স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৪৮
অনন্যা এক সাঁতারু শিলা
দুলাল মাহমুদ
৫ ডিসেম্বর ২০২১
যাঁকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর কল্যাণেই পরপর দুদিন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছিল ২০১৬ এস এ গেমসে। মাহফুজা খাতুন শিলার গল্পটা তাই অদম্য মনোবল ও সাফল্যতৃষ্ণারও বটে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ এই সাঁতারুর কথা।
তাঁকে নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। বরং একরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করা হয়। সেই বয়সে তাঁর নাকি আর কিছু দেওয়ার নেই। দাগিয়ে দেওয়া হয় শেষ বিকেলের সূর্য হিসেবে। অথচ তখন তাঁর বয়স ২৬। অভিমানী মেয়েটিও নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। যে সাঁতারে জীবনের সেরা সময়টা দিয়ে এসেছেন, সেখান থেকে এমন অবজ্ঞা, অবহেলা আর অবমাননা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। পারার কথাও নয়। ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের উপেক্ষায় সাঁতার ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে বিধাতা তাঁর ভাগ্যে যদি ভালো কিছু লিখে রাখেন, তাহলে তা কে খণ্ডাবে?
জীবনের দোদুল্যমান এক মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা মেয়েটির মন ভালো করে দেন। যেটির উপলক্ষ হয়ে আসেন দক্ষিণ কোরিয়ার সাঁতার কোচ পার্ক তে গুন। জহুরি যেমন জহর চেনেন, তেমনিভাবে তাঁকে চিনেছিলেন গুন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের কোচ থাকার সময়ই তিনি মাহফুজা খাতুন শিলাকে চিনতেন। তাঁর ভিতরে যে সুপ্ত আছে অফুরন্ত সম্ভাবনা, সেটা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। সেই সময় তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেননি।
২০১৬ সালের এস এ গেমস উপলক্ষে আবার যখন কোচ হিসেবে আসেন, তখন শিলাই হয়ে যায় তাঁর বাজির দান। অভিজ্ঞ এই কোচ ভুল তাস খেলেননি। অনেকের ভ্রূকুটি আর আপত্তি আমলে না নিয়ে শিলাকে তিনি ঘষেমেজে গড়ে তোলেন। কোচের উৎসাহে দারুণভাবে উজ্জীবিত হন শিলা। তারপর তো ভারতের গুয়াহাটিতে দেখা যায় অদম্য এক সাঁতারুকে। এস এ গেমসে একটি নয়, দুই-দুইটি স্বর্ণপদক জয় করেন।
তাঁর কৃতিত্বে পর পর দুদিন গুয়াহাটির ডক্টর জাকির হোসেন অ্যাকুয়েটিক কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজে। ৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ৩৪.৮৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। পরদিন ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণপদক জয় করেন এক মিনিট ১৭.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে। এর আগে বাংলাদেশের কোনো নারী সাঁতারুর এককভাবে স্বর্ণপদক জয়ের নজির ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম নারী সাঁতারু হিসেবে তো বটেই, প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে একই গেমসে এককভাবে দুটি স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়ার মেয়ে শিলা। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে। সারাক্ষণ খেলাধুলায় মেতে থাকতেন। ছুটতে পারতেন দুরন্ত গতিতে। অ্যাথলেট হিসেবে টুকটাক পরিচিতি পেতে থাকেন। কিন্তু একবার থানা পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে দেখেন, অ্যাথলেটিকস ইভেন্ট শেষ হয়ে গেছে। বাকি আছে সাঁতার প্রতিযোগিতা। অভিভাবক হিসেবে সঙ্গে থাকা শিক্ষক জানতে চাইলেন, সাঁতার জানে কি না। এত দূর এসে একেবারে কোনো কিছুতে অংশ না নিলে কেমন দেখায়!
শিলা ছিলেন জলের পোকা। যখন-তখন পানিতে নেমে যেতেন। আপন মনে সাঁতার কাটতেন। তবে কোনো প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নেন নি। সেদিন শিক্ষকের কথায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পদক জয় করেন। এরপর থেকে তিনি সাঁতারকে আপন করে নেন। শুরুর দিকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেক পদক পেতে থাকেন এই জলকন্যা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন।
দরিদ্র পরিবারে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন আয়-উপার্জনের অন্যতম অবলম্বন। একবার তাঁর পাওয়া একটি স্বর্ণপদক বিক্রি করে সংসারের দায় মিটাতে হয়। প্রিয় পদকটি হারিয়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন। সেই কান্না তাঁকে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখিয়ে ছিল। ভিতরের কষ্টটাই হয়ে ওঠে তাঁর সাফল্যের জ্বালানি। তবে চলার পথে মোটেও সহজ ছিল না। প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় নানান রকম বাধা-বিপত্তি। গ্রামের একটা মেয়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সাঁতার কাটাটা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা দেয়। তাঁদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন শিলা।
নিজেকে মেলে ধরার জন্য বড় মঞ্চ হিসেবে পেয়ে যান ২০০২ সালের সপ্তম বাংলাদেশ গেমস। যশোর জেলার হয়ে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। সময় নেন এক মিনিট ৩৫.৫৭ সেকেন্ড। এছাড়া ৪×১০০ মিটার রিলেতে সাবিনা ইয়াসমিন, লিপি আক্তার ও তানজিনা সুলতানার সঙ্গে ব্রোঞ্জ পদক পান। রেজাল্ট দৃষ্টি কাড়ার মতো না হলেও তাঁর সাঁতার নজর কাড়ে বিকেএসপির ট্যালেন্ট হান্ট টিমের। সেই সুবাদে ২০০৩ সালে সাভারের এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন অষ্টম শ্রেণিতে। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। বিকেএসপিতে পরিপূর্ণ সাঁতারু হিসেবে তাঁকে গড়ে তোলা হয়। অনুপ্রাণিত করেন বিকেএসপির কোচ আব্দুল মান্নান। এরপর থেকে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন।
২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় দশম এস এ গেমস দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার তাঁর অভিষেক হয়। সেই গেমসে ১০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে দুটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ২০০৭ সালে ভারতের কলকাতায় এবং ঢাকায় যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা গেমসে সাফল্য পান। ২০১০ সালে ঢাকায় একাদশ এস এ গেমসে কয়েক মাইক্রো সেকেন্ডের কারণে ৫০ এবং ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণপদক হাতছাড়া হয়। ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে ৩৫.৪৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে রৌপ্যপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ৩৫.১৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন শ্রীলঙ্কার নাতাশা করুনানাথন। ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকেও নাতাশার সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে হারতে হয়। তিনি সময় নেন ১.১৮.৭৬। নাতাশা ১.১৮.৬০। ৪×১০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী দলে ছিলেন সবুরা খাতুন, ডলি আক্তার, শিলা ও সনিয়া আক্তার টুম্পা।
তখন থেকে এস এ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের তাড়না অনুভব করতে থাকেন। ২০১৩ সালে যোগ দেন নৌবাহিনীতে। সেখানে প্রশিক্ষণের চমৎকার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্মাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া শিলা পরবর্তী এস এ গেমসে তার ফল পেয়ে যান। জয় করেন দুটি স্বর্ণপদক। একই বছর শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় সাউথ এশিয়ান অ্যাকুয়াটিক চ্যাম্পিয়নশিপে লাভ করেন রৌপ্যপদক। জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন অর্ধ শতাধিক স্বর্ণপদক।
এই জলকন্যা ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজুতে এশিয়ান গেমস, ভারতের দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে দশম ফিনা ওয়ার্ল্ড সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৩ সালে স্পেনের বার্সেলোনায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডের গ্লাসগোতে কমনওয়েলথ গেমস, ২০১৬ সালে কানাডার উইসজরে ওয়ার্ল্ড সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৭ সালে আজারবাইজানের বাকুতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমস এবং ২০১৭ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ওয়ার্ল্ড সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন।
ইতোমধ্যে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন শিলা। সর্বশেষ ২০২১ সালে পেয়েছেন শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কর। ফুরিয়ে গেছেন বলে অবহেলা ভরে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলার যখন চিন্তা-ভাবনা হচ্ছিল, তেমন একটা অবস্থায় সুযোগ পেয়ে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশকে গৌরবান্বিত করেন, তেমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি দেখা যায় না। লড়াকু এই মানসিকতার কারণে অনন্য হয়ে আছেন সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা।