স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৪৭

নিজে কেঁদে বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছেন মাবিয়া

দুলাল মাহমুদ

২ ডিসেম্বর ২০২১

নিজে কেঁদে বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছেন মাবিয়া

ঢাকার খিলগাঁওয়ের সিপাইবাগে ঘিঞ্জি এলাকার নোংরা ঝিলের ওপর টিনের ঘরে যে পরিবেশে মাবিয়ার বেড়ে উঠা, সেই জীবনে স্বপ্ন থাকলেও তা সাধারণত বাস্তব হয় না। মাবিয়া আক্তার সীমান্ত অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সেটাই করে ছেড়েছেন। ২০১৬ এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণ জয়ের পর বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর কান্না কাঁদিয়েছিল পুরো বাংলাদেশকে।

লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উড়ছে, বাজছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। যা দেখে কাঁদতে থাকেন উপস্থিত দর্শকরা। কাঁদতে থাকে পুরো বাংলাদেশ। এই কান্না আবেগের। এই কান্না আনন্দের। এই কান্না গৌরবের। ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের গৌহাটিতে আয়োজিত এস এ গেমসের ভারোত্তোলনে নারীদের ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্বর্ণপদক জয় করার পর মাবিয়া যেন হয়ে যান সমগ্র বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের উপলক্ষ হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় সংগীত বাজানোর গরিমা তাঁর ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। তাঁর সেই অনুভূতি ঝরে পড়ে কান্না হয়ে। তা ছড়িয়ে যায় সীমান্ত ছাড়িয়ে। নিজের দেশকে সেদিন যেভাবে তুলে ধরেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চিরদিনের জন্য জড়িয়ে যায় তাঁর নাম। একইসঙ্গে যেন পুনর্জন্ম হয় তাঁর ব্যক্তিসত্তার। 

যে পরিবেশ থেকে উঠে এসে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেন মাবিয়া, তা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। তবে সেই রূপকথা সিনড্রেলার গল্পের মতো নয়। কোনো জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তাঁর ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। বরং ইচ্ছেশক্তি, পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে যেন ঘুঁটেকুড়ুনি থেকে তাঁর রাজকন্যা হয়ে উঠার কাহিনি। যে প্রতিবেশ ও পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন, সেখানে দেশ, দেশপ্রেম কিংবা দেশাত্মবোধের কোনও পাঠ তাঁর পাওয়ার কথা নয়। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য দু' মুঠো অন্ন যোগাড় করাটাই ছিল সার্বক্ষণিক ভাবনা, এর বাইরে আর কিছু নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ কোথায়? 

সেখানে দেশ কোথায় থাকে? দেশপ্রেম কোথায় থাকে? দেশাত্মবোধ কোথায় থাকে? সেই অনুভূতি আসবে কোথা থেকে? এমন ধারণা যে সঠিক নয়, সেদিন মাবিয়ার কান্নায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবার বুকের মধ্যেই সুপ্ত থাকে মা-মাটি-মাতৃভূমি, আন্দোলিত করে জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা, প্রেক্ষাপট যেমনই হোক না কেন, গৌরবের মুহূর্তে তা যেন ঝর্ণার মতো কল্লোলিত হয়। 

ঢাকার খিলগাঁওয়ের সিপাইবাগে ঘিঞ্জি এলাকার নোংরা ঝিলের ওপর টিনের ঘরে যে পরিবেশে মাবিয়ার বেড়ে উঠা, সেই জীবনে স্বপ্ন থাকলেও তা সাধারণত বাস্তব হয় না। মুদি দোকানি বাবার সীমিত আয়ে স্বপ্নের রঙ ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু জীবনের পাণ্ডুলিপি তো ছকে বাঁধা থাকে না। জীবনের এই নাট্যমঞ্চ কত যে নাটকীয়তায় ভরা, তার অনুপম দৃষ্টিান্ত মাবিয়া। না হলে শক্তির খেলা ভারোত্তোলনে তিনি যেভাবে ভার বহন করে চমকে দেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। বক্সিং কোচ কাজী শাহাদত হোসেন হালকা-পাতলা গড়নের কিশোরী ভাগ্নীকে এমন একটা খেলায় দীক্ষা দেন, তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকার কথা নয়। ভারোত্তোলন যে একটি খেলা, সেটাই তো তাঁর বোধগম্য ছিল না। 

পোড় খাওয়া মাবিয়া বুঝতে পারেন, এমনিতে তাঁকে জীবনভর ভার বহন করেই যেতে হবে, অনুজ্জ্বল সেই জীবন রয়ে যাবে সবার অগোচরে। তারচেয়ে বারবেল সেট বহন করে যদি জীবনে উজ্জ্বলতা আসে, সেই চেষ্টা তো করা যেতেই পারে। অল্প বয়সেই নিজের জীবনকে বদলে দেওয়ার একটা চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেন। একটা জেদ, দৃঢ়তা ও স্বপ্ন তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি যাতে বেশি বেশি ভার বহন করতে পারেন, সেজন্য তাঁকে একটু একটু করে দীক্ষা দেন ভারোত্তোলন কোচ ফারুক আহমেদ সরকার, শাহরিয়ার সুলতানা সূচি। 

অনেক যন্ত্রণা, অনেক অতৃপ্তি আর অনেক ক্ষুধা নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে ঢুকতেন মাবিয়া। কিন্তু যখন বারবেল সেট বহন করতেন, তখন যেন শরীরে অলৌকিক এক শক্তি পেতেন। ভুলে যেতেন জীবনের না পাওয়া সব কষ্ট। ছোট্ট শরীরের দুই হাতে অবলীলায় তুলে নিতেন ভারী ভারী বারবেল। চোখে-মুখে লেপ্টে থাকত একটা সংকল্প। ভিতরে ভিতরে পোষণ করতেন জীবনকে বদলে ফেলার অনমনীয় মনোভাব। এই মানসিকতা তাঁকে আরও বেশি প্রত্যয়ী করে তোলে। 

২০১০ সাল থেকে শুরু তাঁর সংগ্রামী পথচলা। ২০১২ সালে দশম জাতীয় মহিলা ভারোত্তোলনে ৫৩ কেজি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে জয় করেন স্বর্ণপদক। শুরু হয় তাঁর জয়যাত্রা। তবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণপদক দিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। এরপর থেকে তিনি তাঁর ক্যাটাগরিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খুব সহসা স্থান করে নেন জাতীয় দলে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীপ্তি ছড়াতে থাকেন। 

২০১২ সালে নেপালে প্রথম এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ৫৩ কেজি ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পদক পাওয়া দিয়ে শুরু হয় সাফল্যের ধারা। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ায় কমনওয়েলথ সিনিয়র ইয়ুথ অ্যান্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের জুনিয়র গ্রুপে রৌপ্য এবং ইয়ুথ বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক, ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে দ্বাদশ ইজিএটি কিংস কাপ চ্যাম্পিয়নশিপে ৬৩ কেজি ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পদক, উজবেকিস্তানে প্রথম আফ্রো এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক, ২০১৫ সালে ভারতের পুনায় কমনওয়েলথ সিনিয়র ইয়ুথ অ্যান্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে ইয়ুথ বিভাগে  স্বর্ণপদক, জুনিয়র এবং সিনিয়র বিভাগে রৌপ্যপদক জয় করেন। কাতারের দোহায় দ্বিতীয় কাতার কাপ অ্যান্ড এশিয়ান ইয়ুথ জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। 

২০১৬ সালে এস এ গেমসে দেশবাসীর মনোযোগ কেড়ে নেন মাবিয়া। স্বর্ণপদক জয় করেন ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে।  ভারতের গুয়াহাটির ভোগেশ্বর ইনডোর স্টেডিয়ামে সেই গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক আসে তাঁর মাধ্যমে। পদক গ্রহণের সময় তাঁর চোখ বেয়ে অবিরল ধারায় ঝরতে থাকে অশ্রু। ভারোত্তোলনে দ্বিতীয় আর মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্বর্ণপদক তাঁর। অথচ গেমসে অংশ নেওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁর হাতে ব্যথা পান। অনুশীলন করার সময় কনুইয়ে ফ্র্যাকচার হয়। যে কারণে গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়েও তাঁর সংশয় ছিল। এ নিয়ে তাঁর মনের ভিতর চলে অন্তহীন টানাপোড়েন৷

 জীবনে তো সুযোগ বার বার আসে না। এমন সুযোগ তিনি ছেড়ে দেবেন? আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে যদি বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়, তখন কী হবে? শেষ পর্যন্ত মনের জোরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। একটা পদক পাওয়া গেলে মন্দ কি। স্বর্ণপদক জয় করার প্রশ্নই ছিল না। ভেবেছিলেন, ব্রোঞ্জ তার বেশি হলে রৌপ্যপদক পাবেন। কিন্তু ছাড়িয়ে যায় তাঁর প্রত্যাশা। ২০১০ সালে ঢাকায় এস এ গেমসে ভারোত্তোলনে প্রথম স্বর্ণপদক আসে হামিদুল ইসলামের সাফল্যে। দ্বিতীয় এবং দেশের বাইরে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্ব মাবিয়ার।

মাবিয়া ২০১৬ সালের কাতার কাপ এবং এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ৬৩ কেজি ক্যাটাগরিতে দুটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্যপদক অর্জন করেন। ২০১৮ সালের মিশরের কায়রোয় পঞ্চম সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপে ৭১ কেজি ক্যাটাগরিতে দুটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়ায় ইয়ুথ ও জুনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যথাক্রমে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। 

এস এ গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জয় করা যেখানে দুরুহ, সেখানে একজনের পক্ষে দ্বিতীয়বার তা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু মাবিয়া যেন অন্য ধাতুতে গড়া৷ অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলাই তাঁর মিশন। আত্মবিশ্বাসী মাবিয়া ২০১৯ সালের নেপালের পোখরায় ত্রয়োদশ এস এ গেমসে আবারও বাজিমাত করেন। ৭৬ কেজি ক্যাটাগরিতে তিনি জয় করেন স্বর্ণপদক। এস এ গেমসে পর পর দুইবার একক ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব বাংলাদেশের আর কোনও নারীর নেই। 

মাবিয়া কাতারের দোহায় এশিয়ান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ, চীনের নানজিংয়ে এশিয়ান ইয়ুথ গেমস, থাইল্যান্ডে এশিয়ান ইয়ুথ অ্যান্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ, বাকুতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমস, অস্ট্রেলিয়ায় ১৮তম কমনওয়েলথ গেমস, ইন্দোনেশিয়ায় ১৭তম এশিয়ান গেমস, তুর্কমেনিস্তান এবং থাইল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, কাতারের দোহায় ষষ্ঠ কাতার কাপ, উজবেকিস্তানের তাসখন্দে ষষ্ঠ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিয়েছেন।

ইচ্ছে, আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে একটি ঘুপচি ঘরে বসবাস করেও যে বড় স্বপ্ন দেখা যায়, জয় করা যায় জগত, আবারও তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। সাফল্যের জন্য যে আত্মবিশ্বাস, সংকল্প ও নিবেদন থাকতে হয়, তার কোনও কমতি কখনই তাঁর ছিল না। আর এই কারণেই তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। অসংখ্য নারীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন আস্থা, নির্ভরতা ও সাহসিকতার প্রতীক।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×