স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৪৬
ফুটবলের রাজকুমার মেসি যখন বাংলাদেশে
দুলাল মাহমুদ
২৯ নভেম্বর ২০২১
এক সময় যা ছিল কল্পনা, সেটিই বাস্তব হয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নেমে এসেছিল ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা খেলতে নেমেছিল নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ’স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০’ ধারাবাহিকে আজ সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণা।
যুগ যুগ ধরে ফুটবলের স্পন্দনে উদ্বেলিত হয় এ দেশের মানুষ। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ফুটবলকে ঘিরে এই ভূখণ্ডে আবেগের ঢেউ। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ অপেশাদার দল ইজলিংটন কোরিন্থিয়ান্স দলের সফর দিয়ে বিদেশি দল ও ফুটবলারদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় পূর্ব বাংলার। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত চার জাতির কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট (ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ও সিলোন) এবং ১৯৬৭ সালে তিন জাতির আরসিডি কাপে (তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান) অংশ নেয় সেই দেশগুলোর জাতীয় দল৷ এই দলগুলোর মাধ্যমে ভিন্ন রকমের ফুটবলের স্বাদ পাওয়া যায়।
১৯৫৮ সাল থেকে আয়োজিত আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে অংশ নেয় এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ফুটবল দেশগুলোর শক্তিশালী ক্লাবগুলো। এটিকে এশিয়ায় প্রথম সংগঠিত আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই প্রতিযোগিতাটিকে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগের পূর্বসূরি হিসেবেও ধরতে পারেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিদেশি জাতীয় ও ক্লাব দল পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মিতই খেলতে আসত। সেই দল বা খেলোয়াড়দের মধ্যে এশিয়ার সেরাদেরও কেউ কেউ ছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফিফার সদস্য হওয়ার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় ফুটবলের নতুন দিগন্ত। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল টুর্নামেন্ট। এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ফুটবল উৎসব। ১৮টি দেশের এই প্রতিযোগিতা দারুণভাবে মাতিয়ে দেয় সবাইকে। আগা খান গোল্ড কাপের আয়োজনও অব্যাহত থাকে৷ তবে আশির দশকের শুরুর পর এই টুর্নামেন্ট আর আয়োজিত হয়নি। তার পরিবর্তে ১৯৮১ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ এবং ১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ আয়োজিত হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৫, ১৯৯৩ ও ২০১০ সালের এস এ গেমস এবং ২০০৩, ২০০৯ ও ২০১৮ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল নতুন ব্যঞ্জনা এনে দেয়। এছাড়াও জাতীয় কিংবা ক্লাব দল নিয়ে ঢাকার মাঠে অনেকবার আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর বসেছে। তাতে খেলেছেন খ্যাতিমান ফুটবলাররা।
তবে বিশ্বকাপে খেলা ফুটবলারদের ঢাকার মাঠে খুব একটা দেখা যায়নি৷ যতটা জানা যায়, ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ক্যামেরুনের হয়ে খেলা থেওফিল আবেগা ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে আসেন। চ্যাম্পিয়ন সুইজারল্যান্ডের ভেভে স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে তিনি খেলেন। তিনি ছিলেন ঢাকার মাঠে প্রথম বিশ্বকাপার। ঢাকার ক্লাব দলগুলোর হয়ে বিশ্বমানের অনেক ফুটবলার অংশ নিয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৮৭ সালে ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আবাহনীতে খেলেন ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ খেলা দুই ইরাকি ফুটবলার সামির শাকির ও করিম মোহাম্মদ আলভী। সে মৌসুমেই মোহামেডানের কোচ কাম গোলরক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করা নাসের হেজাজি। এই গোলরক্ষক লিগের একটি ম্যাচে আবাহনীর বিপক্ষে কিছুক্ষণ খেলেন। (পরবর্তীকালে ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা কোস্টারিকার স্ট্রাইকার দানিয়েল কলিন্দ্রেস সে বছরই খেলেন বসুন্ধরা কিংসের হয়ে।)
বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ বলতেই এইটুকুই। তারপরও ফুটবল অন্তপ্রাণ এ দেশের মানুষের অন্তরে ছাপ ফেলে বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশেষ করে আশির দশক শুরু থেকে টেলিভিশনের কল্যাণে এই ফুটবল ফিয়েস্তায় বুঁদ হয়ে যায়। বিশ্ব ফুটবলের দুই পরাশক্তি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে যায় বলতে গেলে পুরো দেশ। লাতিন এই দুই দেশ এবং তাদের হয়ে অংশ নেওয়া ফুটবলাররা হয়ে উঠেন স্বপ্নের নায়ক। তাদের নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়, তার কোনো তুলনা চলে না। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বকালের সেরা দুই ফুটবলার পেলে আর ম্যারাডোনার পর আলোচনায় উঠে আসেন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি।
স্বপ্নের এই ফুটবলারদের খেলা দেশের মাটিতে বসে সামনা-সামনি দেখার কথা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। কিন্তু কল্পনাতীত অনেক কিছুও কখনো কখনো সত্যি হয়ে যায়। ফুটবলের দুই মহারথী পেলে আর ম্যারাডোনার খেলা দেখার তো সুযোগ আর নেই। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ফুটবলার মেসি। তিনিও তো মহানায়ক। সেই মহানায়ককে ঢাকার মাঠে খেলতে দেখা ছিল স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু। শুধু কি তাই? দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা এবং অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী নাইজেরিয়ার খেলা দেখা কি কম বিস্ময়কর?
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য ঢাকা সফরে আসে আর্জেন্টিনা এবং নাইজেরিয়া। এই ম্যাচের ওজন ছিল যথেষ্ট ভারী। ম্যাচ আয়োজন মোটেও সহজ ছিল না। সফরের আগে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সহকারী কোচ জুলিয়ান কামিনোসহ একাধিক কর্মকর্তা সফরের খুঁটিনাটি যাচাই করে কিছু শর্ত পূরণের নির্দেশনা দিয়ে যান। সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়। প্রদর্শনী এই ম্যাচকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ফিফা। এই ম্যাচকে ঘিরে মেতে ওঠে পুরো দেশ। অবশ্য একটা পর্যায়ে ম্যাচটির আয়োজন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। প্রকৃত েঅর্থেই অনেকেরই কাছে এই ম্যাচ আয়োজন ছিল অবিশ্বাস্য।
সব সংশয় আর অবিশ্বাস দূর করে দিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে বাংলাদেশ বিমান থেকে ঢাকায় পা রাখে লিওনেল মেসির নেতৃত্বাধীন আর্জেন্টনা ফুটবল দল। বিমানবন্দরে তাঁদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত মেসি ছিলেন ফুটবল অনুরাগীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। অনুশীলনের সময়ও মেসিকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। মাস তিনেক আগে আবুজায় নাইজেরিয়ার কাছে বিস্ময়করভাবে ৪-১ গোলে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ায় এই ম্যাচটিতে ফুটবল বিশ্বেরও নজর ছিল।
ঈদের ছুটির আমেজ এবং টিকিটের চড়া দামের কারণে স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিতি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল৷ সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দর্শকের ঢল নামে। আর্জেন্টিনা আর মেসির আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা কি এত সহজ! যে দল এবং যে মহাতারকাকে নিয়ে দূর থেকে অন্তহীন মাতামাতি চলে, তাদের এতটা কাছাকাছি পেয়ে কি নিশ্চুপ থাকা যায়? স্টেডিয়াম এলাকায় বিক্রি হয় আর্জেন্টিনার জার্সি, পতাকা, ব্যান্ড। সবুজ গালিচার মতো ঘাসের মাঠে পদচারণা ঘটে বিশ্ব ফুটবলের তারকা খেলোয়াড়দের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গঞ্জালো হিগুইয়েন, সার্জিও আগুয়েরো, হাভিয়ের মাচেরানো, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, নিকোলাস ওটামেন্দি, ডেমিচেলিস, পাবলো জাবালেতা, সার্জিও রোমেরো প্রমুখ।
তবে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মেসি। তাঁর পায়ে বল গেলে দর্শকদের বুকের স্পন্দন বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। গলা ফাটিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন দর্শক। চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে মেসির নাম। তিনিও তাঁর পায়ের জাদু দিয়ে ছড়িয়ে দেন মুগ্ধতার আবেশ। খেলায় আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জয়ী হয়। হিগুয়াইনের আর ডি মারিয়ার গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর একটা গোল পরিশোধ করেন নাইজেরিয়ার ওবাসি চিনেদু। নাইজেরিয়ার ডিফেন্ডার এলডারসনের আত্মঘাতী গোলে জয়ের ব্যবধান বাড়ায় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার তিনটি গোলেই ছিল মেসির শৈল্পিক ছোঁয়া। গোল করতে না পারলেও দেখিয়েছেন পাসিং ফুটবলের অনুপম শৈলী।
সুপার ঈগলসদের রাফ ফুটবলের শিকার হয়েছেন মেসি। রক্তাক্ত হয়েছে তাঁর মুখ। মুখে ব্যান্ডেজ নিয়েও খেলেছেন। হাজারো অনুরাগীকে তিনি হতোদ্যম করতে চান নি। পেলে, ম্যারাডোনার খেলা দেখতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও মেসির খেলার মধ্যেও ছিল অন্য রকম আনন্দ। সমকালের বিশ্বসেরা ফুটবলারের খেলা দেখতে পাওয়াটা এক জীবনে অনেক বড় ঘটনা। তাঁর উপস্থিতিতে গৌরবোজ্জ্বল হয়েছে ঢাকার ফুটবলের ইতিহাস।
ঢাকার মাঠে আর্জেন্টিনা এবং নাইজেরিয়া জাতীয় দলের মধ্যেকার ফুটবল ম্যাচ দেখা যাবে, এটা ছিল সত্যিই অভাবিত, অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে যে আর্জেন্টিনা আর মেসি ছিল দূর গ্রহের, তাদের এভাবে হাতের নাগালে পাওয়া ছিল এককথায় বিস্ময়কর৷ সব কিছু ছাপিয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন মেসি। তাঁর ঔজ্জ্বল্যের কাছে ম্লান হয়ে যায় দুই দলের বিশ্বখ্যাত ফুটবলাররা। ব্যয়বহুল এই ম্যাচটি দেশের ফুটবলে কতটা প্রভাব রাখতে পেরেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে কখনও কখনও অঙ্কের হিসেবের চেয়ে স্বপ্নপূরণ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অঙ্কের মামুলি হিসাব তো একসময় মিলিয়ে যায়। কিন্তু রয়ে যায় আয়োজনের অমলিন স্মৃতি। তা কখনও হারিয়ে যায় না। সঙ্গত কারণেই এই ফুটবল ম্যাচটি ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্যাদার আসনে। আর বিশ্বসেরা ফুটবলার মেসির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ দেশের ফুটবল। সেটা ভাবলেও কি শিহরিত হতে হয় না?