ক্রিকেটের কল্যাণে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণ
দুলাল মাহমুদ
২৩ নভেম্বর ২০২১
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের একটাই স্বর্ণপদক আর সেটি এসেছে ক্রিকেটের সৌজন্যে। ২০১০ গোয়াংজু গেমসে প্রথম ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হয় এশিয়াডে আর প্রথমবারই বাজিমাত করে বাংলাদেশ। ধারাবাহিকে এবার সেই সাফল্যের গল্প।
১৯৭৮ সাল থেকে অংশ নিলেও এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ প্রথম পদকের দেখা পায় ১৯৮৬ সালে বক্সার মোশারফ হোসেনের কৃতিত্বে। এরপর পদক মেলে জাতীয় খেলা কাবাডির সৌজন্যে। সর্বোচ্চ সাফল্যও এসেছে কাবাডিতে। অবশ্য রৌপ্য পদকের ওপরে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। একটা স্বর্ণপদকের জন্য অপেক্ষা ছিল দীর্ঘ দিনের। ৩২ বছরের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটায় ক্রিকেট।
২০১০ সালে চীনের গোয়াংজুতে ১৬তম এশিয়ান গেমসে প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত হয় ক্রিকেট। তখন খুলে যায় বাংলাদেশের সম্ভাবনার দুয়ার। টি-টোয়েন্টির এই ফরম্যাটে বাজিমাত করলে ইতিহাসের শিলালিপিতে স্থায়ী হয়ে যায় বাংলাদেশের নাম। অবশ্য মেয়েদের ক্রিকেটেও স্বর্ণপদক জয়ের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।
তবে এশিয়ার ক্রিকেটের অভিজাত দেশগুলো এশিয়ান গেমসকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। যে কারণে দলগুলো তাদের মূল একাদশের ক্রিকেটারদের পাঠায়নি। এমনকি বাংলাদেশেরও এটা মূল দল ছিল না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আসন্ন ওয়ানডে সিরিজকে সামনে রেখে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ছাড়তে রাজি হননি তখনকার বাংলাদেশের প্রধান কোচ জেমি সিডন্স। সে সময় সফর করে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে খেলায় অংশ নেওয়া সোহরাওয়ার্দী শুভ, নাইম ইসলাম ও নাজমুল হোসেন এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলে স্থান করে নেন।
জাতীয় দলে অনিয়মিত মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে বড় একটা স্বপ্ন নিয়ে এশিয়ান গেমসে অংশ নেয় বাংলাদেশ। যদিও এই মিশনে যাওয়ার আগে একদমই প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি। মাত্র চার দিনের অনুশীলনে অচেনা চীনে পা রাখে বাংলাদেশ। মিশনটা মোটেও সহজ ছিল না। যদিও প্রেক্ষাপটটা ছিল খানিকটা বাংলাদেশের অনুকূলে। ভারত নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় টার্গেট অনেকটা সহজ হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তান ছিল। ছিল শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান। তারপরও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। পথটাও তেমন দীর্ঘ ছিল না। একটুখানি বুঝেশুনে চলতে পারলে গন্তব্যে পৌঁছানো খুব একটা কঠিন নয়, এটা তারা অনুধাবন করতে পারেন।
এশিয়ান গেমসে কোয়ার্টার ফাইনালে সরাসরি খেলার মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের অভিযান। মালয়েশিয়াকে ৭০ রানে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। মোহাম্মদ মিঠুন, আশরাফুল, সাব্বির রহমান, সোহরাওয়ার্দী শুভদের নৈপুণ্যে জিতলেও খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যতটা সহজে জয় আসার কথা ছিল, ততটা সহজ হয়নি। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়।
আশরাফুলরা সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কার। এই দলটি ছিল শিরোপার অন্যতম দাবিদার। কিন্তু বাংলাদেশের বোলাররা লঙ্কানদের জয়ের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেন। বিশেষ করে সহ-অধিনায়ক সোহরাওয়ার্দী শুভর মায়াবী স্পিনে ধসে পড়ে লঙ্কান ইনিংস। ৬ রানে ৪ উইকেট নেন ফর্মে থাকা বাঁহাতি এই স্পিনার। তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীব। ২৯ রানে নেন ৩ উইকেট। শ্রীলঙ্কাকে ১০১ রানে গুটিয়ে দিলেও জয়টা খুব সহজে আসেনি। ব্যাট হাতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন ফয়সাল হোসেন আর নাইম ইসলাম। ৫ উইকেটে জয় পায় বাংলাদেশ।
পাকিস্তানকে অবিশ্বাস্যভাবে ২২ রানে হারিয়ে আগেই ফাইনালে উঠে আত্মবিশ্বাসী আফগানিস্তান। পাওয়ার ক্রিকেটের ঘরানার এই দলটিকে সমীহ না করে উপায় ছিল না। অঘটন পটিয়সী এই দলটি অবিশ্বাস্যভাবে পাকিস্তানকে টেক্কা দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ তখন ইতিহাস গড়ার স্বপ্নে বিভোর। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের পাশাপাশি এশিয়ান গেমসে ক্রিকেটে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের হাতছানি। এমন একটা সুযোগ আর কখনও পাওয়া যাবে না।
২৬ নভেম্বর ফাইনালে মোহাম্মদ আশরাফুল, নাইম ইসলাম, শাহাদাত হোসেনের বোলিং আফগানিস্তানকে খুব বেশি দূর যেতে দেয়নি। তবে ১১৯ রানের টার্গেটটাকেও কঠিন বানিয়ে ফেলেন ব্যাটসম্যানরা। পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেললে ঘিরে ধরে আশঙ্কার কালো মেঘ। শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায় আফগানরা। তবে নাইম ইসলাম আর সাব্বির রহমানের জুটি সব আশঙ্কা দূর করে দেয়। বিশেষ করে ১৮ বলে তিন ছক্কায় সাজানো সাব্বির রহমানের অপরাজেয় ৩৩ রানের দুর্ধর্ষ ইনিংসটি বিপত্তারিণী হয়ে আসে। চাপের মুখে থাকা বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে স্বস্তি নিয়ে আসে তাঁর তিন ছক্কা। মারকুটে ব্যাটসম্যান সাব্বির ঠাণ্ডা মাথায় নির্বিকার চিত্তে যেভাবে ব্যাট করেন, তা ছিল দেখার মতো। তিনি হয়ে উঠেন পাওয়ার ক্রিকেটের প্রতীক। এক পাশ আগলে রেখে নাইম ৩৪ রানে অপরাজিত থাকেন। তিন বল আগে ৫ উইকেটে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের অধিকাংশ সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে 'পঞ্চপাণ্ডব' হিসেবে খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ। তাঁদের সময়ের যে কোনো সাফল্যে তাঁদের কারও ভূমিকা থাকবে না, এমনটা সাধারণত দেখা যায়নি। অথচ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের ক্ষেত্রে এঁদের কারও অংশগ্রহণ ছিল না।
ক্রিকেটে সাফল্য অর্জনের চেয়ে এশিয়ান গেমসে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের গৌরবে উদ্ভাসিত হয় বাংলাদেশ। তারপরও ক্রিকেটের এই সাফল্যকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। একটি মহাদেশীয় মাল্টি স্পোর্ট ইভেন্টে ক্রিকেটের সংযুক্তি এবং বাংলাদেশের শিরোপা জয় নতুন এক মাইলফলক স্থাপন করে। এর আগে বৈশ্বিক পরিসরে ১৯০০ সালে প্যারিসে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসে একবারই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ক্রিকেট। এরপর তা স্থান করে নেয় এশিয়াডে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই সাফল্য অনেক বড় অর্জন। আর এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক জয় অলিম্পিক গেমসে প্রথম পদক জয়ের স্বপ্নটাকে জাগিয়ে দেয়।