নয়, তা তিন ওভারে তিন উইকেট নিয়ে। 'তিন' দিয়ে আরও মেলাতে চাইলে এই হ্যাটট্রিক সম্পন্ন হয়েছে তিন দিনে। মজা করে অনেকে তাই এটিকে বলেন টেস্ট ক্রিকেটের মন্থরতম হ্যাটট্রিক।

দুই ইনিংসব্যাপী ব্যতিক্রমী এক হ্যাটট্রিকের পর মার্ভ হিউজ

তিন ওভারে তিন উইকেটে যে হ্যাটট্রিক, সেটির বিস্তারিত মনে হয় বলা দরকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসের ৩৬তম ওভারের শেষ বলে কার্টলি অ্যামব্রোসকে আউট করে যার শুরু। পরের ওভারটা করলেন অফ স্পিনার টিম মে, একটা উইকেটও নিলেন। উইকেটে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ জুটি। আবার বল হাতে পেয়ে প্রথম বলেই প্যাট্রিক প্যাটারসনকে আউট করে ইনিংস শেষ করে দিলেন হিউজ। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলে গ্রিনিজের ওই উইকেট। মাঝখানে অস্ট্রেলিয়ার একটা ইনিংস গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে এই হ্যাটট্রিক বুঝতে না পারাটাই তো স্বাভাবিক।

ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি একেকটা ফুল হয়ে মালা গেঁথে চলে। এই হ্যাটট্রিকের বর্ষপূর্তির সূত্র ধরেই যেমন মার্ভ হিউজের একের পর এক ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করেছে। খেলা ছেড়েছেন ১৯৯৪ সালে। এর আগেই বাংলাদেশে ডিশ এসে গেছে। শুধু মনশ্চক্ষেই আর খেলা দেখতে হচ্ছে না, টেলিভিশনের পর্দায়ই তা দেখা যাচ্ছে। মার্ভ হিউজও আর কল্পনার চরিত্র হয়ে নেই। টেলিভিশনে সরাসরিই দেখছি তাঁকে এবং ভালোও বেসে ফেলছি। কারণ শুধুই বোলিং নয়। বিশাল শরীর, বিশাল গোঁফ আর মাঠে তাঁর কাণ্ডকীর্তি এ সবেরও তাতে বড় ভূমিকা। মজাটা হলো, মার্ভ হিউজ নামটি শোনা বা পড়ার সময় টুকরো টুকরো অনেক ছবির ভিড়ে অবধারিতভাবেই সবার আগে আমার চোখে ভেসে ওঠে মজার একটা দৃশ্য। মাঠে কুকুর ঢুকে পড়েছে আর মার্ভ হিউজ সেই কুকুরের কাছে গিয়ে চার হাত-পায়ে নিজেও 'কুকুর' সেজে মজা করে যাচ্ছেন।

ক্রিকেট মাঠে এমন ছবি কে দেখেছে কবে!

দৃশ্যটা ব্যতিক্রমী, এটা তো অবশ্যই একটা কারণ। তবে প্রথমেই এটা মনে পড়ায় এর চেয়েও বড় কারণ বোধ হয় ওই ছবিটার প্রতীকি হয়ে মার্ভ হিউজকে চিনিয়ে দেয়া। পেশাদার জীবনের কঠিন সব দাবি মেটানোর দায় মনে রেখেও খেলার মূল কারণ যে আনন্দ, মার্ভ হিউজ প্রতিনিয়তই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ২০০৫ সালে সিডনিতে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে যখন তাঁকে প্রথম দেখি, তখনও। মাঠে সব সময় এমন মজা করতেন কীভাবে, প্রশ্ন করায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার জীবনের দর্শন- লাইফ ইজ ফুল অব জয়, এনজয় ইট।

উপভোগ করার এই মন্ত্র ছড়িয়ে দিতেন গ্যালারিতেও। একদিন বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করার সময় বোলিংয়ে যাবেন বলে আড়মোড়া ভাঙছেন, হর্ষধ্বনি শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখেন, পুরো গ্যালারি তাঁকে অনুকরণ করছে। এরপর থেকে অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলোতে যা রুটিন হয়ে যায়। বোলিংয়ের মতো ওয়ার্ম আপেও ইম্প্রোভাইজেশনের কথা ভাবতে বাধ্য হন মার্ভ হিউজ। বাড়তি এই দায়িত্ব সম্পর্কে একবার মজা করে বলেছিলেন, 'দর্শকেরা যখন আমাকে অনুকরণ করা শুরু করল, আমার নতুন কিছু না ভেবে উপায় থাকল না। নইলে ব্যাপারটা একঘেঁয়ে হয়ে যাবে না!'

সমস্যাই বটে। মাঠে যেমন, তেমনি মাঠের বাইরেও এই 'একঘেঁয়ে' শব্দটাকে যে চরম অপছন্দ মার্ভ হিউজের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিযোগিতায় বেশির ভাগ ক্রিকেটারকে যেখানে রোবট হয়ে যান, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে মার্ভ হিউজ ছিলেন বর্ণময় এক চরিত্র। নইলে কি আর তার অবসরের খবরটা পাওয়ার পর 'আরেকজন গেলেন' শিরোনাম দিয়ে একটা লেখা লিখে ফেলি! চরিত্রের আকালের মধ্যে মার্ভ হিউজের বিদায় মানে যে ক্রিকেটের আরেকটু রং হারানো, এই আক্ষেপ ছিল যে লেখার মূল সুর।

ইন্টারভিউ করতে গিয়েও পরিচয় পেয়েছিলাম সেই আমুদে চরিত্রের। মার্ভ হিউজকে সামনাসামনি প্রথম দেখার অনুভূতিটাও বলার মতোই। টেলিভিশনে মানুষকে যে অনেক ছোট দেখায়, এই উপলব্ধি আগেই হয়ে গেছে। তারপরও মার্ভ হিউজের পাশে দাঁড়িয়ে তা যেন নতুন করে জেনেছিলাম। দশাসই শরীর তো টেলিভিশনেও বোঝা যেত, কিন্তু তাই বলে এমন! পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হচ্ছিল গালিভারের পাশে লিলিপুট। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দাড়ি যদি ডব্লিউ জি গ্রেসের হয়, সবচেয়ে বিখ্যাত গোঁফের মালিক অবশ্যই মার্ভ হিউজ। কাছে দাঁড়িয়ে সেই গোঁফজোড়াকেও মনে হচ্ছিল আরও দর্শনীয়।

আরেক ‘চরিত্র’ শেন ওয়ার্নের সঙ্গে

মাঠে তাঁর আমুদে চরিত্রে অনেক সময়ই আড়ালে পড়ে যেতেন বোলার মার্ভ হিউজ। অথচ ৫৩ টেস্টে তার ২১২ উইকেট। যখন তাঁর ইন্টারভিউ করি, এর চেয়ে বেশি উইকেট ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাত্র ছয়জন পেসারের। জেফ টমসন, অ্যালান ডেভিডসন, কিথ মিলাররাও উইকেট-সংখ্যায় হিউজের চেয়ে পিছিয়ে। বলের গতির বিচারে ফাস্ট বোলার কখনোই ছিলেন না। প্রথম ৭ টেস্টে মাত্র ২১ উইকেট পাওয়ার পর সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল ব্যঙ্গভরে বলেছিলেন, 'মার্ভ হিউজের সমস্যা হলো, ও নিজেকে ফাস্ট বোলার মনে করে।'

বলের গতিতে হয়তো ফাস্ট বোলার ছিলেন না; কিন্তু ওই শরীর, ওই গোঁফ আর চরম আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা মিলিয়ে ব্যাটসম্যানদের কাছে হিউজকে ফাস্ট বোলারই মনে হতো। ব্যাটসম্যানের মনস্তত্ত্ব হয়তো যোগ করে নিত ১০-১৫ কিলোমিটার বাড়তি গতি। সবচেয়ে বড় শক্তি তো ছিল শরীরের সঙ্গে আনুপাতিক বিশাল হৃদয়। ৫৩টি টেস্টই খেলেছেন যাঁর অধিনায়কত্বে, সেই অ্যালান বোর্ডার একবার মার্ভ হিউজকে দেখিয়ে এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, 'ওর দিকে তাকান। ২০ কেজি ওজন বেশি, কখন কী করে ঠিক নেই। কিন্তু মাঠে ও আপনার জন্য জীবন দিয়ে দেবে। এমন ক্রিকেটারই আমি চাই।'

মার্ভ হিউজের অতি নাটকীয় চরিত্রে আড়াল হয়ে থাকা ভেতরের আগুনটা দেখতে পেয়েছিলেন বলেই সব সময় তাঁকে দলে চেয়েছেন বোর্ডার। হিউজও তার প্রতিদান দিয়েছেন। সাত-আটের দশকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের ত্রিমূর্তি ডেনিস লিলি-গ্রেগ চ্যাপেল-রডনি মার্শ একই টেস্টে অবসর নেওয়ার পর ধুঁকতে থাকা অস্ট্রেলিয়ার পুনরুত্থানে বড় ভূমিকা মার্ভ হিউজের। তিনি ছিলেন বোর্ডারের 'গো টু ম্যান'। উইকেট লাগলেই বল তুলে দিতেন হিউজের হাতে। কখনো বাউন্সার দিয়ে, কখনো স্লো লেগ কাটারে, কখনো বা ব্যাটসম্যানকে স্লেজিংয়ে বিপর্যস্ত করে বেশির ভাগ সময়ই কাজের কাজটা করে দিতেন হিউজ। সেই স্লেজিংয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, গালাগালির সঙ্গে মিশে থাকত কৌতুকও।

যে উপলক্ষে হিউজকে নিয়ে এই লেখা, সিরিজের প্রথম টেস্টে বাইরে বসে থাকার পর ওই পার্থ টেস্টে মাত্রই দলে ফিরেছিলেন। প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮। কার্টলি অ্যামব্রোসের বাউন্সারে বোলিং পার্টনার জিওফ লসনের চোয়াল ভেঙে যাওয়ায় বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছিল হিউজের ওপর। এর চেয়ে ভালোভাবে আর তা পালন করতে পারতেন না হিউজ। ২১৭ রানে ১৩ উইকেট নেওয়ার পরও যে অস্ট্রেলিয়া হেরে যায়, এটা তো আর তাঁর দোষ নয়। দু:খের একটা রেকর্ডও অবশ্য হয়ে যায় এতে। দল হেরেছে, এমন টেস্টে কোনো অস্ট্রেলীয় বোলারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।

১৯৯৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজেও চোট ক্রেইগ ম্যাকডারমটকে ছিটকে দেওয়ার পর মার্ভ হিউজের নিজেকে আরও উজাড় করে দেওয়ার গল্প। ৬ টেস্টে বোলিং করেছিলেন প্রায় তিনশ ওভার। উইকেট পেয়েছিলেন ৩১টি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইনজুরিও। আর মাত্র দুই টেস্ট পরেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়াতেও যেটির দায় আছে।

৫৩ টেস্টে ২১২ উইকেটে ক্রিকেটার মার্ভ হিউজের গল্প লেখা আছে। আর মানুষ মার্ভ হিউজের এই গল্পটাতে। ব্যতিক্রমী হ্যাটট্রিকের ওই পার্থ টেস্টে জিওফ লসনের চোয়াল ভাঙার কথা বলেছি। হাসপাতাল থেকে ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন লসন। ভাঙা হাড় যাতে নড়াচড়া করতে না পারে, এ জন্য তার দিয়ে চোয়ালটাকে আটকে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। ড্রেসিংরুমে ফিরেই র‍্যাপিং পেপারে মোড়া একটা বক্স উপহার পেলেন। খুলে দেখেন, তাতে চুইংগাম। চোয়াল ভেঙে যাওয়ার যার মুখ নাড়ানোর উপায় নেই, তাঁকে কে দিতে পারেন এমন উপহার?

আর কে, মার্ভ হিউজ!

 

* লেখাটা সামান্য পরিবর্তিত রূপে নিউজ বাংলা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×